বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানে আতংঙ্কিত অভিবাসীরা
প্রকাশিত:
২০ নভেম্বর ২০১৭ ০৭:৩৬
আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:৪০
আউয়াল খান: মাত্র কিছু দিন পূর্বে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল নির্বাচনে আশাতীত ভাবে ভালো ফল করে কট্রর অভিবাসনবিরোধী ওয়ান নেশন পার্টি। শুধু তাই নয় নির্বাচনে জয়লাভের পর দলটির প্রধান পলিন হ্যানসন তার উদ্বোধনী সিনেট ভাষনে বলেন “অস্ট্রেলিয়া মুসলিমে প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে।” তিনি আরো বলেছিলেন “আমরা আজ মুসলিম সম্প্রদায় ও সামাজিক গোষ্টীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় বিপদগ্রস্হ”.
অস্ট্রেলিয়ানদের কে মুসলমানদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে কোন রকম প্রমান ছাড়াই দাবি করেন যে অস্ট্রেলিয়া সংগঠিত অপরাধের হার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে বেশি।তিনি অভিবাসন নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ান মুসলিমদের দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেন ‘আপনারা যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে যান’।
এই বিতর্কের পর একটি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াতে “মুসলিম অভিবাসন নিষিদ্ধের ব্যাপারে” সাধারন অস্ট্রেলিয়ানদের মতামত নেওয়া হয়। তাতে অবিশ্বাস্যভাবে দেখা যায় যে প্রায় অর্ধেক অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম অভিবাসন নিষিদ্ধের পক্ষে। জরিপের এক তৃতীয় অংশ অস্ট্রেলিয়ান মনে করেন মুসলিম অভিবাসীরা তাদের মূল সমাজের সাথে একীভূত নয়।
মুসলিম বা অভিবাসীদের ব্যাপারে ভীতি যে শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই তৈরি হয়েছে তা নয়, এই ধারার বিস্তার লাভ করেছে ইউরোপ, আমেরিকা সহ উন্নত বিশ্বের প্রায় সব স্থানে। পরিস্হিতি এতটাই ভয়াবহ যে মূলধারার রাজনীতির প্রধান দলগুলো বাধ্য হচ্ছে কথিত ডানপ্থায় ঝুঁকে ভোট ব্যাংক বাড়াতে। আর তার সর্বশেষ উদাহরন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যিনি প্রকাশ্যে বিদ্বেষমূলক, অভিবাসী বিরোধী, বর্ণবাদী ‘জনপ্রিয়’ প্রচারণার জোরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হলেন । আর অভিবাসন নীতি নিয়ে ইউরোপের সাথে বিরোধের জোরে ব্রিটিশ নাগরিকরা ব্রেক্সিট পক্ষে ভোট দিলেন। উত্থান ঘটল বর্ণবাদী নেতা নাইজেল ফারাজের।
ধারনা করা হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব,বেকারত্বের মতো আর্থিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে মাথাচাড়া দিচ্ছে এই উগ্র মতবাদ। যেমন গ্রিসের গোল্ডেন ডন , সংসদে যাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। ডেনমার্কের ড্যানিশ পিউপিলস পার্টিও গত বছরের নির্বাচনে ২১ শতাংশ আসন লাভ করে। আর অস্ট্রিয়ায় এ বছরের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে তো অল্পের জন্য জয়ী হতে পারেনি ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টি অব অস্ট্রিয়া (এফপিও)।এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলোতে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে এই মতাদর্শের দলগুলো, যেমন ইতালির লিগা নর্ড, সুইস পিউপিল’স পার্টি, নিউ-নাজি পিউপলস পার্টি আওয়ার স্লোভাকিয়া, ইংলিশ ডিফেন্স লিগ, অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি।
তবে একথাও ঠিক সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিস্তারের কারণেও একধরণের আতঙ্ক কাজ করছে। যেমন ফ্রান্সের প্যারিস হামলার পর ২০১৫ সালের আঞ্চলিক নির্বাচনে ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট ২৭ শতাংশ জনপ্রিয় ভোট লাভ করে। ১৯৭২ সালে দলটি গঠিত হওয়ার পর এটায় তাদের সবচেয়ে ভালো ফল।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে যে, দেশটিতে মুসলমানদের ওপর ঘৃণাজনিত হামলার মত অপরাধের পরিমাণ গত এক বছরে ৬৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে গত বছর পর্যন্ত মুসলমানদের ওপর ঘৃণাজনিত অপরাধের রেকর্ড পর্যালোচনা করে এফবিআই এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানদের ওপর এধরনের হামলার ঘটনা ঘটে ৫ হাজার ৪৭৯টি, এক বছরেই এ হার ৬ দশমিক ৭ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে গত বছর হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৮৫০টি। অথচ বিগত ২০০০ সালে এধরনের হামলার ঘটনা ছিল অতি নগন্য। বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত মার্কিন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এধরনের হামলার ঘটনা আরও বেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অস্ট্রেলিয়ার চিত্র খুব বেশি আশাব্যাঞ্জক নয়। গত বছর ওয়েষ্টার্ন সিডনি ও চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামিক সাইন্স এন্ড রিসার্চ একাডেমীর যৌথ জরিপে জানা সাধারণ একজন অস্ট্রেলিয়ানের তুলনায় একজন মুসলিম অস্ট্রেলিয়ান তিনগুন বেশি বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। জরিপে অংশগ্রহনকারী ৫৭ শতাংশ বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছে। শতকারা ৬২ মুসলিম অস্ট্রেলিয়ান চাকুরী খোজার সময় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়েছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্য বেকারত্বের হার ৮.৫ যা জাতীয় বেকারত্বের হার থেকে দুই গুনের ও বেশি।
শুধুমাত্রই যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর যে, ব্ণ বৈষম্যে বা আক্রমনের স্বীকার হচ্ছে তা নয়। ভারতীয় ও এশিয়ান বংশোদ্ভূত অনেক অভিবাসীর দাবী তারা ও ব্ণ বৈষম্যে বা আক্রমনের স্বীকার হচ্ছেন।
বিজ্ঞ মহলের মনে করে ট্রাম্প, পলিন হ্যানসন, নাইজেল ফারাজ, ম্যারি লো পেন এর মূলমন্ত্র হচ্ছে বর্ণবাদী ভয়। ভোটের রাজনীতির ফলাফল নিজের পক্ষে আনার জন্য এই সময়ের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকারী অস্ত্র হচ্ছে এটি। ভয়ের পরিসংখ্যান ছড়িয়ে দিয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করলে বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘৃনার বিষ বাস্প। ওলোট পালোট করে দিচ্ছে যুগ যুগ ধরে চলা বহুজাতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। আর এই বর্ণবাদী রাজনীতির সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্হ সারা বিশ্বের কয়েক কোটি অভিবাসী । অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের এই ক্রমবর্ধমান উত্থান যে,অধিকাংশ অভিবাসীদের দুঃচিন্তার ও আতংকের কারন হবে এই কথা এখন নিশ্চিত করে বলা যায়।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: