সিডনী শনিবার, ৫ই অক্টোবর ২০২৪, ২০শে আশ্বিন ১৪৩১

স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার : মোঃ ইয়াকুব আলি


প্রকাশিত:
২ মে ২০২৩ ২২:০৩

আপডেট:
২ মে ২০২৩ ২২:০৪

 

ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক! ঈদ মোবারক!
পবিত্র শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। আগামীকাল বাড়াদি পশ্চিম পাড়া ঈদগাহ ময়দানে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামায অনুষ্ঠিত হবে। আপনাদের সকলকে নিজ নিজ জায়নামাজসহ ঈদের নামাযে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করা যাচ্ছে।

ঈদের আগেরদিন সন্ধ্যা থেকে আমাদের এলাকায় মাইকিং শুরু হয়ে যেত। তারও আগে আমরা আমাদের পাড়ার বরগী বাড়ির তেমাথায় জড়ো হয়ে সকলে মিলে চাঁদ দেখতাম। কে সবার আগে চাঁদ দেখতে পারে সেটা নিয়ে ছোটদের মধ্যে চলতো নীরব প্রতিযোগিতা। কেউ একজন দেখতে পেলেই বাকিদের দেখিয়ে দিতো। আর কোন কারণে চাঁদ না দেখা গেলে পাড়ার একটামাত্র টিভিই ছিল আমাদের ভরসা। সন্ধ্যা থেকেই আমরা সালামদের বাসায় ভীড় করতে শুরু করতাম। দেশের কোথাও চাঁদ দেখা দেয়ার সাথে সাথে সেটা ঘোষণা করা হতো। এরপরই প্রদর্শন করা হতো কাজী নজরুল ইসলামের সেই অমর গান -

ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ

এরপর সবাই মেহেদীর পাতা সংগ্রহে লেগে যেতো। পাড়ার বিভিন্ন মেহেদীর গাছ থেকে পাতা তুলে এনে সেটা শিল পাটায় মিহি করে বেটে সবার হাতে দেয়া হতো। হাতের প্রত্যেকটা আঙুলের নখ মেহেদী পাতার প্রলেপে ঢেকে যেত। আর হাতের তালুর মাঝে দেয়া হতো একটা বড় গোলাকার ফোঁটা। এরপর আমরা সযত্নে সেই হাত নড়াচড়া করাতাম যেন কোনভাবেই হাত থেকে মেহেদী পাতার প্রলেপ ঝরে না যায়। এরপর সেটা শুকিয়ে গেলে তুলে ফেলা হতো। তারপর হাত ধুয়ে সরিষার তেল দেয়া হতো। সরিষার তেল দিলে রঙটা দারুণ ফুটে ওঠে। কার হাতের মেহেদীর রঙ কত গাঢ় হলো সেটা সবাই সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতাম।

আমরা প্রচণ্ড রকমের উত্তেজনা নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। ঘুমের মধ্যে ঈদের নামায পড়া নিয়ে কতশত স্বপ্ন দেখতাম আমরা। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কলপাড়ে দৌড়। কলে চাপ দিয়ে টিনের বালতি ভরতি করা হতো। এরপর নতুন সাবান দিয়ে একে একে সবাই গোসল করতাম। অনেকেই পুকুর থেকে গোসল করে আসতো। মা একেবারে সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাতো। আব্বা আমাদের গোসল করিয়ে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিতেন। এরপর চোখে সুরমার প্রলেপ।

হোমিওপ্যাথির শিশির মতো ছোট বোতলে থাকতো আতর। সেই আতর এক টুকরো ছোট তুলোতে ভিজিয়ে সেটা দিয়ে বুকে পিঠে আতর মেখে নিতাম। তারপর সেটা ডান কানের উপরের দিকের ভাঁজে গুজে রাখা হতো। আমরা খুব সজাগ থাকতাম যেন সেটা কান থেকে পড়ে না যায়। ঈদগাহে রওনা দেয়ার মুহুর্তে মা আমাদেরকে এক টাকা বা দু'টাকা দিয়ে দিতো মজা কিনে খাওয়ার জন্য। দোকানের সস্তা মূল্যের খাবারগুলোকে আমরা এক কথায় বলতাম মজা৷ এরকম নামকরণের কারণ হয়তোবা এগুলো আমাদেরকে আনন্দ দিতো সেই জন্য।

তৈরি হয়ে যাওয়ার পর মা সবাইকে প্লেটে সেমাই রান্না খেতে দিতেন। আমরা ছোটরা তাড়াহুড়ো করে সামান্য সেমাই মুখে দিয়েই ঈদগাহের উদ্দ্যেশ্যে ছুট দিতাম। আব্বার হাতে থাকতো বড় শীতল পাটি। রাস্তায় যেতে যেতে পাড়ার সব বন্ধুরা একসাথে হয়ে যেতাম। তারপর ঈদগাহের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করতাম। যতই ঈদগাহের কাছাকাছি হতে থাকতাম ততই ঈদগাহের মাইকে হুজুরের ঘোষণা স্পষ্ট শুনতে পেতাম। ঈদগাহে ঢোকার রাস্তার দুপাশে আমাদের পাড়ার পাল এবং বরগী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিভিন্ন খাবার দোকান দিতো। আমরা ঈদের নামায আদায় করে প্রথমেই নিজেদের মধ্যে কোলাকুলি সেরে নিতাম। তারপর ঈদগাহ থেকে বেরিয়েই বাইরের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে কিনে নিতাম আট আনা এক টাকা মূল্যের পাপড় ভাজা। সেটা খেতে খেতেই ফিরে আসতাম।

বাসায় ফিরেই আমরা মেতে উঠতাম বিভিন্ন প্রকারের খেলাধুলায়। খেলাধুলার পাশাপাশি এর ওর বাড়ি যেয়ে খেয়ে আসতাম। আর বিকেলবেলা আমরা সবাই সিন্নি নিয়ে হাজির হতাম সমাজে। সিন্নি বলতে ছিল খিচুড়ি। প্রত্যেক পাড়াতেই একাধিক সমাজ থাকতো। আমাদের পাড়ায় দুটো সমাজ ছিল। একটা ছিল আমাদের পাড়ার মাতুব্বর মন্টু চাচাদের বাড়িতে আরেকটা ছিল বাগাড়িদের বাড়িতে। বাগাড়িরা যেহেতু আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় হতেন তাই আমরা যেতাম উনাদের সমাজে। সব বাড়ির সিন্নি এসে গেলে সেগুলোকে মিশিয়ে দেয়া হতো। এরপর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বৃত্তাকারে গোল করে বসিয়ে সিন্নি বিলি করা হতো। ঈদের দিন রাত্রে টিভিতে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি দেখার মধ্যে দিয়ে শেষ হতো আনন্দমুখর ঈদের দিনটি।

প্রবাসের ঈদের আনন্দ একটু আলাদা ধরণের। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরলাম কারণ ছেলেমেয়েকে নিয়ে চাঁদ দেখতে যাবো। ইফতার শেষ করেই বাসার পাশের ভিকটোরিয়া পার্কে চলে গেলাম যেখান থেকে পশ্চিম আকাশটা পুরোপুরি দেখা যায়। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমরা চাঁদ মামার দেখা পেলাম না। অবশেষে অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপের ক্ষুদেবার্তা থেকে জানলাম শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। আগামীকাল ঈদ। এরপর থেকেই বাসার টিভিতে ইউটিউবে 'ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' গান ছেড়ে দিই।

পাশাপাশি বেজে চলে মিলন মাহমুদের 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার' গানটি। গানটির চিত্রায়নের ভিডিও দেখায় আর ছেলেমেয়েকে বাড়ি ফেরার টানের কথা ব্যাখ্যা করি। বলি, কোন আনন্দই আসলে আনন্দ হয়ে উঠে না যদি না সেটা আমরা আপনজনদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে না পারি। এই বিষয়টা ওরা আগে ঠিক বুঝতো না। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওরা আমাদের আবেগটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। তাই সেদিন তারা আর ইউটিউব দেখা নিয়ে ঝামেলা করে না।

এরপর রাত্রে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছুটলাম মুদির দোকান টুকিটাকিতে। সেখানে চাঁদ রাতের মেহদী উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। যেয়ে দেখি বিশাল ভীড়। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে মেয়ের হাতে মেহেদী দিয়ে নিলাম। এতো সময় অপেক্ষা করতেও কারো বিরক্তি নেই। সবার মুখেই উৎসবের হাসি। প্রবাসে ঈদকে সামনে রেখে চলে বিভিন্ন প্রদর্শনী। সেখানে বাহারি রঙের ঈদের পোশাক পাওয়া যায়। পাশাপাশি সেসব জায়গায় মেহেদী দেয়ারও ব্যবস্থা থাকে। সেসব প্রদশর্নীতে গেলে মনেহয় যেন ঈদের আগের রাত্রে দেশের ঈদের বাজারে এসেছি।

এরপর গভীর রাত্র পর্যন্ত চললো ঈদের রান্না বান্না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছেলেমেয়ে দুটোকেও তুলে দিলাম। এরপর সবাই গোসল করে নতুন কাপড় পরে নিলাম। এইবার অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার ঈদের জামাতের আয়োজন করেছিল আমাদের বাসার কাছের ভিকটোরিয়া পার্কে। আমাদের বাসা থেকেই ঈদের মাঠের বয়ানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঠিক যেমন ছোটবেলায় আমরা ঈদগাহ থেকে হুজুরের বয়ান শুনতে পেতাম।

সেমাই দিয়ে মিষ্টি মুখ করে ছেলেমেয়ে দুটোকে সাথে নিয়ে নামাযে চলে গেলাম। পার্কের খোলা মাঠটা যেন হয়ে উঠেছিল দেশের ঈদগাহ ময়দান। মাঠে প্রবেশপথে বিভিন্ন কাউন্টারে রাখা ছিল ডোনাট আর জিলাপি। পর্দা দিয়ে আলাদা করে ছেলেমেয়েদের ঈদের নামাযের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রায় তিন হাজার লোক একসাথে নামায আদায় করলো। নামাজের শেষে চললো কোলাকুলি। আমরা জিলাপি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। এই জিলাপির স্বাদ সবসময়ই কেন জানি আলাদা হয়। হয়তোবা এটা আমাদের মনের আবেগের কারণে।

বাসায় ফিরে এসে সবাই মিলে শুরুতেই প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। এরপর উনারাও বেড়াতে আসলেন। এভাবেই ঈদের সারাটাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেল। ঈদ উপলক্ষে এমন অনেকের সাথেই দেখা হয় কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও যাদের সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। পাশাপাশি বাচ্চারাও একটা বিনোদনের সুযোগ পায়। সব বাচ্চা এক জায়গায় হলে তাদেরকে আর বলে দিতে হয় না তারা কি করবে। তারা নিজেদের মতো করে নিজেরা খেলা আবিষ্কার করে খেলতে থাকে। এইবার ঈদের দিন ছুটির দিন হওয়াতে একটু বাড়তি আনন্দ যোগ হয়েছিল। এরপর রাত জেগে চলে ঈদের গান নাটক দেখা। প্রবাসে বসেও আমরা ঈদের ইত্যাদি দেখতে ভুলি না কখনওই। পরেরদিনও আমরা দূরে কাছের বন্ধুদের বাসায় বেড়িয়ে সময় পার করলাম। তারপরদিন সোমবারে আবার কাজে ফিরে গেলাম।


পাশাপাশি চলে অন্তর্জালের মাধ্যমে দেশে ফেলে আসা স্বজন বন্ধুদের সাথে চলে শুভেচ্ছা বিনিময়। এটা সবসময়ই বাড়তি আনন্দ যোগ করে। আর দেশের সবকিছুই তো এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়। একটাই শুধু দুঃখ যে তাদেরকে ছুঁয়ে দেখা যায় না। প্রবাসে আসলে ঈদের আনন্দ এক দিনে শেষ হয় না। এই আনন্দ চলতে থাকে সপ্তাহব্যাপী কখনও মাসব্যাপী। কারণ ঈদ শেষ হলেও চলতে থাকে ঈদ পুনর্মিলনী।
প্রবাসের যান্ত্রিক জীবনে উৎসবের দিনগুলোতে একটু অবসর পাওয়া যায়। এই অবসরগুলো বারবার দেশে ফেলে আসা স্বজন এবং সময় নিয়ে আমরা আবেগতাড়িত হই। অন্যান্য আর দশটা সাধারণ দিনে দেশের কথা স্বজনের কথা মনে না পড়লেও উৎসবের সময়গুলোতে সব একসাথে মনেপড়ে যায়। বাকি জীবনটা কেটে যায় এক ধরণের দোদুল্যমানতায়। কিন্তু তবুও বাস্তবতার কষাঘাতে জীবন বয়ে চলে। উৎসবের দিনগুলোতে সবার মনের মধ্যেই একই গান বেজে চলে - স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top