সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

এখন আমাদের গর্ব করার অনেক কিছুই আছে : মাহবুবুল আলম


প্রকাশিত:
২৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৬

আপডেট:
২৩ নভেম্বর ২০২০ ২২:৩৭

 

২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার যে অঙ্গিকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছিলেন সে অঙ্গিকার বাস্তবায়ন করতে এবং ২০২১ একুশ সালের মধ্যেই একটি মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত করতে শেখ হাসিনার সরকার দেশের অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি ১০টি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছেন। করোনা কালেও এসব মেঘাপ্রকল্পের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক সাহসী নেতা না হলে এত বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া কী সম্ভব? তার ওপর তো আছে দেশি-বিদেশি নানামুখি ষড়যন্ত্র ও কুটচাল। সবকিছু অতিক্রম করে দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। যে দশটি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলো কমিশনিং হলে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিস্থিতি আমূল পালেট যাবে। এর ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বেড়ে যাবে অনেক। তাই এখানে আমি সেই ১০টি মেগাপ্রল্পের নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

পদ্মা বহুমুখী সেতু: বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ বহুল প্রত্যাশিত এ প্রকল্পটির সর্বশেষ নির্মাণ ব্যয় দাড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। গত অক্টোর পর্যন্ত প্রকল্পটির ৮২ শতাংশ অগ্রগতি হয়। আগামী অর্থবছরে এর জন্য বিপুল অঙ্কের বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

পদ্মা রেলসেতু সংযোগ: দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প ২০২২ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-খুলনা পথে ২১২, ঢাকা-যশোর পথে ১৮৪ এবং ঢাকা-দর্শনা পথে দূরত্ব কমবে ৪৪ কিলোমিটার।

দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার গুমদুম রেলপথ: পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদার প্রেক্ষিতে গৃহীত প্রকল্পটির ব্যয় ১৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকায় উন্নীত করে সম্প্রতি সংশোধন করেছে সরকার। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রকল্পটির জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা দেওয়ার কথা। আগামী অর্থবছরে এর জন্য বরাদ্দ থাকছে ৬৩১ কোটি টাকা। দুই ধাপে ১২৯ দশমিক ৫৮৩ কিলোমিটার রেলপথ হওয়ার কথা এ প্রকল্পে।

মেট্রোরেল: মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা আছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্পে ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ও জাপান ১৬ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা যোগান দেবে। ২০২৪ সালে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

পায়রা সমুদ্রবন্দর: দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের অনগ্রসরতা, আমদানি বৃদ্ধি এবং বন্দরের ভবিষ্যৎ ধারণক্ষমতা বিবেচনায় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। দেশের তৃতীয় এ বন্দর নির্মাণে ২০১৩ সালের নভেম্বরে জাতীয় সংসদে ‘পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’ নামের একটি আইন পাস হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১ হাজার ১৪৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রমে যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়েছে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে পাবনার ঈশ্বরদীতে ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা। প্রকল্পে সরকার ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ব্যয় করবে। রাশিয়ার প্রকল্প সাহায্য রয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা।

মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র: কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ৬০০ মেগাওয়াট করে দুটি কেন্দ্রের মধ্য মোট ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প নেওয়া। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা, যার মধ্যে জাপান দেবে ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ প্রকল্পের জন্য ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

মৈত্রী সুপার থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র: ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে বাগেরহাটের রামপালে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। ১৪ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি ইউনিটের মাধ্যমে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা এই প্রকল্পে। নতুন অর্থবছরে প্রকল্পটির জন্য ২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর: দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে। বন্দরটি হলে তা প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য ব্যবহার করতে পারবে। সরকার মনে করে, বন্দরটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি কেন্দ্রে পরিণত হবে। প্রকল্পটি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে বাস্তবায়নের জন্য নীতিগত অনুমোদন পায়। পরবর্তীতে জি টু জি ভিত্তিতে এ বন্দর নির্মাণে চীন, ভারত, নেদারল্যান্ডস ও দুবাইয়ের চারটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করেছে।

এলএনজি টার্মিনাল: সাংগু গ্যাস ক্ষেত্র শেষ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গ্যাস সংকট বিরাজ করছে। এ সংকট নিরসনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির লক্ষ্যে মহেশখালী উপকূলে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টার্মিনাল হবে। টার্মিনাল থেকে মূল ভূখণ্ডে গ্যাস আনতে ৯১ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।

