সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজানের কয়েকটি অনুগল্প


প্রকাশিত:
১৩ জুন ২০১৯ ০৭:৩৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২০ ০২:২৪

১.

নিরুত্তরের মুহূর্ত

হ্যালো...হ্যালো...হ্যালো... 

কি হলো... 

শুনতে পাচ্ছোনা তুমি? 

ওরা আমাকে আজ দেখতে আসবে... অনেক কষ্ট করে নীতার ফোন থেকে ফোন করছি 

কি হলো... 

শুনতে পাচ্ছোনা ... তুমি... 

কিছু একটাতো বলো... ... 

আমি জিমির কাছ থেকে এরকম একপক্ষীয় ছটফটানি কথা শুনছিলাম। ও যেন আটলান্টিকে ডুবে যাওয়া কোন জাহাজের বেঁচে থাকা একমাত্র যাত্রী। খড়কুটো রূপী একটি কাপড়ের পুটলি ধরে পাশ দিয়ে ছুটে চলা আনমনা জাহাজের কারো দিকে চেয়ে বাঁচার আকুতি জানিয়ে ডাকছিল। আমিও আনমনা। নিরুত্তর। হঠাৎই নীতার কণ্ঠ,
ওই জিমি, ফোন দে। চাচি আসছে।

এরপর সাতদিন কোন ফোন বা খবর পাইনি জিমির। এই নীলফামারী নামক জেলাশহর থেকে প্রায়ই ঢাকায় ছুটতাম চাকরির জন্য। কিন্তু সেদিন যেতে পারিনি ছুটে জিমির বাবার কেনা সেই বনানীর ফ্লাটে। জিমির ফোন পেলাম সাতদিনের মাথায়। জানালো সে এখন এক কর্পোরেট অফিসারের বউ। তার বাবা-মা নাকি খুব খুশি। আর এখন সে নিজেও নাকি বাবা-মা'র এই খুশির চেহারা যাতে অমলিন থাকে সে চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে।

এমএসসি পাশের সনদ নিয়ে সুউচ্চ দালানের কত কক্ষে দিয়েছি সাক্ষাৎকার। সামনে বসে থাকা আনন্দমোদী মহলের আনন্দ বেড়েছে বৈকি আমার সনদ ও দাড়িহীন এক ভাঙা চোয়াল দেখে। আমি জুটে নিয়েছি এক কেজি স্কুলের পণ্ডিতি পদ। এই পদবীতে জিমির বাবার বাসার দাড়োয়ানও নাকি কাষ্ঠহাসি দেয়। তাই সেদিন জিমির কথার কোন উত্তর দেয়ার আমি সাহস করিনি।

এই আমার জেনারেশনটা কি এভাবেই নিজের চোখের সামনে দিয়ে ডুবে যেতে দেখবে একজন অসহায়কে? কেনইবা পারছে না হাতটি ধরে ঝটকা টান দিয়ে তুলে নিতে ঘরে?

সেদিন একটা সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য ঢাকা গেলাম। উঁচু দালানের ঝকমকে এক কার্যালয়ের ভিতর অপেক্ষমান উদ্বিগ্ন অনেক মুখের মধ্যে আমিও শামিল হলাম। পালাক্রমে আমি প্রশ্নবানের আদালতে হাজির। জীবনবৃত্তান্ত দেখে বোর্ড প্রধান বললেন, আপনি কারমাইকেল কলেজে বোটানিতে পড়েছেন! আমার মিসেসও বোটানির। ও অবশ্য আপনার একব্যাচ জুনিয়র। জিমি নামে কাউকে চিনেন?
আমি ধাতস্ত হয়ে বললাম, জি চিনি। এক ডিপার্টমেন্টতো তাই মাঝে মাঝে দেখা হতো।
পরেরদিন দুপুরবেলা সেই কার্যালয় থেকে জয়েনিংয়ের জন্য ফোন এসেছিল। আমি নীতার ফোনথেকে আসা কলের উত্তরের মতই নীরব ছিলাম।

২.

নিষুতি রাত ও ভয়

রাত নিঝুম। নিষুতি ঝপঝপ শীত পড়ছে। খেটে খাওয়া মানুষজন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের শ্রান্তি লাঘবে ঘুমে বিভোর। আগামীকালের কাজের শক্তি সঞ্চয়ের নিমিত্তে কেউ কেউ নাক ডাকছে। সদ্য বিয়োনো বউটি আঁতুড়ঘরে কচি সন্তানকে ঘুমিয়ে দিয়েছে মাত্রই। বয়োবৃদ্ধ আসলাম চাচা কাশতে কাশতে ক্লান্ত হয়ে কেবলি ঘুমের রাজ্যে প্রবেশ করেছে।

একদল কালোপরিচ্ছদধারী চুরি করার সমস্ত উপাদান সমেত বেড়িয়ে পড়ল। এই নিস্তব্ধ ও ভয়ানক রাতে তাদের কেউ নেই পথ রুখিবার। ঝোপঝাড় ও বাঁশের ঝোপে ধাড়ালো নখ ও থাবার পুষ্ট শেয়ালগুলি ভয়ানক এক চিৎকার শুরু করেছে।

তারস্বরে রাস্তার সারমেয়গুলি ঝাঁঝালো কণ্ঠে করছে ঘেউঘেউ। কলিজাটা ভয়ে কেঁপে উঠলো আঁতুড়ঘরে বিয়োনো বউয়ের। এই বিকট ভয়ানক চেঁচামেচি কি কোন বিপদের সংকেত? ওয়া, ওয়া করে কেঁদে ওঠে সন্তানটি। বয়োবৃদ্ধ আসলাম ধড়পড় করে উঠে বসে পড়ে। শ্বাসকষ্ট হয় তার। মনে হচ্ছে প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের খেটে খাওয়া মানুষের ঘুমভাঙ্গল। তাদের ভয় খোপের মুরগি বুঝি নিয়ে গেল ঐ পরজীবী শেয়াল।

আমিও ভয়ে জেগে উঠলাম। কলিজায় শুরু হয়েছে ঢেঁকির পার। না জানি মাসান্তের বেতনটুকু বুঝি আলমারি ভেঙ্গে নিয়ে গেল কালোপরিচ্ছদধারী চোরেরা!


