সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


তিন আমলেও যে অংক মেলেনি : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া 


প্রকাশিত:
২৮ মে ২০২০ ২২:১৩

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২১:০৭

 

৫ই অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর এই দিবসটি শিক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পালন করা হয়। এই দিবসটি পালনে এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল ও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন মূল ভুমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারন করা হয়। যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশার অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।

ভারতে ২০ শতকের গোড়ায় এই দিবসটি পালন করার রীতি শুরু হয় ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন ৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৮৮) তারিখে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই ৫ই অক্টোবর এই দিবসটি পালন করে।

সৈয়দ মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পটি এ প্রজন্ম না পড়লেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী. অর্থমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রীসহ যারা ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সে অবস্থান করছেন তারা প্রত্যেকেই পড়েছেন। অতি পরিচিত এই কালজয়ী গল্পের শেষের কিছু অংশের সঙ্গে আবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এই ‘শিক্ষক দিবসে’।

গল্পের শেষাংশে পন্ডিত মশাই তার ছাত্রদের প্রশ্ন করেন-

“আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আমরা আটজন।

লাট সায়েবের তিন ঠ্যাঙা কুত্তার পিছনে মাসে পঁচাত্তার টাকা খরচ হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়? ” আমি ভয় করছিলুম পন্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকম আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে পঁচিশ টাকা । পন্ডিতমশাই বললেন ‘সাধু, সাধু।’

তারপর বললেন ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধ মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙয়ের সমান? আমি হতবাক। ‘বল না’। আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না সমস্ত ক্লাস নিস্তব্দ। পন্ডিতমশাই হুংকার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’

ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে- কেউ বাদ যায়নি পন্ডিতমশাই আত্ম অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে। যেন উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছেন। (আংশিক)

সৈয়দ মুজতবা আলী যখন এ কাহিনী লিখেছিলেন তখন ব্রিটিশ আমল। পরাধীন দেশ। তারপর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে এখন স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। বদলে গেছে অনেক কিছু। কিন্তু পন্ডিতমশাইদের জীবন এবং জিজ্ঞাসা বদলায়নি। সেদিন মাথা নিচু করে ছাত্ররা অন্তত উপলব্ধি করতে পেরেছিল তার অন্তর্দহন, লজ্জা। কিন্তু আজ সেটুকুও নেই। সেদিন আর কিছু না হোক হুংকার দেবার অধিকার ছিল, আজ তাও নেই।

শত শত বছর ধরে পন্ডিতমশাই অপেক্ষায় আছেন তার শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার। তার শিক্ষার্থীরা দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতি নির্ধারকের আসনে উপবিষ্ট হয়ে দেশ পরিচালনায়, শিক্ষানীতি নির্ধারনে কাজ করেন কিন্তু পন্ডিত মশাইয়ের প্রশ্নের সমাধান দিতে পারেন না।

পৃথিবীর উন্নত দেশের শিক্ষকদের মতো আকাশ চুম্বি বেতন দেওয়ার ক্ষমতা হয়ত আমাদের নেই। কিন্তু যে মর্যাদা একদা শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ ছিল সমাজে তা কি ফিরিয়ে দিতে পারিনা আমরা? ইতিহাস বলে অনেক অত্যাচারী বাদশাও শিক্ষকের সম্মূখে শ্রদ্ধায় অবনত শিরে দাঁড়াতেন। পরাধীন ব্রিটিশ আমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত আমাদের অর্জন শিক্ষকের অপমান, অসম্মান। জনপ্রতিনিধিদের রক্তচক্ষু, লেখাপড়া না জানা সভাপতির দাদাগিরি।

শিক্ষকের সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্য, শিক্ষকের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা কি রাষ্ট্র নিতে পারেনা? হয়ত বলা হবে, সরকারি শিক্ষকদের জন্য শিক্ষা এবং চিকিৎসা ভাতার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সে ভাতা তো কামান চাইলে পিস্তল দেবার মতো।

পাদটিকা গল্পের পন্ডিত মশাই এদেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের প্রতিনিধিত্ব করছে আজও। লাট সাহেবদের সংখ্যাও বেড়েছে সমাজে। নিজ অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির মতো বিশাল কাজ আমরা করতে পারি অথচ শত শত বছরের বঞ্চনা আর লজ্জা মুছে দিয়ে আমরা গুরুর সম্মান, গুরুর উন্নত জীবন মান প্রতিষ্ঠিত করে একটি উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের বিশ্বে তুলে ধরতে পারি না।

মা-বাবা জন্ম দেয় আর শিক্ষক মানুষ করে গড়ে তোলেন। একজন মানুষের জীবনে শিক্ষকের স্থান কোথায় এবং কী, তা উপলব্ধি করুক সমাজ, রাষ্ট্র এবং শিক্ষক নিজেও। এ প্রত্যাশাই রইল।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top