জাদুকর


প্রকাশিত:
৯ মে ২০১৯ ১৬:১২

আপডেট:
১২ মার্চ ২০২৫ ১৭:১১

জাদুকর

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ: প্রাতরাশ সেরে খাটের উপরে বসে পান চিবাচ্ছে জামসেদ জোয়ারদার। এমন সময় হন্ত দন্ত হয়ে রহমত মন্ডল এসে উপস্থিত। রহমত মন্ডল এই নিউ রয়েল বেঙ্গল সার্কাস দলের মালিক। খাটের উপরে বসে জামসেদের কাঁধের উপর একটু চাপড়ে দিয়ে সে বলল “অসাধারন জাজো, অসাধারন। তোমার জাদু দেখেতো সবাই একেবারে তাজ্জব বনে গেছে। শোন সকালে চেয়ারম্যান সাহেব লোক পাঠিয়ে ছিলেন। এলকার কিছু গন্যমান্য লোকনিয়ে তিনি আজ সার্কাস দেখতে আসবেন। তোমার জাদু দেখাই নাকি তার আসল উদ্দেশ্য। কালকে যেরকম শো হয়েছে সেরকম হলেই চলবে। শোন জাজো, চেয়ারম্যান সাহেব কিন্তু প্রথমে এই গ্রামে সার্কাস করতে দিতে রাজি হয়নি। অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে তাকে রাজি করাতে।” জামসেদ জোয়ারদার উঠে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা তার মুকুটটা হাতে নিলো। মুকুটের কয়েকটা জায়গায় একটু ময়লা লেগেছিল সেটা পরিস্কার করে আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো মুকুটা।  পিছনের দিকে ঘুরে রহমত মন্ডলের দিকে তাকিয়ে বলল, “চেয়ারম্যান সাহেবকে আমি আগে থেকে চিনি, এখান থেকে আমার বাড়ি খুব বেশী দূরে না। তিনি যথেষ্ঠ সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। সার্কাসের জন্য তিনি রাজি হননি কথাটা ভুল। সার্কাসের পাশাপাশি তুমি অন্য ব্যাবসাও কর। কোন ভাল মানুষের পক্ষে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আমি নিতান্তই পেটের দায়ে তোমার সাথে আছি । তুমি যা শুরু করেছ তাতে খুব বেশী দিন তোমার সাথে থাকতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।”  রহমত মন্ডল একটা ধাক্কা খেলেও জাজোকে বুঝতে দিলো না। একটু হেসে দিয়ে সে বলল “জাজো তুমি মনে হয় একটু উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ। তুমি রেষ্ট নেও আমি উঠলাম।” বিছনায় শুয়ে  আয়নাটা হতে নিয়ে মুখের সামনে ধরল জামসেদ কোয়ারদার। আয়নার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল ‘জাজো’। বলে নিজেই একটু হেসে দিল। তার আসল নাম জয়নাল। প্রায় পনের বছর আগে এই সার্কাসে যখন সে আসে তখন তার নাম দেয়া হয়েছিল জামসেদ জোয়ারদার। কিছু দিন যেতে না যেতেই সেই নাম হয়ে গেল জাজো। আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পরে গেল জয়নালের। দলের তখন মালিক ছিলেন কেরামত মন্ডল। তিনিই এই নামটা দিয়ে ছিলেন। অসাধরন লোক ছিলেন তিনি। দু’বছর আগে তিনি গত হয়েছেন। রহমত মন্ডল তারই ছেলে অথচ দু’জনের চরিত্রে কত ব্যবধান।