৩.

লাইব্রেরি

স্বল্পশিক্ষিত মানুষ মোহাম্মদ আলী। রমজানের তারাবি পড়ছিলেন। তারাবি পড়া শেষে মসজিদের খোলা জায়গায় বসলেন। উত্তরীয় সমীরণ তাকে শীতল করে তুলল। শহুরে ভ্যাবসা গরম উবে গেল। ঢুলুঢুলু চোখ। সামনে দেখতে পেলেন নানা রঙের পুষ্প, লতা, বৃক্ষের সমাহারে সুসজ্জিত এক বিশালায়তন।

তিনি হাঁটছেন। কিছু পাহাড়াদার আছে এই বিশালায়তনে। কী এক উদাসীন ভাব তাদের! মূল সড়ক ধরে এগুচ্ছেন তিনি। ডানে বাপে ছোট্টছোট্ট অনেক রাস্তা বা গলি। আর গলির দু'পাশে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন প্রকার জীবনীগ্রন্থ। বিখ্যাত এক ভাষা সৈনিকের জীবনীগ্রন্থ তার চোখে পড়ল। নাম আবুল কালাম শামসুদ্দীন। কবে জন্ম। কবে মৃত্যু। সবই লিখা আছে। কী কী অবদান তাও লিখা। এইগলিরই পাশে দেখতে পান সদ্যপ্রয়াত পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপির জীবনীগ্রন্থ। কত কত জায়গায় ভ্রমণ করেছেন তিনি। কত্ত অপারেশন করেছেন তিনি। কিন্তু তারই জীবনীগ্রন্থ আজ স্থান পেল নামকরা অনেক গুণ্ডা, বদমায়েশের জীবনীগ্রন্থের পাশে। বদমায়েশগুলোর পরিচয় লিপিবদ্ধ তাদের জীবনীগ্রন্থের প্রচ্ছদে। যেমনটি একজনের পরিচয় বিখ্যাত নেতা, ধনকুবের, জনদরদী মোকছেদ ভাই। মোহাম্মদ আলী তার জ্ঞানমতে জানেন যে, এই বিখ্যাত নেতা একসময় টোকাই ছিল। পড়ে মানুষের বাড়িঘর, দোকানপাট, সরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি দখল করে হয়েছিলেন ধনকুবের। সেজেছিলেন নামকরা জনদরদী। পেয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সম্মানজনক পদবী।

আরেকটু এগুতেই দেখতে পেলেন এক পীরের জীবনীগ্রন্থ। বাপরে কী সাজসজ্জা! প্রচ্ছদ যেন ঝলকে উঠছে! অন্যান্য গ্রন্থগুলোর থেকে এটি বেশ ঝকঝকা। ফকফকা। অনেকজনই সম্ভবত পড়েন এটি। অথবা খোঁজখবর রাখেন। মোহাম্মদ আলীর এক বন্ধুর বোনকে নিয়ে ভেগে গেছিল এই পীর। কত মানুষের পকেটের টাকা বের করেছে! কতজনকে ভুলভাল বুঝিয়ে বাড়িঘর সর্বস্ব বিক্রি করে তার দরবারের খাদেম আর খলিফা বানিয়েছে! পীরের লকব, পদবীও ঝাক্কাস!

এত্ত এত্ত বই কখন পড়ে শেষ করবে মোহাম্মদ আলী। তবুও সামনে এগোয়। দেখে দেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর খেতাবে ভূষিত নারীর জীবনী। পাশেই সাজিয়ে রাখা আছে এক মুটেমজুরের দিনলিপি। পিতৃপরিচয়হীন এক বালকের জীবনী একই সারিতে। গরীবদের একদমই সহ্য করতে পারতো না আলমাস মিয়া। তার জীবনী দেখে এই দুঃস্থ ছেলেটির জীবনীর গা ঘেঁষা।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই লাইব্রেরির শেষতক পৌঁছুতে পারেন না মোহাম্মদ আলী। ক্লান্তি ভর করে তার শরীরে। তিনি ফিরে আসেন মসজিদ প্রাঙ্গণে। এসে দেখেন সবাই চলে গেছে বাড়িতে। তিনিও ভাবুকচিত্তে পা বাড়ালেন বাড়ির দিকে।

বাড়িতে পৌঁছুতেই তার ছেলে আনোয়ারুল ফেরদৌস শাহীন জিগ্যেস করে ওঠে, বাবা এতক্ষণ কই ছিলা? আমি তোমায় আশেপাশে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

বাপরে, মসজিদের ঐ উত্তর পাশের লাইব্রেরিতে পায়চারি করতে গেছিলাম, বলে উত্তর করে মোহাম্মদ আলী।

বাবা, তুমি এসব কী বলো! ওটা লাইব্রেরি হতে যাবে কেন? ওটাতো আজিমপুর কবরস্থান।

 

মীম মিজান
লেখক ও সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা





আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top