সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৫ই বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশ সফরের উছিলায় হরিলুটের বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে আমলারা : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
২৬ অক্টোবর ২০২০ ২৩:১৩

ছবিঃ মাহবুবুল আলম


বাংলাদেশে হচ্ছেটা কী? এই যে সরকারের বরাদ্দ এবং বৈদেশিক সাহায্যের টাকায় প্রকল্প বানিয়ে সরকারের সেই বরাদ্দ এবং বৈদেশিক সাহায্যের টাকায় হরিলুট বা শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তবে এ বিষয়টি সরদারের মন্ত্রীদের অজান্তে হচ্ছে তা কিন্তু বলা যাবে না। যে কানো প্রকল্প হাতে নিয়ে তা একনেকে দাখিলের পর তা মন্ত্রীসভায় অনুমোদনের পর এ ধরণের প্রকল্পের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়।
এধরণের প্রকল্প হাতে নিয়ে বা সরকারের কেনা কাটায় হরিলুটের খবর পত্রপত্রিকায় অনেক রিপোর্ট বা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে ও 'পিঠে বেঁধেছি কুলো, কানে দিয়েছি তুলো' প্রবাদের মতো শুনেও না শোনার ভান করে থাকা হচ্ছে।
হাসিনা সরকারের বর্তমান শাসনামলে আমলারা এ ধরণের অপকর্মে বেশি লিপ্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে লিফট দেখা,গরুর প্রজনন, আলুচাষ, পুকুর খনন সর্বশেষ খিচুড়ি রান্না, বালিশ দুর্নীতি, পর্দা ক্রয়ে পুকুর চুরি, এবং সরকারের বড় বড় ক্রয়ে পুকুর নয় একেবারে সাগর চুরির অনেক খবর সংবাদ মধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ  প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে খিচুড়ি রান্না ও বিতরণ পদ্ধতি জানতে ১ হাজার কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বিদেশ সফর করানোর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের একটি প্রস্তাব নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে চায়ের স্টল সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে।

এসব দেখলে যে কারোই মনে হবে বাংলাদেশটা বুঝি লুটপাটের রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এর আগে পারমাণবিক কেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পের জন্য কেনা একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। সেই বালিশ ফ্ল্যাটে ওঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়েছে।
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পর্দা ও যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে ‘এক পর্দার দাম ৩৭ লাখ’ শিরোনামে গত বছর সেপ্টেম্বরে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
তারপর পুকুর ও খাল উন্নয়ন শিখতে ১০০ কর্মকর্তা বিদেশ সফর ও প্রশিক্ষণের নামে সরকারের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে অনুমোদিত মূল প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ২৪ জনের কথা বলা ছিল। সেখানে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। কিন্তু নতুন করে ৭৬ জন কর্মকর্তা যোগ করার প্রস্তাব দেয়ায় বাড়তি ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয় বেড়ে যায়। অার ১১ হাজার টাকায় দুইটি কলম কিনে দুর্নীতির নতুন রেকর্ড গড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিকুন্নবী সামাদি যা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।
বাংলাট্রিবিউনে সৈয়দ ইসতিয়াক রেজা এক নিবন্ধে "খিচুড়ি নিয়ে গল্প, আলোচনা আর হাস্যরসের মাঝেই জানা গেলো বিল্ডিং দেখতে বিদেশ যাবেন ৩০ কর্মকর্তা। এজন্য প্রত্যেক কর্মকর্তার পেছনে ব্যয় হবে ৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। বিল্ডিং নির্মাণ প্রকল্পে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনের সম্মতিতেই এই বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেই সঙ্গে পরামর্শক খাতে বড় অঙ্কের বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ৯৭৩ জন পরামর্শকের জন্য ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। ‘গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের বহুতল ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে এসব ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। "
আর এ বছরের মার্চ মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ থেকে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ২০ জনকে মনোনীত করে একটি সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। মালয়েশিয়ায় সাত দিনব্যাপী এই প্রশিক্ষণের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষক, উচ্চমান সহকারী, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাবরক্ষক, হাসপাতালের স্টেনো টাইপিস্ট, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর এসব কর্মচারীকে মনোনীত করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে চিকিৎসকদের এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের কথা। কিন্তু মনোনীত ২০ জনের মধ্যে চিকিৎসক ছিলেন মাত্র ৭ জন। জনগণের টাকা তথা সরকারি অর্থ ব্যয় করে এসব কর্মচারীকে বিদেশে প্রশিক্ষণের আবশ্যকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে কী করবেন? এমন কথা ওঠেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
এছাড়া দেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। থাইল্যান্ডের থমসট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বাংলাদেশি ড. শেখ আলতাফুর রহমানের মাধ্যমে লুটপাটের এ ঘটনা ঘটেছে বলে দুদক প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে। ড. শেখ আলতাফুর রহমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. শেখ আরিফুর রহমানের ভাই।



দুদক অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ১৯টি বিষয়ের আওতায় ৩১টি প্যাকেজে ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানী ভাতা বাবদ ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫ টাকা এবং বিমান ভাড়া বাবদ ২ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর বাইরে টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় হিসেবে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা ধরা হয়েছে। সব মিলে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ২১ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ১৪৭ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর আজকের পত্রিকায় নিজস্ব প্রতিবেদক এর লেখা,'গরীব মানুষকে হাত ধোয়া শেখাতে খরচ হবে ৪০ কোটি টাকা শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ' গরীব মানুষকে হাত ধোয়া শেখাবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। আর তাতে খরচ হবে ৪০ কোটি টাকা। আাবার পাঁচ বছরে মাত্র ৯ জনের বেতন-ভাতা ৩ কোটি টাকা, আছে বিদেশ ভ্রমণ সেখানেও লাগবে ৫ কোটি টাকা। এমনই হরিলুটের আয়োজন 'গ্রামীণ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি' ডিপিপিতে। প্রকল্পের ১ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকার পুরোটাই অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে দেশের সুনাম ধ্বংস হবে। আর পরিকল্পনা মন্ত্রী বলছেন, "প্রচলিত আইনি কাঠামোর ফাঁক গলেই রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে অনিয়মের হোতারা। হাত ধোয়ার জন্য দেশের বাজারে ভাল ভেসিনের দাম ২ থেকে ৩ হাজারের ভেতর, আর ভেসিন বসানোর জন্য পাঁচ ইঞ্চির গাঁথনি তিনফুটের একটি স্টেশন বাবাতে ইট, বালু, সিমেন্ট, ফিটিংস ও পানি তোলার মটর সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। সেখানে ১ হাজার চারশ' পঁচিশটি স্টেশনের প্রতিটির মূল্য ধরা হয়েছে ২ লাখ টাকার
ও বেশি মানে সাড়ে ২৮ কোটি টাকা।

পাঠক এবার আপনারাই বুঝুন কীভাবে দেশের টাকার শ্রাদ্ধ করে আঙ্গুল ফুলে বট গাছ হচ্ছে আমাদের আমলা ও হরিলুটের আংশিদাররা!

 

মাহবুবুল আলম
কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top