সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

ইমিনিয়্যুন সিস্টেম এবং গ্রাম ও বস্তিবাসীর কথা : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
১৮ জুলাই ২০২০ ২১:১৩

আপডেট:
৭ আগস্ট ২০২০ ০০:১২

 

করোনা বিভীষিকায় বিপর্যয়ে সারা পৃথিবী কাঁপছে। বাংলাদেশও করোনা প্যান্ডমিকে অনেকটাই বেসামাল। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৩ জন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২ হাজার ৪২৪ জন। নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ১৬৩ জন। মোট শনাক্ত ১ লাখ ৯০ হাজার ৫৭। সুস্থ ১ লাখ ৩ হাজার ২২৭ জন।
আসুন এ পর্যায়ে জেনে নিই ইমিনিয়্যু সিস্টেমটা কী? আমাদের শরীরে বাইরে থেকে ঢুকে পড়া ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে লড়াইটা করে শ্বেত রক্তকণিকা। আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই শ্বেত কণিকা তৈরি করে, সঞ্চয় করে রাখে এবং দরকারের সময় ছেড়ে দেয় রক্তস্রোতে। স্বাভাবিকভাবেই যার প্রতিরোধী শক্তি যত সবল, তিনি তত কম ভোগেন।
প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা, তার চেয়েও বড়ো রহস্য হচ্ছে আমাদের প্রতিরোধক্ষমতা। বাইরে থেকে দেখে বোঝা সম্ভব নয় যে আপনার রোগ প্রতিরোধ কতটা শক্তিশালী, তাই তা বাড়ল না কমলো, সেটাও জানা কঠিন।
একটা বড় কথা আপনাকে অ্যাকটিভ থাকতে হবে, বাড়ির ভিতরেও হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। দেখতে হবে যেন রক্তে বাড়তি চিনি না থাকে, ফ্যাটের বোঝা না বাড়ে। রক্তচাপ স্বাভাবিক হওয়া দরকার, হরমোনের স্তরে গোলমাল হলেও চলবে না। আর এ সব ঐশ্বর্য যাদের থাকে, সাধারণত দেখা যায় তারা রোগব্যাধির সঙ্গে সহজে লড়াইও করতে পারেন।
নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীর মধ্যে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কম—এমনটাই বলছেন এসংক্রান্ত কাজে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা। কেন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বহিঃপ্রকাশ কম দেখা যাচ্ছে সে বিষয়টি নজরে এসেছে তাঁদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়টি রহস্যজনক। এ রহস্য উদ্ঘাটন করতে গবেষণা জরুরি।
তবে এ কথা সত্য যে, এ দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোকে রক্ষা করেছে তাদের অ্যান্টিবডি। প্রাকৃতিক নিয়মেই তারা তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমন একটি পর্যায়ে তৈরি করে রেখেছেন, যেখানে করোনাভাইরাস আক্রমণ করে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। অনেকের মতে, প্রতিরোধ ক্ষমতাই রক্ষা করেছে এসব হতদরিদ্র মানুষকে। অন্যথায় তারা যেভাবে জীবনযাপন করে তাতে সর্বপ্রথম তারাই আক্রান্ত হতেন এবং মৃত্যুঝুঁকিতে পড়তেন। কিন্তু তা হয়নি।

