সত্য, বিশ্বাস ও আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : সাজিব চৌধুরী
প্রকাশিত:
২৭ জুলাই ২০২০ ২২:৫৬
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৫
সত্য ও বিশ্বাস বিষয়ে আমাদের মনোজগতে নানান কৌতূহলের জন্ম নেয়। তার জন্যেই জ্ঞানীগুণীজন বিভিন্নভাবে এই বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন। আমিও আমার মতো করে আলোচনার চেষ্টা করছি।
সত্য উপলব্ধি বিষয়টি জটিল একটি বিষয়। সত্য উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন অনুসন্ধিৎসু একটা মন।
সত্য কী? প্রকৃতপক্ষে, মিথ্যার বিপরীত যা তাই সত্য। তাহলে, মিথ্যা কী?
মিথ্যা হলো যা অবাস্তব, প্রমাণহীন, অস্তিত্বহীন, বানোয়াট, লেবাসধারী, ভ্রম, ছল ইত্যাদি। অর্থাৎ, যা মিথ্যা নয়, তাই সত্য। মৌলিক দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য দুই ধরণের হতে পারে।
এক- আবিষ্কৃত সত্য, দুই - অনাবিষ্কৃত সত্য।
আবিষ্কৃত সত্য নিয়ে মানুষের কোন দ্বন্দ্ব নেই। আবিষ্কৃত সত্যকে আমরা প্রমাণিত সত্যও বলতে পারি। অনাবিষ্কৃত সত্য নিয়ে মানুষের যতো বাগবিতণ্ডা। অনাবিষ্কৃত বা অপ্রমাণিত বিষয় থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বাস। বিশ্বাস এমন একটি শব্দ যা কখনও সত্য, কখনও সত্যের কাছাকাছি, অর্ধ সত্য বা অর্ধ মিথ্যা, আংশিক সত্য, আবার কখনও সম্পূর্ণ মিথ্যা। বিশ্বাস তখনই সত্যে পরিণত হয়, যখন তা প্রমাণিত হয়। তবে, সব বিশ্বাস সত্য নয়, কিন্তু সব সত্য-ই উপলব্ধিজাত ও বিশ্বাস থেকে জন্ম। তাহলে বলা যাই, সত্যের প্রাকপর্যায় হলো বিশ্বাস। কোন একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলে জন্ম নেয় সত্য।
বিশ্বাস ও সত্য যদিও কাছাকাছি অবস্থান করে, এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য তো আছেই। বিশ্বাস ও সত্যের ধারণাকে নানান জন নানানভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রায় সকলের ধারণা আমার উল্লিখিত ধারণার কাছাকাছি।
আমি বিশ্বাস ও সত্যের ধারণাকে একটু গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছি।
আমরা যদি বিশ্বাসকে কিছু উপদান নিয়ে সেট গঠন করি এবং আবার যাচাইকৃত সত্য উপদানগুলো দিয়ে আরও একটি সেট গঠনের মাধ্যমে কয়েকটি বিশ্লেষণ করি, তাহলে কী ঘটছে দেখা যাক।
এক্ষেত্রে, বিশ্বাসকে B সেট এবং যাচাইকৃত সত্যের উপদানকে T সেট ধরে বিশ্লেষণ করা যাক।
পরীক্ষা-১
যদি, B={a,b,c,d} হয়,
সত্যতা যাচাই করে দেখা গেল a, b, c, d উপদানগুলো বিদ্যমান।
অর্থাৎ, T={a,b,c,d}
অতএব, B=T
দেখা গেল বিশ্বাস সত্য হতে পারে।
পরীক্ষা-২
যদি, B= {a,b,c,d} হয়,
সত্যতা যাচাই করে দেখা গেল a, b, c, উপদানগুলো বিদ্যমান।
অর্থাৎ, T= {a,b,c}
এখানে, T সেটের উপদান সমূহ B সেটের সমান নয়, কিন্তু T সেটের সবকটি উপদান B সেটে বিদ্যমান।
অতএব, T, B এর উপসেট।
যেহেতু, যাচাইকৃত সত্যের উপদানগুলো একটা ভিন্ন অন্য সবগুলো বিশ্বাস সেটে রয়েছে, সেক্ষেত্রে বলা যায় বিশ্বাস সত্যের নিকটবর্তী বা কাছাকাছি।
অতএব, বিশ্বাস সত্যের কাছাকাছি হতে পারে।
উপরের পরীক্ষার আদলে,
পরীক্ষা-৩
যদি, B={a,b,c,d} হয়,
আবার, T={a,b} হলে
বিশ্বাস হয়ে যায় অর্ধসত্য বা অর্ধমিথ্যা।
আবার, T={a} হলে,
বিশ্বাস হয়ে যায় একচতুর্থাংশ সত্য।
আবার, T={ } হলে,
সত্য ফাঁকা হয়ে যায়।
অর্থাৎ বিশ্বাসের মধ্যে কোন সত্যতা থাকে না বা বিশ্বাস মিথ্যায় পরিণত হয়।
তাহলে, বিশ্বাস হতে পারে,
১/ সত্য
২/ সত্যের কাছাকাছি বা নিকটবর্তী সত্য
৩/ অর্ধ সত্য বা অর্ধ মিথ্যা
৪/ আংশিক সত্য
৫/ সম্পূর্ণ মিথ্যা
মূলত বিশ্বাস সেটের সকল উপসেটই যাচাইকৃত প্রমাণ সেট।
অতএব, বিশ্বাসকে যতক্ষণ যাচাই করা হবে না, ততক্ষণ বিশ্বাস সত্য, মিথ্যা, অর্ধ সত্য, কাছাকাছি সত্য বা আংশিক সত্যের মধ্যে ঘুরপাক খেতে পারে। তাহলে বলা যাই, সত্য উপলব্ধির জন্য প্রয়োজন যাচাই বা গবেষণা। আবার, গবেষণার মধ্যে যদি ত্রুটি থাকে, তবে সত্য প্রকাশিত না হয়ে মিথ্যার আবর্তন হতে পারে।
অতএব, প্রমাণিত না হলে বিশ্বাস সর্বদা বিশ্বাসের জায়গায় থেকে যায়।
আবার, অপ্রমাণিত বিশ্বাসকে অসত্যও বলা যাবে না। আমরা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বংশানুক্রমিক যে বিশ্বাসগুলো পেয়ে আসি তা প্রমাণ ছাড়াই সত্য বলে মেনে নিই। অনেক সময় কেউ হাজার যুক্তি দিলেও বিশ্বাসকে কখনও মিথ্যা বলে স্বীকার করি না। তবে, পৃথিবীর সবকিছু প্রমাণিত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং তা সম্ভবও নয়। সব প্রমাণিত সত্যের উপর চলতে গেলে ঘটবে নানান বিপত্তি। সত্যকে খুঁজে পেতে, করতে হবে অনুসন্ধান ও গবেষণা। মনকে তালাবদ্ধ করে অনুসন্ধান করলে কখনও সত্য উপলব্ধি সম্ভব নয়। আর যেখানে সত্য উপলব্ধি নেই, সেখানে বিশ্বাসটাও ঠুনকো প্রকৃতির হয়ে থাকে। তাই, মানুষের যেকোন বিশ্বাসকে সত্য উপলব্ধিতে নিতে না পারলে, সেই বিশ্বাস ক্রমাগত হারিয়ে যেতে পারে। মানুষ সত্যকে জানার জন্য বহু আগে থেকেই বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে মানুষ যা বিশ্বাস করতে চায়, তা গবেষণার মাধ্যমে সত্যের দ্বারও উন্মোচন করতে চায়। কখনও তা সম্ভব হয়েছে, কখনও তা সম্ভব হয়নি। সম্ভব-অসম্ভবের মধ্যেই মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে প্রগতির দিকে। মানুষ যেদিন অধিকাংশ বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে পারবে আদৌ তা সত্য কিনা , সেদিন সত্য উপলব্ধিতে বলিয়ান হয়ে মানুষ খুঁজে পাবে তার নিজের অস্তিত্বকে, তখনই সে বুঝতে পারবে সৃষ্টির রহস্য। ততোদিন পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে বিশ্বাসের হাল ধরে। তবে, প্রমাণ না হওয়ার আগেই বিশ্বাসের হাল ছেড়ে দিলে মানুষ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। তাই, বিশ্বাসের হাল ধরে মানবজাতিকে যেতে হবে গূঢ় সত্যের আলোকিত পথে।
------------------------------------------------
সাজিব চৌধুরী
কবি ও প্রাবন্ধিক
বিষয়: সাজিব চৌধুরী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: