সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


উয়েফা ইওরোপীয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ ‘২০২০’,  একটি সমীক্ষা : পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২১ ২০:৪৭

আপডেট:
১৫ জুন ২০২১ ২০:৫২

 

১) প্রতীক্ষার অবসান :

অবশেষে স্বস্তি, উয়েফা ইওরোপীয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, যেটি  কি না, ‘ইওরো কাপ’ হিসেবেই অধিক পরিচিত, সেই ‘ইওরো ২০২০,’ যা করোনা আবহে, পিছিয়ে গিয়ে কার্যত ‘ইওরো ২০২১’-এ পরিণত হয়েছে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ১১ই জুন। টুর্নামেন্টের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবার নজিরবিহীন ভাবে-আজারবাইজান, ডেনমার্ক, রাশিয়া, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, রোমানিয়া, ইটালি, জার্মানি, হাঙ্গারি, নেদারল্যান্ডস এবং স্পেন মোট ১১টি আয়োজক দেশে হতে চলেছে এই প্রতিযোগিতা। আদতে আয়োজক দেশের সংখ্যা ছিল ১৩টি। বেলজিয়ামের ব্রাসেলস শহরের ইওরো কাপ স্টেডিয়াম  তৈরির  কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় এবং আয়ার্ল্যান্ডের ডাবলিন শহরে দর্শকদের মাঠে গিয়ে খেলা দেখার ব্যাপারে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ায় এই দু’টি দেশকে আয়োজকদের তালিকা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যশালী ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে দুটি সেমিফাইনাল এবং ১১ই জুলাইয়ের ফাইনাল।

 

২) গ্রুপ বিন্যাস :

২৪টি দলকে নিম্নলিখিত ৬টি গ্রুপে ভাগ করে খেলা হবে গ্রুপ লীগের ম্যাচগুলি।

গ্রুপ এ : ইটালি, সুইৎজারল্যান্ড, টার্কি, ওয়েলস
গ্রুপ বি : বেলজিয়াম, রাশিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড
গ্রুপ সি : ইউক্রেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, উত্তর ম্যাসেডোনিয়া
গ্রুপ ডি : ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, চেক রিপাবলিক, স্কটল্যান্ড
গ্রুপ ই : স্পেন, পোল্যান্ড, সুইডেন, স্লোভাকিয়া
গ্রুপ এফ : জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগাল, হাঙ্গারি

৬টি গ্রুপের প্রথম স্থানাধিকারী ২টি দল এবং সেরা ৪টি তৃতীয় স্থানাধিকারী দল, মোট ১৬টি দল জায়গা করে নেবে নকআউট পর্যায়ে। মোট প্রাপ্ত পয়েন্ট ছাড়াও প্রয়োজনে গোল পার্থক্য, বেশি গোল করা,

নকআউট পর্যায়ে উন্নীত হতে এইসবই বিবেচিত হবে। একাধিক দলের পয়েন্ট সমান হলে, দলগুলির পারস্পরিক ম্যাচের ফলাফল, সেই ম্যাচগুলির গোল পার্থক্য এবং সেইসব ম্যাচে কোন দল বেশি গোল করেছে বিবেচ্য হবে। আরও কিছু সূক্ষাতিসূক্ষ নিয়ম প্রয়োজনে বিবেচনায় আসতে পারে, বিস্তারিত বর্ণনায় লেখা দীর্ঘায়িত না করে এখানেই ইতি টানলাম।

সমস্ত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই একটি গ্রুপ অফ ডেথ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। এবারে গ্রুপ, ‘এফ’কে নি:সন্দেহে গ্রুপ অফ ডেথ আখ্যা দেওয়া চলে। গতবারের ইওরো কাপ চ্যামপীয়ন পর্তুগাল, গতবারের রানার্স আপ এবং বর্তমানে বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স এবং প্রাক্তন বিশ্বকাপ ও ইওরো কাপ জয়ী জার্মানি এই গ্রুপে পরস্পরের মুখোমুখি হবে। এদের যে কেউ ছিটকে গেলে সেটা হবে ইন্দ্রপতনের সমতুল্য, টুর্নামেন্টের ফরম্যাট অনুযায়ী মহাশক্তিধর এই তিন দেশই নকআউট স্টেজে যেতে পারে, সেটাই আশার কথা।

 

৩) সম্ভাব্য বিজয়ী :

