সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

শ্রিংলার ঝটিকা সফর: সরগরম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
২৭ আগস্ট ২০২০ ২১:২২

আপডেট:
২৭ আগস্ট ২০২০ ২১:২৬

 

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলার হঠাৎ করে বাংলাদেশে ঝটিকা সফরকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তুমুল আলোচনা -সমালোচনা চলছে। মিঃ শ্রিংলা বর্তমানে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। সে- হিসেবে তিনি দু'দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে কোন সময় বাংলাদেশে ঝটিকা সফরে আসতেই পারেন, এনিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি বা পানি ঘোলা করার কোন মানে আছে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট প্রবল। যে কোনো ইস্যুতে সেটা হোক খেলা কিংবা অন্য কোনো বিষয় তাতে ইন্দন জোগানো মানুষের অভাব নেই। এ-অবস্থা চলে আসছে পাকিস্তান আমল থেকেই যা বংশ পরম্পরায় চলে আসছে।

নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারত আমাদের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। সবচেয়ে বড় কথা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিল, সে দিন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের সর্বস্তরের মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে বিপন্ন বাঙালিদের পাশে না দাঁড়ালে স্বাধীনতা লাভ এত সহজ হতো না। সে জন্য আমরা ভারত ও সে দেশের জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে একথাও বলতে কোনো দ্বিধা নেই ভারতের সহযোগিতা যেমন মনে রাখবো তেমনিভাবে তাদের কোনো দাদাগিরি কিছুতেই আমরা মেনে নেবো না। তবে মাঝে মাঝে ভারতের কিছু দাদাগিরিসুলভ কাজকারবার বাংলাদেশের মানুষকে ক্ষুব্দ করে তোলে যা নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হয়।

শ্রিংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত থাকাকালিন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু নিজস্ব মনগড়া কথা ভারতীয় কয়েকটি পত্রিকায় লেখেন। ওই লেখায় চায়নার সাথে ১২টি চুক্তির স্বাক্ষর থেকে বাংলাদেশকে নিবৃত্ত, পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দর যাতে কোনো ভাবে চায়নার সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে না পারে এ জন্যই শ্রিংলার এ লেখাটির কারণে বাংলাদেশ-ভারত ও চীনের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেকটা শীতল সম্পর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময়ে তার সেই লেখাকে অনেকেই সামনে নিয়ে এসে এখন আবার বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে একটি মহল।

আমরা এ কথাও জানি যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতার বাঁধার কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি ঝুলে থাকার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার ৩৫টি উপজেলার পাঁচ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে তিস্তা নদীর পাড়ে বাস করেন প্রায় ৯২ লাখ মানুষ। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বর্তমান
হাসিনা সরকার তিস্তানদীর দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবস্থাপনার জন্য চীনা অর্থায়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার কাজ আগামী ডিসেম্বর নাগাদ শুরু হওয়ার কথা।

যতটুকু জানা গেছে হর্ষবর্ধন শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরকে ঝটিকা সফর বলা হলেও কুটনীতিবিদদের অনেকে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন যে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এ সফরটিকে আকস্মিক বলা যাবে না। এর সাথে জড়িত বর্তমান হট ইস্যু ভ্যাকসিন রাজনীতি বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে যে, করোনা মোকাবিলায় চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের প্রস্তাব আসার আগে থেকেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ শুরু হয়।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের বিষয় সামনে চলে আসে। তখন থেকেই এ সফরের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তাই চীন যখন তাদের আবিস্কৃত ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়ালের জন্য অনুরোধ জানায় কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে
তখন হ্যা বা না কিছুই বলা হয়নি। চীনের আবিস্কৃত টিকার পরীক্ষা সংক্রান্ত অনুমোদনের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ভারতের সঙ্গে টিকার ট্রায়ালের প্রস্তাবই নিয়ে এসেছেন শ্রিংলা।

১৮ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শ্রিংলা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার সরকারের বার্তা পৌঁছে দেন। কভিড-১৯ বিষয়ে ভারতের সহযোগিতার বিশেষ বার্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিতেই দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন বলে জানা গেছে। ভ্যাকসিন রাজনীতির অংশ হিসেবেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এ সফর। আর এ সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে।

ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভারতের সমর্থন, সীমান্ত হত্যা, ভারতে বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশসহ বেশ কিছু ইস্যু অনেকদিন ধরে ঝুলে আছে। এই কারণে কারণে ভারতের সাথে সম্পর্কের কিছুটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। যা দুই দেশের জন্যই ভালো দিক নয়। তবে বাংলাদেশের দৃঢ়চেতা প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে যে কারও সঙ্গে সম্পর্কে জোরদার করবেন না এটা আমরা আমরা দৃঢ়ভাব বিশ্বাস করি। সুতরাং আর টিকার বিষয়েও আমাদের সুবিধার দিক নিয়েই আলোচনা হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এ বিষয়ে কিছু সংবাদ প্রকাশ করে যা বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টাল প্রকাশিত হয়েছে সামারাইজ করে এখানে তুলে ধরা হলো :
ভারতের গণমাধ্যম জি ২৪ ঘণ্টা দাবি করেছে, শ্রিংলার এ সফরে তিস্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হবে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে নয়া দিল্লি ও ঢাকার দড়ি টানাটানি নতুন কিছু নয়। আর তারই মাঝে সেই তিস্তা প্রকল্পেই সম্প্রতি ঢাকাকে বিপুল পরিমাণ সাহায্যের ঘোষণা করেছে পেইচিং। এমন আবহেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো ঝালিয়ে নিতে ও সামগ্রিক পরিস্থিতির আঁচ পেতেই এ ঝটিতি সফর।’

দ্য হিন্দুর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে তিস্তা প্রকল্পে চীন ১ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বর্ষায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে ওঠার হাত থেকে রক্ষা করবে।’ আগামী ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলত তিস্তার বিষয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছতেই শ্রিংলার এ ঝটিকা সফর।

হিন্দুস্থান টাইমসের খবরে বলা হয়, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন শ্রিংলা।’ গত মাসে বাংলাদেশকে ১০টি লোকোমোটিভ ট্রেন উপহার দেওয়ার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

দ্য প্রিন্টের খবরে বলা হয়ছে, গত এক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে চলা বাংলাদেশের শীতল সম্পর্ক আবারও আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা নিয়ে শ্রিংলার এই সফর।’ চীন বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আগ্রাসী সম্পর্ক’ করছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই সফর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবে।’

এদিকে ১৮ আগস্ট পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন শ্রিংলার সফর সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমরা অফার করব, আমাদের এখানেও যদি ট্রায়ালের সুযোগ থাকে, অক্সফোর্ডের যেটা কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আমরা লন্ডন মারফত যোগাযোগ করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ সম্পর্কে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেজন্য যত উদ্যোগ নেওয়া লাগে নিতে হবে। এছাড়া সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কাল্পনিক সংবাদ হয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা হবে; যাতে সম্পর্কে কোনো গ্যাপ না থাকে।’

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে বলেন- সিনোভ্যাকের করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যেকার ‘দ্বন্দ্বের মধ্যে’ পড়েছে বাংলাদেশ। সে কারণে চীনা টিকার ট্রায়াল দেয়ার অনুমতি আসতে সময় লাগছে।

পরিশেষে বলতে চাই, শ্রিংলার ঝটিকা সফর নিয়ে এক ধরনের ধোয়াশার সৃষ্টি হওয়ার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এ অবস্থায় একটি পক্ষ ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে পানি ঘোলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে যা দুই বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্টের কারণ হতে পারে, যা কারোই কাম্য হতে পারে না।

মাহবুবুল আলম
কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top