রাতের শো শুরু হয়ে গেল। প্রায় আধা ঘন্টা শো চলার পর জোকার নিমাই ঘোষনা করল এবার জাদু দেখাতে আসছে এই সার্কাস দলের সেরা আকর্ষণ জাজো। দর্শকদের মধ্যে উল্লাস উঠলো জাজো, জোজো। বড় একটা বাক্স এনে একটা প্লাটফর্মের উপরে রাখা হলো। বাক্সটার পাল্লাগুলো একেবারে খুলে ফেলে সবাইকে দেখিয়ে দেয়া হলো ভিতরে কিছুই নেই। তারপর পাল্লাগুলোকে আবার জোড়া লাগিয়ে একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতেই ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেড়িয়ে এলো ‘জাজো’। পাশেই রাখা ছিল একটা ঘোড়া। এক লাফে জাজো সেই ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে দু’টা চক্কর দিলো। দর্শকদের হর্ষোধ্বনি আর সিটি যন্ত্রী দলকেও হারমানিয়ে দিলো যেন। ঘোড়া থেকে নেমে জাজো প্লাটফর্মের উপরে দাড়ালো। দুই হাত উপরে তুলে মৃদু একটা ঝাঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্তিনের ভিতর হতে বের হয়ে এলো কয়েক জোড়া কবুতর । এবার জাজো বললো আমি সমস্যায় পড়েছি এই ঘোড়াটাকে নিয়ে ও নাকি কয়েকটা কবুতর খেয়ে ফেলেছে। দেখি কবুতর গুলাকে উদ্ধার করা যায় কিনা।” জাজো প্লাটফর্ম থেকে নেমে গিয়ে ঘোড়াটার মুখ ধরে জোরে একটা ঝাঁকি দিলো। আর দর্শক সত্যিই দেখলো ঘোড়ার মুখ থেকে দু’টো কবুতর বের হয়ে উড়ে গেল। এবার হেঁটে দর্শকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে জাজো বলল- “আমার একটা ছাগল আছে। ছাগলাটাকে সন্ধ্যা থেকে খুঁজে পাচ্ছিনা। দেখিতো এই বাক্সর মধ্যে আছে কিনা।” বাক্সটা খুলে দেখাগেল এর মধ্যে কিছুই নেই। আবার কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো বাক্সটাকে। প্রায় সাথে সাথেই আবার খুলে ফেলা হলো। দেখা গেল সত্যি সত্যিই একটা ছাগল বের হয়ে এসেছে। ছাগলাটার গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে জাজো দর্শকদেরকে বলল “আমার এই ছাগলটা একটা গাধা। কিছুই খেতে চায়না।” একথা বলেই জিহবা কেটে জাজো বলল, “হায় হায় কি বললাম, এই ছাগলতো আমার সব কথা শোনো, ও আবার গাধা হয়ে যাবে না কি।” ছাগলটাকে আবার ঢুকিয়ে দেয়া হলো বাক্সর মধ্যে। একটু পরেই দর্শক অবাক হয়ে দেখলো ঐ বাক্সের ভিতর থেকে ছাগলের পরিবর্তে একটা গাধা বের হয়ে আসছে। এভাবে  দর্শকদের হর্ষোধ্বনি আর ব্যাপক কৌতুহলের মাঝে একের পর এক জাদু দেখিয়ে যাচ্ছে জাজো। প্রায় আধাঘন্টা পরপর সে উপস্থিত হয় আর দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিয়ে চলে যায়। সবচেয়ে দেখার মত বিষয় হচ্ছে তার চমৎকার বাচন ভঙ্গি আর প্রচন্ড আতœবিশ্বাস নিয়ে চলাফেরা। যেন সেই রাজা। তার প্রতিটা শব্দে এমন এক শক্তি থাকে! মনে হয় সে যা বলছে তাই সত্য, সে যা করতে চায় তাই বুঝি করা সম্ভব। মুহূর্তের মধ্যে সে দর্শকদের এমন এক মায়ার জগতে নিয়ে যায় যেখানে বসে জাজোর প্রতি সর্বাঙ্গিন বিশ্বাস স্থাপন ছাড়া আর কিছুই কেউ চিন্তা  করতে পারে না। আর পক্ষীরাজ সওয়ার হয়ে শূন্য থেকে ধরায় নামে যে তাকে অবিশ্বাস করে এমন সাধ্যি কার। তাই জাজো যে ভাবেই যা দেখাচ্ছে তাই তারা বিশ্বাস করছে। যেন দ্রষ্টব্য বিষয় বিশ্বাস আর বাস্তবতার মধ্যেই নেই কোন ভোদাভেদ।  সার্কাস শেষ হয় জাজোর জাদু দিয়েই। এই পর্বে একজন মানুষকে কেটে দ্বিখন্ডিত করে আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়া হয়।