ইওরো কাপ বিশ্বের অন্যতম কঠিন প্রতিযোগিতা, এখানে একটি ম্যাচও সহজ নয়। ইওরো কাপের চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতেই কালঘাম ছুটে যায়। বিশ্বকাপ জয়ী দেশগুলোও ইওরো কাপের মূলপর্বে কোয়ালিফাই করতে পারেনি, সেই নিদর্শনও আছে।

এই মুহূর্তের শক্তি এবং ফুটবল ঐতিহ্যর বিচারে-নেদারল্যান্ডস, ইটালি, ইংল্যান্ড, স্পেন, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, জার্মানি এবং ফ্রান্স; এই  আটটি দেশকে ইওরোপের সবথেকে শক্তিশালী বলে গণ্য করা যায়। আমরা এই আটটি দেশের দলীয় গভীরতার ওপর ভিত্তি করে, প্রতিযোগিতার সম্ভাব্য বিজয়ীকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করব।

এই তালিকায় গত বিশ্বকাপ ফাইনালের বিজিত দেশ, ‘ক্রোয়েশিয়া’কে রাখা গেল না।

আটটি দলের সম্ভাব্য প্রথম একাদশের নামের ক্ষেত্রে আমরা ইংরীজি নাম ব্যবহার করব, বিদেশী নামের বাংলা উচ্চারণে জটিলতা এড়াতেই এই সিদ্ধান্ত।

৪) বাছাই দলগুলির সম্ভাব্য প্রথম একাদশ ও অতি সংক্ষেপে শক্তির গভীরতা বিশ্লেষণ :

নেদারল্যান্ডস-
Goal-Krul
Defence-Dumfries, De Ligt, De Vrij, Van Aanholt
Midfield-De Jong, Gravenberch, Wijnaldum(Van de Beek)
Attack-Berghuis, Depay, L.De Jong

নি:সন্দেহে দারুণ শক্তিশালী রক্ষণ ভাগ। মাঝ মাঠে দুরন্ত ভারসাম্য, কিন্তু আক্রমণভাগ দুর্বল। ক্রুয়েফ, বাস্তেন, বার্গক্যাম্প, ভ্যানপার্সির উত্তরসূরীরা তাদের বর্ণময় অতীতের মহাতারকা স্ট্রাইকারদের ছায়া মাত্রও নন। আট দলের মধ্যে তাই নেদারল্যান্ডসকে সবথেকে পিছনে রাখব।

ইটালি-
Goal-Donnarumma
Defence-Florenzi, Bonucci, Chiellini, Emerson
Midfield-Jorginho, Verratti  (Pellegrini), Barella
Attack-Chiesa, Insigne, Immobile (Belotti)

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন ইটালি এবারের ইওরোকাপে সবাইকে চমকে দিতে পারে। কিন্তু ইটালির রিজার্ভ বেঞ্চ তেমন শক্তিশালী নয়, এতে টিমের গভীরতা নষ্ট হবে। বিখ্যাত Bonucci, Chiellini জুটি আজ বয়স ভারাক্রান্ত। জুভেন্টাস তারকা Chiesa দুরন্ত ফর্মে আছে, Immobile এবং তার বদলি Belotti গোল করার ক্ষমতা রাখলেও তারা বাজ্জিও, দেল পিয়ারো, রোসি নন। সব মিলিয়ে ইটালিকে সাত নম্বরে রাখাই যুক্তিযুক্ত হবে।

ইংল্যান্ড-
Goal-Pickford
Defence-Walker, Maguire, Stones, Chilwell
Midfield-Rice, Henderson, Mount (Grealish)
Attack-Saka (Rashford), Folden (Sterling), Kane

দারুণ দল হলেও ধারাবাহিক ভাবে  এই মাঝমাঠ ফরোয়ার্ডদের বল সরবরাহ করতে পারবে কি না তা, Mount অথবা Grealish যেই প্রথম দলে খেলুন না কেন তাতে সন্দেহ আছে, সেই অভিজ্ঞতার তাদের ঘাটতি আছে। আর একটি বড়ো সমস্যা Kane-এর পরিবর্ত স্ট্রাইকারের অভাব, যা দীর্ঘ প্রতিযোগিতায় ইংল্যান্ডেকে ভোগাতে পারে। ইংল্যান্ডকে তাই ছয় নম্বরে রাখব।

স্পেন-
Goal-De Gea
Defence-Llorente, Torres, Laporte, Alba
Midfield-Busquets (Rodri),  Alcantara, Koke
Attack-Trarore, Oyarzabal, Morata

অতীতের স্পেন দলের তুলনায় ধারে ভারে কম হলেও স্পেনকে সবসময় হিসেবে রাখতে হবে। অধিনায়ক Busquets এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্ত, তিনি না খেলতে পারলে স্পেন বিরাট ধাক্কা খাবে। Morata স্পেনের আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম কি না তা নিয়ে সমর্থকরাও দ্বিধায় আছেন। সব মিলিয়ে স্পেনকে পঞ্চম বাছাই ধরা যায়।

বেলজিয়াম-
Goal-Courtois
Defence-Meunier, Alderweireld, Denayer, Vertonghen
Midfield-Witself, Tielemans, Carrasco
Attack-De Bruyne, Hazard, Lukaku

দারুণ মাঝমাঠ, স্বপ্নের আক্রমণ ভাগ নিয়ে বেলজিয়াম পৃথিবীর যেকোনও রক্ষণকে ছিঁড়ে খেতে পারে। কিন্তু তাদের নিজেদের রক্ষণও দুর্বল, এই রক্ষণ নিয়ে ইওরো কাপ জেতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। অভিজ্ঞ গোলরক্ষক Courtois কতটা সেই ফাঁক ফোকর ভরাট করতে পারেন সেটাই দেখার। বাছাই তালিকায় চতুর্থ স্থানে থাকবে বেলজিয়াম।

পর্তুগাল-
Goal-Patricio
Defence-Cancelo, Pepe, Dias, Guerreiro
Midfield-Pereira, Neves, Fernandes
Attack-Bernardo Silva(Felix), Jota, Ronaldo

এই পর্তুগাল দলের ভারসাম্য গতবারের বিজয়ী দলের থেকে অনেক বেশি। দুরন্ত রিজার্ভ বেঞ্চ। পর্তুগাল অতীতের মতো আর সর্বসময়ে অধিনায়ক রোনাল্ডোর ওপর নির্ভরশীল নয়। তবু তিনি আছেন, বয়স তাঁকে ছুঁতে পারেনি, তিনি মহাতারকা, রাজা রোনাল্ডো এইসব বিরাট মঞ্চেই ঝলসে উঠতে ভালোবাসেন, সুতরাং সাধু সাবধান। CR7 ফ্যাক্টর এবারও বিপক্ষ কোচেদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে। পর্তুগালকে সব মিলিয়ে তিন নম্বর স্থানে রাখতেই হচ্ছে।

জার্মানি-
Goal-Neuer
Defence-Hummels, Suler, Rudiger
Midfield-Klostermann, Kroos, Kimmich, Gosens,
Attack-Sane, Muller(Gnabry), Werner

জার্মানি অনায়াসে দুটো দলকে এই প্রতিযোগিতায় নামাতে পারে, এতটাই তাদের দলের গভীরতা। দৃশ্যতই জার্মানি, গোলরক্ষক Neuer এর সামনে তিন ডিফেন্ডারকে রেখে রক্ষণ আঁটোসাঁটো করে নামবে। বাছাই আট দলের মধ্যে একমাত্র তারাই তিন ব্যাকে খেলবে বলে মনে করা হচ্ছে, এই পদ্ধতিতে দুই উইং হাফ তেল খাওয়া মেশিনের মতো আক্রমণ ও রক্ষণে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে। জার্মানিকে এই প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় বাছাই বলা যেতেই পারে।

ফ্রান্স-
Goal-Loris
Defence-Pavard, Varane, Kimpembe, Hernandez
Midfield-Kante, Pogba, Griezmann
Attack-Coman (Dembele), Mbapee, Benzema(Giroud)

ফ্রান্স কাদের দেশে রেখে এসেছে, সেই  তালিকায় চোখ বোলালেই বোঝা যাবে তারা কতটা শক্তিশালী। Martial, Lacazette, Mendy, Theo Hernandez সহ একঝাঁক তারকা দলে ঢুকতেই পারেননি। বেশিরভাগ অন্য দলে এঁরা হাসতে হাসতে ঢুকে পড়বেন। ফ্রান্সের দুর্গে সামান্য ছিদ্র খুঁজে পাওয়া এই মুহূর্তে অসম্ভব মনে হচ্ছে। নি:সন্দেহে ফ্রান্স এই প্রতিযোগিতার রেড হট ফেভারিট।

দলেগুলির ফর্মেশন দেখে, বেশিরভাগ দল ৪-৩-৩ পদ্ধতিতে খেলবে ভাবলে ভুল হবে। বিপক্ষ দলের শক্তি ও দুর্বলতা যাচাই করে একজন ফুটবল ম্যানেজার তার স্ট্র্যাটেজি ঠিক করবেন, ম্যাচের মধ্যেও তার পরিবর্তন হবে।

আর এইসবই হল কাগজে কলমের হিসেব। ফুটবল খেলাটা কিন্তু হবে মাঠে, এগারোজনের বিরুদ্ধে এগারোজনের, দুই ধুরন্ধর ফুটবল ম্যানেজারের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের। কোনও গোলরক্ষকের একটি দুর্দান্ত সেভ, কারও দুরন্ত একক দক্ষতায় করা গোল, কোন ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেবে তা কেউ বলতে পারে না। এই হিসেব নিকেশকে তাই একটি সম্ভাবনা বলাই সঙ্গত। আটটি বাছাই দল ছাড়াও রয়েছে টুর্নামেন্টের কালো ঘোড়া, ‘টার্কি।’

যদিও প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী খেলায় টার্কি ০-৩ গোলের ব্যবধানে ইটালির কাছে হেরে গিয়ে বড়ো ধাক্কা খেয়েছে। এমনকী ডেনমার্ক, রাশিয়া, ক্রোয়েশিয়াকেও একেবারে উড়িয়ে দিলে বিরাট ভুল হয়ে যাবে। আসলে ইওরো কাপের মতো কঠিন মানের প্রতিযোগিতায় যে ২৪ টি দল চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তাদের কাউকে হেলাফেলা করা যায় না। ইওরো কাপের ইতিহাস বলছে, অতীতে চেকোস্লোভেকিয়া (তৎকালীন), গ্রীস, ডেনমার্কের মতো দল সব হিসেব উল্টে দিয়ে ফেভারিটদের পর্যদুস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

ফিরে দেখা যাক তিনটি ঘটনাবহুল এবং স্মরণীয় ইওরো কাপ জয়ের ঘটনাকে, যেখানে আন্ডারডগ দেশ সব হিসেব উল্টে দিয়ে প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেছিল।

১৯৭৬-চ্যাম্পিয়ন দেশ-‘চেকোস্লোভেকিয়া’ :

একটু দ্বিধায় ছিলাম, এই তালিকায় ১৯৭৬-এর বিজয়ী চেকোস্লোভেকিয়াকে রাখব কি না! কারণ তখনকার প্রতিযোগিতার ফর্ম্যাট অনুসারে যুগোস্লাভিয়ায় অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় মাত্র চারটি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল। এই ফর্ম্যাটে এটিই ছিল শেষ ইওরো কাপ। কিন্তু নানা কারণে ইওরো কাপের ইতিহাসে ১৯৭৬ এর প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অপরিসীম।

আয়োজক দেশ যুগোস্লাভিয়া ছাড়া বাকি তিনটি দেশ ছিল তৎকালীন বিশ্ব ও ইওরো কাপ জয়ী পশ্চিম জার্মানি, নেদারল্যান্ডস এবং চেকোস্লোভেকিয়া। ১৯৭৬-এর প্রতিযোগিতাতেই শেষবারের মতো আয়োজক দেশকে প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়েছিল, ১৯৮০ থেকে আয়োজক দেশ সরাসরি ইওরো কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। যদিও এবারের ১১ টি আয়োজক দেশের সকলে এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে নেই, উয়েফা ইওরো কাপের ৬০ বৎসর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই ব্যতিক্রম। এবারের প্রতিযোগিতায় সব দেশকেই যোগ্যতা অর্জনকারী পর্বের বাধা টপকাতে হয়েছে।

১৯৭৬-এর প্রতিযোগিতার ম্যাচ সংখ্যাও ছিল চারটি। দুটি সেমিফাইনাল, একটি তৃতীয় স্থান নির্ণায়ক ম্যাচ এবং অপরটি অবশ্যই ফাইনাল। চারটি ম্যাচই নির্ধারিত সময়ে অমীমাংসিত থাকার ফলে, হয় অতিরিক্ত সময়ের গোলে, নয়তো টাইব্রেকারে মীমাংসা হয়েছিল। যা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে যা আর কখনও ঘটেনি। ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ের পরে খেলার ফল ২-২ থাকার পরে তৎকালীন চেকোস্লোভেকিয়া টাইব্রেকারে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এই দুই দেশেরই বর্তমানে অস্তিত্ব নেই। চেকোস্লোভেকিয়া বর্তমানে চেক রিপাবলিক ও স্লোভাক রিপাবলিক নামক দু’টি দেশে বিভক্ত আর পশ্চিম জার্মানি পূর্ব জার্মানির সঙ্গে মিশে গিয়ে অখণ্ড জার্মানিতে পরিণত হয়েছে। ধারে ভারে অনেক এগিয়ে থাকা সেইসময়ের বিশ্ব ও ইওরোপ চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে চেকোস্লোভেকিয়ার জয় নিশ্চয়ই আন্ডারডগ দেশের জয় হিসেবে গণ্য করা যায়, হোক সে চার দেশের প্রতিযোগিতা। ১৯৭৬-এর ফাইনাল আর একটি কারণে ফুটবল ইতিহাসে  চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। চেকোস্লোভেকিয়ার, ‘Antonin Panenka’ অসাধারণ চিপ করে মারা পেনাল্টি থেকে ফাইনালের জয়সূচক গোলটি করেন। তারপর থেকে এই ধরনের সূক্ষ্ম পেনাল্টি শটকে, ‘Panenka’ পেনাল্টি শটের আখ্যা দেওয়া হয়। ফুটবল অভিধানে, ‘Panenka’ শব্দটি সেই থেকে চিরস্থায়ী আসন দখল করে বলাই সঙ্গত হবে।

 

১৯৯২ : চ্যাম্পিয়ন দেশ-‘ডেনমার্ক’

সুইডেনে অনুষ্ঠিত ১৯৯২-এর ইওরো কাপ আর একটি ঘটনাবহুল প্রতিযোগিতা। ১৯৯২ আট দলের ফরম্যাটের শেষ ইওরো কাপ, ১৯৮০ থেকে আট দলের ফরম্যাটে প্রতিযোগিতা চলছিল।

এই বছরেই শেষবারের মতো বিজয়ী দলকে দুই পয়েন্ট দেওয়া হয়েছিল, ১৯৯৬-এর প্রতিযোগিতা থেকে বিজয়ী দলকে তিন পয়েন্ট দেওয়ার রীতি চালু করা হয়। ১৯৯২-এর ইওরো কাপ পুরনো ব্যাকপাস প্রথা মেনে খেলা শেষ ইওরোপীয়ান ফুটবল প্রতিযোগিতা, এই প্রথায় কোনও ফুটবলার পা দিয়ে ব্যাকপাস করলেও গোলরক্ষক হাত দিয়ে বল ধরতে পারতেন, পরবর্তী সময়ে এই প্রথা বাতিল হয়ে যায়, বর্তমানে হেড করে বা শরীরের অন্য অংশের সাহায্যে খেলোয়াড়রা ব্যাকপাস করলে গোলরক্ষক হাত দিয়ে বল ধরতে পারেন, কিন্তু কেউ পায়ের সাহায্যে  ব্যাকপাস করলে গোলরক্ষককে হাত দিয়ে বল ধরতে পারেন না, তাকেও তখন পায়ের সাহায্যে খেলতে হয়,

নতুবা রেফারি বিপক্ষ দলকে ফ্রি কিক দিয়ে দেবেন।

১৯৯২-এ সবাইকে চমকে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ডেনমার্ক, তারা আদতে সেই বছরে চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি, আসল যোগ্যতা অর্জনকারী যুগোস্লাভিয়াকে গৃহযুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে উয়েফা বাতিল করে দিলে ডেনমার্ক সেই জায়গায় খেলার সুযোগ পায় এবং সমস্ত হিসেব উল্টে দিয়ে একের পর এক অঘটন ঘটিয়ে ১৯৯০-এর বিশ্বকাপ বিজয়ী জার্মানিকে ফাইনালে, Jensen এবং Vilfort-এর করা জোড়া গোলে ২-০ তে হারিয়ে কাপ জিতে নেয়। নি:সন্দেহে ইওরো কাপের ইতিহাসে এটি বৃহত্তম অঘটনের ঘটনা।

১৯৯২-এর ইওরো কাপ, পশ্চিম এবং  পূর্ব জার্মানি মিশে যাওয়ার পরে সংযুক্ত জার্মানির খেলা প্রথম আম্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা।

১৯৯২-এর ইওরো কাপে আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের,’ ‘কমনওয়েলথ অফ ইনডিপেনডেট স্টেটস’ (CIS) নামে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলেও, প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তারা CIS ব্যানারে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।

২০০৪ : চ্যাম্পিয়ন দেশ-‘গ্রীস’

১৯৯৬ আর ২০০০-এর মতো,

পর্তুগালে অনুষ্ঠিত ২০০৪-এর ইওরো কাপও ছিল ১৬ দলের প্রতিযোগিতা।

গ্রীস চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেই ফুটবল বিশ্বকে যথেষ্ট চমকে দিয়েছিল, কেন না গ্রীসের আন্তর্জাতিক ফুটবলে সাফল্য বলতে ছিল, ১৯৮০-এর ইওরো কাপ এবং ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপের মূল পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জন করা, এই দুই প্রতিযোগিতাতেই তারা একটিও ম্যাচ জিততে না পেরে বিদায় নেয়, তাই ২০০৪-এর ইওরো কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে তারা যখন আয়োজক দেশ পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে দেয়, তখন গ্রুপ লীগের এই ম্যাচটিকে বিশেষজ্ঞরা ফ্লুক বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কোয়ার্টার ফাইনালে যখন গ্রীস ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিল, তখনও ফুটবল বোদ্ধারা অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, এ যেন ধনী আত্মীয়ের বাড়িতে অনাহূত দরিদ্র আত্মীয়ের পাত পেড়ে খেতে আসা। এই বোদ্ধারা ভুলে গেছিলেন গ্রীস ততক্ষণে প্রথমবার কোনও দল হিসেবে প্রতিযোগিতার আয়োজক এবং চ্যাম্পিয়ন দলকে পরাজিত করেছিল।ওদিকে প্রথম ম্যাচে গ্রীসের কাছে হারের ধাক্কা সামলে নিয়ে পর্তুগাল, তাদের মহাতারকা অধিনায়ক, ‘লুইস ফিগো’ এবং তরুণ তুর্কি, ‘ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর’ দাপটে একটার পর একটা বাধা টপকে পৌঁছে গেল ফাইনালে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল সেই অনাহূত গ্রীস। সম্ভবত গ্রীসের অতি বড়ো সমর্থকও ভাবেননি তাদের দল পর্তুগালকে দ্বিতীয়বার হারাতে পারবে, কিন্তু সেই অঘটনই ঘটল, ম্যাচের ষাট মিনিটের মাথায় কর্ণার কিক থেকে হেড করে গোল করে যান গ্রীসের,  ‘Angelos Charisteas.’ একটার পর একটা আক্রমণের ঢেউ তুলেও পর্তুগাল সেই গোল শোধ করতে পারেনি।

তাই বলছিলাম না, কাগজ কলমের হিসেব সবসময় ইওরো কাপের মতো প্রতিযোগিতায় চলে না, অঘটন ঘটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।

 

উপসংহার :

এই করোনা কালে, অতিমারিকে আলোচনার বাইরে রেখে কোনও উপসংহারই টানা সম্ভব নয়। আমরা গত এক বছর ধরে এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, ইওরোপীয়ান ফুটবলও তার বাইরে নয়। বারংবার ইওরোপের বিভিন্ন দেশের লীগগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, ফুটবলাররা অনুশীলন অবধি করতে পারেননি, বহু খেলোয়াড় এবং সাপোর্ট স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, প্রাণ হারিয়েছেন কেউ কেউ। দর্শক শূন্য স্টেডিয়ামে খেলতে হয়েছে তারকা ফুটবলারদের। বলা যেতেই পারে, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ইতিহাসের কঠিনতম ফুটবল মরসুম। এখন ভ্যাকসিনের কল্যাণে ইওরোপ অনেকটাই করোনা মুক্ত। দর্শকরা মাঠে এসে তাদের প্রিয় তারকাদের খেলা দেখতে পাবেন, ফুটবলের হাত ধরে জীবন ফিরে পাবে তার ছন্দ। আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষেরা খুব স্বস্তিতে নেই, অনেক প্রাণ চলে গেছে। কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ, ভ্যাকসিনেসন  খুব মসৃণ গতিতে চলছে বলা যায় না। তবুও ইওরো কাপ অনেক ‘নেই’-এর মধ্যে মানুষকে যদি একটু আনন্দ দিতে পারে তবে সেটুকুই লাভ।

 

পরমার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিম বঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top