নামে-বেনামে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় এমপি রতনের


প্রকাশিত:
২৭ জানুয়ারী ২০২৫ ১২:৪৩

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ১৪:৪৭

ফাইল ছবি

সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর) আসনের সাবেক সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। নৌকার টিকিটে এমপি হয়ে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। জেলার টাঙ্গুয়া হাওর, জলমহাল, বালুমহাল, কয়লা-চুনাপাথর শুল্ক স্টেশন, সীমান্ত বাণিজ্য, হাটবাজার ইজারা, হাওরের পিআইসি বাঁধ সহ সব খাতে চাঁদাবাজির আধিপত্য বিস্তার ছিল তার। একটানা তিনবার এমপি থাকার সুবাদে এসব স্পট থেকে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। বিভাগীয় শহর সিলেটে সামান্য বেতনে একটি বেসরকারি ক্যাবল কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। এমপি হওয়ার পর অবৈধ পথে গড়েন সম্পদের পাহাড় এবং বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলেন নামে-বেনামে বাড়ি।

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন রতন। তবে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে লড়ে হেরে যান তিনি। ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি। জানা যায়, রতন এমপি হওয়ার পর ১৫ বছরে বিলাসী বাড়ি সহ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ঢাকা ও কানাডায় করেছেন ২৫টি বাড়ি। তবে, এসব অনেক বাড়ির জায়গা জোর দখল এবং খাস জমিতে করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব জায়গা ফিরে পেতে ভুক্তভোগীরা তাকে হন্যে হয়েও খুঁজে পাচ্ছেন না। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে সাত কোটি টাকায় ‘পায়েল পিউ’ নামে একটি আলিশান বাড়ি ক্রয় করেন তিনি। নিজ এলাকা ধরমপাশা উপজেলায় তৈরি করেন বিলাসবহুল বাড়ি ‘হাওর বাংলা’। দুই বাড়িতে খরচ করেন প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এ দুই বাড়ি করার পর রতনের বাড়ি বিলাসের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পায়েল পিউ কিংবা ধরমপাশায় হাওর বাংলা নয়, নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৫টি বাড়ি করেন রতন। বাড়ি ছাড়াও নেত্রকোনা শহরে মা-বাবার নামে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ৫০ কোটি টাকায় জমি ক্রয় করেন তিনি। ছোট ভাই মোবারক হোসেন যতনের নামে ২৫ একর জমি কিনেন তিনি। তিন মেয়াদে এমপি থাকাকালে শুধু বাড়ি বিলাস, জায়গা কেনা ও কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে তার। ধর্মপাশায় নিজের গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি করে ‘হাওর বাংলা’ নামে একটি কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেন রতন। সুনামগঞ্জ শহরের মল্লিকপুরে জেলা পুলিশ লাইন্সের বিপরীতে পায়েল পিউ বাড়িটিতে এখন রতন থাকছেন না। সীমানা প্রাচীর তালাবদ্ধ। প্রতিবেশীরা জানান, পট পরিবর্তনের পর থেকে বাড়িটি সুনসান। একই অবস্থা নেত্রকোনা, মোহনগঞ্জ ও ঢাকার বাড়িগুলোর।

রতনের নিজ উপজেলা ধর্মপাশায় আরও সাতটি বাড়ি, মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে দু’টি, নেত্রকোনা শহরে একটি, রাজধানীর নিকেতনে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। সহোদর যতন মিয়ার নামে ৫০০ একর জমি কিনেছেন তিনি। ঢাকার সাভারে একটি বাড়ি, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌর শহরে বাড়ি করার জন্য রয়েছে ২১০ শতক জমি, সুনামগঞ্জের হাজিপাড়া এলাকায় দ্বিতীয় স্ত্রী জিনাতুল তানভী ঝুমুরের নামে একটি বাড়ি, বড় ভাই মোবারক হোসেন মাসুদকে পাইকুরাটি বাজারে জায়গা কিনে একটি বাড়ি, একটি স’মিল করে দিয়েছেন রতন। ছোট ভাই মোজাম্মেল হোসেন রুকনকে নওধার গ্রামে একটি বাড়ি ও নেত্রকোনা শহরের বিজিবি ক্যাম্পের সঙ্গে চারতলা একটি বাড়ি করে দিয়েছেন। আরেক ছোট ভাই যতনকে মোহনগঞ্জের হাসপাতাল রোডে জায়গা কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন। পাশাপাশি ছোট বোন মিনা আক্তার ও শাকুরা আক্তারকে সুনামগঞ্জ শহরে বাড়ি করে দিয়েছেন। তার আরেক ছোট বোন আংরুজা আক্তারকে নেত্রকোনায় জায়গা কিনে বাড়ি করে দিয়েছেন। রতন তৃতীয় দফায় এমপি হওয়ার পর তার ক্যাসিনো কাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে ২০১৯ সালের ১৪ই নভেম্বর সরজমিন ঘুরে “হাওরের শাহানশাহ” শিরোনামে দৈনিক মানবজমিন একটি সংবাদ প্রকাশ হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন তাহিরপুর উপজেলার লাকমা গ্রামের মিজানুর রহমান সোহেল নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা। পরে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর এ অভিযোগের অনুসন্ধান করে দুদক সত্যতা পেয়ে পরবর্তী সময়ে রতনকে দুদকে তলব করা হয় এবং বিদেশ যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছিল। তবে, তৎকালীন সরকারদলীয় এমপির দাপটে দুদকের তৎপরতা বন্ধ করে দেয় রতন।

দুদকের একটি সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ ছিল রতনের নির্বাচনী এলাকা থেকে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা চাঁদাবাজি হতো। চাঁদার অর্ধেক পেতেন রতন। সীমান্তে কয়লা আমদানিকারক গ্রুপ নামের প্রতিষ্ঠানটির ব্যানারে মাসে কোটি টাকা চাঁদাবাজি হতো। এসবের প্রমাণ পাওয়ায় দুদক তাকে তলব করেছিল। এদিকে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। সিলেট বিভাগের দুর্নীতিবাজ এমপিদের মধ্যে রতনের নামও রয়েছে এবং ইতিমধ্যে তার বাড়ি সহ নির্বাচনী এলাকায় দুদক টিম কাজ করছে। সাবেক এমপি রতন আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top