নিচের চিত্রটিই বলে দেয় বাংরাদেশ কতটা এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্যেমে বাংলাদেশ পৃথিবীর ৫৭ তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরুর মধ্য দিয়ে ৩২তম দেশ হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে ঢুকে গেছে বাংলাদেশ। দুটো সাবমেরিন ক্রয়ের মধ্যামে বিশ্বের ৪১তম দেশ হিসেবে সাবমেরিনের অধিকারী হয়ে গেলো বাংলাদেশ। মাত্র ৫০ হাজার কোটি টাকার বাৎসরিক বাজেটকে টপকে বাংলাদেশের বাৎসরিক বাজেট এখন ৫ লাখ কোটি টাকা।

পায়রা সমুদ্র বন্দর, ঢাকা খুলনা এক্সপ্রেস হাইওয়ে, এলিভেটেস এক্সপ্রেসওয়ে, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প, বুলেট ট্রেন, ঢাকার চারাপাশে ঘিরে সার্কুলার রোড়, মেট্রোরেল, পদ্মাসেতুসহ এসব মেগা প্রজেক্টের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশের চেহারাই অনেকটা বদলে যাবে। আমাদের তলা বিহীন একটা ঝুড়ি ছিলো। টানা চার চারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, দুর্নীতিতে পাঁচবার শীর্ষ হওয়া বাংলাদেশ শূন্য রিজার্ভ থেকে এখন ৪২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ। হাইটেক পার্ক, ইলেকট্রনিকস সিটি, মানমন্দির, অর্থনৈতিক জোন, হাইওয়ে, বড়বড় ব্রীজ সবই বাংলাদেশে হয়েছে, হচ্ছে। ভারতীয় মিড়িয়া, পাকিস্তানি মিড়িয়া, আমেরিকান মিড়িয়া এমনকি যেই বিশ্বব্যাংক আমাদেরকে লোন দেয়নি, ওরাও বাংলাদেশের উন্নয়নের উপর গবেষণা করে রিপোর্টেও পাশাপাশি প্রশংসা করে। এই প্রশংসা করার জন্য এদেরকে কেউ পয়সা দিয়ে ভাড়া করেনি। ওরা গবেষণা করেছে, ওরা জেনেছে।

বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে বিপর্যস্ত বিশ্ব। যার প্রভাব এড়াতে পারেনি বাংলাদেশও। গত আট মাস ধরে অদৃশ্য এ শক্তির মোকাবিলার পাশাপাশি ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। করোনা, আম্ফান ও বন্যার মধ্যেও সরকারের দক্ষ মনিটরিংয়ের কারণে বাজার পরিস্থিতিও ছিল সাধারণ মানুষের নাগালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিভিন্ন সংস্থাও নিয়মিত মনিটরিং করেছে সর্বক্ষণ। করোনা চলাকালে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ১৯টি প্যাকেজে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যেমন প্রণোদনা পেয়েছেন, বাদ যাননি করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরাও। তাদের জন্যও ঘোষণা করা হয় স্বাস্থ্যবীমা বা প্রণোদনা। করোনায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিয়োগ দেওয়া হয় চিকিৎসক। নিশ্চিত করা হয় চিকিৎসা সুরক্ষাসামগ্রীও। সবকিছু শক্ত হাতে তদারকি করেন তিনি।

দরিদ্র কৃষক ও কৃষির উৎপাদন বাড়াতে ৫ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে বাদ পড়েননি মসজিদের ইমাম, খতিব, মুয়াজ্জিন, মাদ্রাসার শিক্ষক, নন-এমপিও শিক্ষক, গার্মেন্ট শ্রমিক, গ্রামপুলিশ, প্রতিবন্ধী, দুস্থ সাংবাদিকরাও। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথাও ভুলে যাননি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তাদেরও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্যও বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫ কোটি টাকা।

ঈদের আগে প্রতি পরিবারকে ২ হাজার ৫০০ করে ১ হাজার ২৫০ কোটি নগদ টাকা সহায়তা করা হয়েছে। দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয় ভিজিএফ, ভিজিডির পরিমাণ। রেশন কার্ডের আওতায় ১০ টাকা দরে চাল বিক্রি করা হয়। এতে ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। শিশুদের জন্যও খাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, করোনাকালে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেবে, কিন্তু শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। বরং উৎপাদন ও খাদ্য মজুদ বেড়েছে। মানুষের জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে দিয়েছেন সব ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

পরিশেষে বলতে চাই, ঘুষ, দুর্নীতি হত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো বাদ দিলে আমাদের গর্ব করার অনেক কিছুই আছে। উন্নয়নের রেললাইন ধরে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি হাতেগোনা দুই একটি নেতিবাচক ঘটনা বা দুর্ঘটনা কে বাদ দিই তাহলে দেখতে পাব যে বাংলাদেশ উনয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের তালিকার প্রথম সারিতেই আছে। তাই এ কথা নিঃশঙ্কচিত্তে বলা যায় এখন আমাদের গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে।

 

মাহবুবুল আলম
কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top