মাত্র ৫ দিনের মধ্যেই সার্কাস পুরোপুরি জমে গেছে। প্রথম দু’দিন শো শুরুর তিনঘন্টা আগে থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হতো। তাতে ঝামেলা অনেক বেশী হয় দেখে এখন বেলা এগারোটা থেকেই টিকিট কাউন্টার খোলা থাকে। আজ ভিড়টা যেন একটু বেশী। দুপুর একটার মধ্যেই অধের্কের বেশী টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতিদিনের অভ্যাসে আজও রহমত মন্ডল এসে জাজোকে বাহবা দিচ্ছে। এমন সময় গেটের কাছে ছোট খোটো একটা হট্টোগোল শোনা গেল। রুম থেকে বের হয়ে এলো দু’জনেই। গেটের কাছে গার্ডদের সাথে তর্ক করতে থাকা উষ্কখুষ্ক চেহাড়ার লোকটা জাজোকে দেখে জোড়ে ক্রন্দন করে উঠলো “জয়নাল”। 

আজিবরের কাছে মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে জয়নাল আর স্থির থাকতে পারলো না। আজিবরকে রুমে বসিয়ে রেখে দৌড়ে রহমত মন্ডলের কাছে গেল- “রহমত আমার মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ। গতকাল সকাল থেকে ডাইরিয়া। আমাকে এক্খুনি বাড়ি যেতে হবে।” রহমত মন্ডলের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরল যেন। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো সে- “এই সব তুমি কি বলতেছ জাজো। টিকেট বিক্রি প্রায় শেষ । তোমার জাদু দেখবে বলে এই গ্রাম সেই গ্রাম থেকে লোকজন এসে দুপুরের মধ্যেই টিকিট প্রায় শেষ করে ফেলেছে। এখন তুমি চলে গেলে দর্শকরাতো মানতে চাইবে না। ভাংচুর শুরু করে দিবেতো।” উল্টো দিকে দুই কদম হেঁটে গিয়ে মাথাটা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে রহমতে দিকে তাকিয়ে জাজো বলল “আর আমার মনের ভিতর তো ভাংচুর শুরু হয়েই গেছে। রহমত, জোর করে অনেককে দিয়েই তুমি অনেক কিছু করাতে পারো। কিন্তু শিল্পীর কাজ জোর করে আদায় করা যায় না। বাড়িতে এ রকম অসুস্থ মেয়েকে রেখে আমার পক্ষে শো করা অসম্ভব।” ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেও নিজেকে কন্ট্রোল করল রহমত মন্ডল। জাজোর কাছে গিয়ে ঘাড়ের উপরে হাত রেখে বলল “জাজো, একটা সময় ছিল যখন অনেকের মত আমিও বুঝতাম না যে জাদু একটা শিল্প। জাদুকে ভেল্কি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম আর সবার মতই। জাদু যে শিল্প সেটা তো তুমিই প্রথম আমাদের বুঝালে। আর তুমি হচ্ছো এই শিল্পের এক মহান শিল্পী। ক্ষুদ্র সামাজিক কিংবা পারিবারিক বন্ধনতো তোমাকে স্পর্শ করার কথা নয়। আজ তুমি এভাবে চলে গেলে সেটা হবে শিল্পের প্রতি চরম অবমাননা। তোমার মত একজন শিল্পী,শিল্পের প্রতি যার প্রতিশ্র“তি চুরান্ত রকমের, তার দ্বারা তো কখনোই এই অবমাননা হতে পারে না।” ঘাড় থেকে রহমতের হাতটা নামিয়ে দিয়ে হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো জাজো- “রহমত, তুমি একজন কথা শিল্পী বটে। তবে ধূর্ত শব্দটি অবশ্যই যোগ করে নিতে হবে। তুমি ঠিকই বলেছ যে আজ আমি শো না করলে সেটা শিল্পের প্রতি অবমাননার শামিল হবে। তবে আমি কিন্তু শুধু শিল্পী নই। আমি একজন পিতাও। পিতা হিসাবে সন্তানের প্রতিও আমার প্রতিশ্র“তি আছে। আজ সন্তানকে এই অবস্থায় রেখে আমি যদি শো করি তাহলে পরবর্তি প্রজন্ম পিতা হিসাবে আমাকে ঘৃণা করবে। একই সাথে তারা ঘৃণা করবে শিল্পের প্রতি আমার প্রতিশ্র“তিকেও। আমি চললাম । আর শোন, দর্শকদের কে সত্যি কথাটাই বলবে। তাদেরকে বলবে আমার মেয়ের জন্য সৃষ্টি কর্তার কাছে দোয়া করতে, আর নিমাইকে বলবে আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে।”

সূর্য অস্ত যাবার কিছু পূর্বেই জয়নাল পৌঁছে গেল। মেয়ের অবস্থা খারাপ দেখে জয়নালের চাচাতো ভাই মোতালেব আগেই মেয়েকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ডাক্তার সাহেব ছুটিতে থাকায় তার অ্যাসিস্ট্যান্টরাই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে কোনরকমে। জয়নালকে দেখে একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল, “মেয়ের অবস্থা কিন্তু খুব একটা ভাল না। দেরিনা করে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান।” মোতালেবের দিকে তাকিয়ে জোরে ক্রন্দন করে উঠলো জয়নাল- “মোতালেব ভাই এখন কি করব বল।” জয়নালের হাত ধরে মোতালেব বলল “কোন চিন্তা করিস না জয়নাল, আমি ব্যবস্থা করতাছি।” জয়নালদের গ্রামটা শহর থেকে খুববেশী দূরে নয়। কিন্তু যাতায়াতের জন্য নৌকা ছাড়া আর কোন মাধ্যমই নেই। একটা কাঁচা রাস্তা আছে যদিও।  এক বছর আগেও ভ্যানে করে শহরে যাওয়া যেত সে রাস্তা ধরে। কিন্তু গত বছরের বন্যার সময় সে রাস্তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট বড় গর্ত। তাছাড়া একটা কাঠের সেতু আছে মধ্যবর্তী স্থানে। সেটাও ঐ বন্যার সময় মাঝখান থেকে ভেঙ্গে দু’টুকরা হয়ে ঝুলে আছে দু প্রান্তরে। ভাটার সময় খালের পানি কমে আসলে সেই ভাঙ্গা সেতু দিয়েই লোকজন এপার থেকে ওপারে যায়। মানুষের দু:খ মানুষ না বুঝলেও এই নির্জীব কাঠের সেতুটা হয়তো বোঝে তা না হলে কবে জোয়ারে ভেসে যেত।

অনেক চেষ্টা করেও কোন ইঞ্জিন বোট জোগাড় করতে পারলনা মোতালেব। আজ কালিকাপুরে হাটবার। তাই গ্রামে যে ক’খানা ইঞ্জিন বোট ছিল সেগুলো মাল বোঝাই হয়ে ঐ হাটে গিয়েছে। রাত দশটা এগারোটার আগে কোনটাই ফিরবে না। একটা নৌকার ব্যবস্থা করে মোতালেব ফিরে এসে বলল, “জয়নাল, অনেক চেষ্টা কইরাও কোন ইঞ্জিন বোট পাইলাম না। চল তাড়াতাড়ি রওনা হই।” এমন সময় জয়নালের বন্ধু মোবারক উর্দ্ধশ্বাসে এসে উপস্থিত হলো। জয়নালকে জড়িয়ে ধরে বলল “চিন্তা করিসনা দোস্ত আল্লাহ সব কিছু ঠিক কইরা দিবে।” মোবারককে দেখেই মোতালেবের মনে পড়লো যে মোবারকের একটা ইঞ্জিন বোট আছে। মোতালেব বলল, “মোবারক, তোমার না ইঞ্জিন বোট আছে।” চোখের কোনায় জমা দু'ফোটা অশ্র“ বিন্দু হাত দিয়ে মুছে মোবারক বলল “দু:খের কথা কি আর কব মোতালেব ভাই! আইজ বিকালেই সেই বোটে চইরা আমার বৌ ছেলে মেয়ে ভাগলপুর গ্যাছে। ভাগলপুরে আমার শ্বশুর বাড়ি। মাস দুই আগেই ওরা ঐ খান থেইকা ঘুইরা আইছে। এখন আবার যাওয়ার কথা না। ক্যান গ্যাছে জানো, জয়নালের জাদু দ্যাখতে । যাই হোক এখন ঐ সব কথা বইলা লাভ নাই। আমার একখান বড় নৌকা আছে। ইঞ্জিনে না চললেও অনেক জোরে চলে। দুইজন শক্ত সমর্থ মাঝি আছে। ওরা টাইনা চইলা যাবে।”

মাঝি দু’জনের শক্তি আছে বটে। বেজায় জোরে তারা দাঁড় টেনে যাচ্ছে যেন ইঞ্জিন বোট। রূপী একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। জয়নাল কয়েক বার কথা বলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু রূপী কোন কথা বলেনি চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল শুধু। স্যালাইন চলছে এখনো। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একজন নার্স এসে নৌকার ভিতরেই ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। আর জয়নালকে শিখিয়ে দিয়েছে স্যালাইন শেষ হলে কি করতে হবে। ছই এর সাথে বাঁধা স্যালাইনের প্যাকেটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জয়নাল। মেয়ের মাথার কাছে বসে দোয়া দরুদ পড়ছিল জয়নালের বৌ শরিফা। পড়া শেষ করে মেয়ের মুখে আর বুকে ফু দিলো। তারপর জয়নালের দিকে তাকিয়ে ক্রন্দনের সুরে বলে উঠলো “আর কতক্ষন।” ছই এর বাইরে বসে থাকা আজিবর বলল, আর মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যেই তারা পৌঁছে যাবে। শরিফার ক্রন্দন বেড়ে গেল- “আমার কিন্তু ভাল লাগতেছে না, মাঝিগোরে কন একটু জোরে বাইতে। হঠাৎ করে শরিফার মধ্যে কি যেন একটা হল। তার ক্রন্দন থেমে গেল, তবে অশ্র“ বন্ধ হলো না। আচমকা দুই হাতে খামচা দিয়ে জয়নালকে ধরে ফেলল সে- “কেমন জাদুকর আপনে? সারা দুনিয়ায় জাদু দ্যাখাইয়া ব্যারান, পক্ষীরাজের মত শূন্যে ঘোড়া নিয়া উড়াল দেন, জ্যান্ত মানুষ কাইটা দুই খন্ড করেন আবার জোড়া লাগান। আইজ মাইয়ায় এই অবস্থায় আপনে কি কিছুই করতে পারবেন না। কি লাভ শূন্যে ঘোড়া নিয়া ভাষাণ দিয়া যদি এই নৌকাডারে একটু জোরে চালাইতে না পারেন, কি লাভ মানুষ কাইটা আবার জোড়া লাগাইয়া যদি নিজের মাইয়ার জীবনটা ধইরা রাখতে না পারেন।” আবার জোড়ে ক্রন্দন করে উঠলো শরিফা। অন্য সময় সময় হলে দৃশ্যমান বস্তু আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্যটা শরিফাকে বুঝিয়ে দিতো সে। কিন্তু সে প্রান  এখন আর তার মনে নেই। ছই এর বাইরে বের হয়ে এলো জয়নাল। দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। এক ফালি চাঁদ আকাশে ভাসছে। কালপুরুষটাও বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আস্তিন গুটিয়ে দুই হাত উপরে তুলল জয়নাল। পিছনে গলুই এর উপরে বসে বিষ্ফোরিত নয়নে আজিবর তাকিয়ে আছে ঐ দিকে।  আসমানে। একি জয়নাল, নাকি জাজো? হয়তো এখনি আসমান বিদীর্ণ করে কালপুরুষের বুক চিড়ে চিঁ-হিঁ রব তুলে বেড়িয়ে আসবে কোন পক্ষীরাজ। একটু নিচু হয়ে ছই এর ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে জয়নাল বলল “শরিফা, আমি আল্লাহর কাছে মেয়ের প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। তুমিও হাত তুলো। তার পক্ষে সব কিছুই করা সম্ভব। তিনি যা করতে চান তাই করতে পারেন। তার উপর পরিপূর্ন বিশ্বাস রাখো।”                           


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top