তথ্যমতে, এ মুহূর্তে দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। এসব বস্তিবাসী ও ভাসমান খানাগুলোর গড় সদস্য ৩ দশমিক ৭৫ জন করে। এসব বস্তির বাসিন্দা ও ভাসমান মানুষের অনেকেরই কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকলেও এ নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে ঠিকই। তারা জানেও না কোনো পরিস্থিতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। যেখানে ছোট আয়তনের ঘিঞ্জি ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে বসবাস করছে কয়েকজন মানুষ।
গ্রামের মানুষের বেলায়ও একই কথা খাটে হোম কোয়ারেন্টিন প্রয়োগের আলাপ সেখানে বাতুলতা মাত্র। আর এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। আর এই বাস্তবতাকে সামনে রেখেই বলা যায়, ইমিনিয়্যুটি আর শক্তিশালী অ্যান্টিবডিই রক্ষা করেছে দেশের অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে। আর সে কারণেই এ বিষয়ের দিকে আমাদের আরো বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকা রিপোর্ট থেকে বেশ কয়কজন বিশেষজ্ঞের ধারণা ও মন্তব্য পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরছি:
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, তাঁরা মনে করছেন উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের তুলনায় নিম্ন আয়ের ও বস্তিবাসীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কারণ তাদের পরিশ্রমী জীবনযাপন। এবিষয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ও রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরাও কাজ শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ফলাফল আকারে বলার মতো পর্যায়ে কাজ এগোয়নি। তবে যতটুকু পর্যবেক্ষণে এসেছে তাতে আমরাও দেখতে পাচ্ছি বস্তিবাসী যাদের পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের মধ্যে করোনা পজিটিভের হার খুবই কম।’
নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি শারীরিক পরিশ্রম করায় তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখনো যেহেতু আমরা কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক ভিত্তি পাইনি, তাই এভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে আবার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়াও যাবে না।’
ভাসমান মানুষ বেশির ভাগ সময় ঘরের বাইরে বা খোলামেলা পরিবেশে কাজ করে। বদ্ধ কম জায়গায় কম কাজ করতে হয়। বাইরে থাকলে তারা তুলনামূলক বেশি শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ পায়। ফলে তারও প্রভাব থাকতে পারে। বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও এ ধরনের ধারণা আমাদের কারো কারো মধ্যে কাজ করে। এ ছাড়া বস্তিতে বয়স্ক মানুষ তুলনামূলকভাবে কম। করোনায় মৃত্যুর খবরও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা বড় ভয়ে ছিলাম বস্তিবাসীদের নিয়ে। কারণ যদি কোনোভাবে এসব বস্তিতে ব্যাপক সংক্রমণ হয়, আমরা কিভাবে সামাল দেব? কারণ বস্তিতে আইসোলেশন কার্যকর করা কঠিন। এ কারণে আমরা আরবান হেলথ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের সবাইকে নিয়েই বস্তিগুলোতে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু করি এবং মাস্ক-সাবানসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণ সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বস্তির অনেকে ঘরে বসেই বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পাচ্ছে, ফলে বাইরে যাওয়ার হারও কমেছে। সব মিলিয়ে আমরা যেভাবে আশঙ্কা করেছিলাম এখন পর্যন্ত তেমন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে আউটব্রেক হয়নি। এটা একটি খুবই ইতিবাচক দিক আমাদের জন্য।’
জনসংখ্যাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, ঢাকায় এখন প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৩৫-৩৬ শতাংশ হচ্ছে বস্তিবাসী ও ভাসমান। তাদের যে জীবনমানের অবস্থা তাতে করে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়লে খুবই বিপদের বিষয়। এ ক্ষেত্রে তাদের পরীক্ষার সুবিধা বা স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। তবে সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্তত দৃশ্যমান পর্যায়ে সংক্রমণ হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেনও বিষয়টি নিয়ে কৌতূহল বোধ করছেন। তিনিও বলেন, ‘কেন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বহিঃপ্রকাশ কম দেখা যাচ্ছে তার যুক্তিসংগত বা বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যাখ্যা এখনো পাইনি।
বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘আমরা ঢাকা মেডিক্যালসহ অন্য হাসপাতালগুলোতেও করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকটাই কম দেখছি। আমার মনে হয়, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের চেয়ে বস্তিবাসী বা নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন বেশি রোগ প্রতিরোধমূলক। বিশেষ করে শারীরিক পরিশ্রম করায় নিম্ন আয়ের বা বস্তিবাসীর মধ্যে ডায়াবেটিসের মতো রোগ কম। যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আমরা এখনো বের করতে পারিনি।’
ব্র্যাকের করোনা পরীক্ষা কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক ডা. মোর্শেদা আক্তার বলেন, ‘আমাদের আরবান প্রজেক্ট ও আরো কিছু কাজের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষ ও বস্তিবাসীর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি কেমন তা দেখার চেষ্টা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত সাধারণ পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে—এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে করোনার প্রকোপ কম।’ এ নিয়ে আরো ভালো করে গবেষণা প্রয়োজন উল্লেখ করে ডা. মোর্শেদা বলছিলেন, ব্যাপারটা অনেকটা রহস্যজনক এবং অনেকের জন্যই কৌতূহলোদ্দীপক।
শেষ করবো এই বলেই, করোনার ভয়াবহতা এখনো কাটেনি। বিপর্যস্ত হয়েছে আমাদের জীবন। ভেঙে পড়েছে অর্থনীতি। আমরা এক কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। এ সংগ্রামে আমাদের জিততেই হবে।
তবে অনেক খারাপ খবরের মাঝে একটি ভালো খবর আমাদের নজরে এসেছে। আর সে খবরটি হলো দেশে করোনার তীব্রতা এখন অনেকটাই নিন্মমুখী। একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মৃত্যুর মৃত্যুর হার কয়েক দিন ওঠানামা করলেরও এখন তা নিন্মমুখি। সবচেয়ে ভাল খবর হলো- সুস্থ ১ লাখ ৩ হাজার ২২৭ জন।

মাহবুবুল আলম
কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top