একটি অতি তুচ্ছ মৃত্যু : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
প্রকাশিত:
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:০৭
আপডেট:
৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ২৩:৩১

সব জীবন যেমন গুরুত্ব পায় না, তেমনি সব মৃত্যুও আলোচনায় আসে না।
তারপরও কিছু কিছু মৃত্যু গুরুত্ব পায়। টিভির পর্দায় পত্রিকার পাতায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুদিন যাবৎ চলে সে মৃত্যু নিয়ে আলোচনা।
সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু, ধর্ষণ-গণধর্ষনে মৃত্যু, কারখানায় আগুনে মৃত্যু এসব এখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। একজন সাবেক সেনা অফিসারের মৃত্যুর পর হঠাৎ করে মনে হলো এটা একটু অন্য রকম মৃত্যু। আবার কোটি কোটি টাকা যে দেশে মাত্র হিসাবে গণ্য সে দেশে ১০ হাজার টাকার জন্য একজনকে যখন পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় পুলিশ হেফাজতে তখনও কিছুটা বৈচিত্র্য নিয়ে হাজির হয় মৃত্যু।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে যখন হাসপাতালে নেবার পর চিকিৎসা দিয়ে ভালো করার পরিবর্তে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় তখনও আমরা অবাক হই। নানাভাবে নানা অপমৃত্যুর দেশে হঠাৎ হঠাৎ কিছু মৃত্যু আমাদের অবাক করে। টক-শো, খবর, পত্রিকার শিরোনামে চলে আসে সেসব মৃত্যুর খবর। মানববন্ধন, বিচার চাই শ্লোগানও চলে।
এতো এতো মৃত্যুর মাঝে আমি যে মৃত্যুর কথা বলতে এসেছি সেটা অতি তুচ্ছ একটি মৃত্যু। মুখ বাকিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাঠক হয়তো অবজ্ঞা ভরে বলে বসবেন, এটা আর নতুন কী? ‘একজন শিক্ষকের মৃত্যু পেনশনের অপক্ষায় থেকে থেকে’ এটা আবার বলার কী হল?
শিক্ষক জ্বর, পাতলা পায়খানা, আমাশার মতো রোগে না ভুগে; তিনি হৃদরোগে কেন আক্রান্ত হবেন?
এদেশের মন্ত্রী এম.পি মহোদয় যেসব রোগে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুর গিয়ে মারা যান সে রোগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যদি মারা যান তা হলে সম্মানিত মানুষের সম্মানটা কি থাকে?
কিশোরগঞ্জের কালটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোঃ সানাউল করিম, গত ১২ই নভেম্বর রাতে তাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। জাতীয় হৃদরোগ ইনষ্টিটিউটে ভর্তির পর ভোর পাঁচটায় তার মৃত্যু হয়। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
মোঃ সানাউল করিমের বাড়ি কিশোরগঞ্জের পাকুলিয়া উপজেলার চন্ডীপাশা ইউনিয়নের চিলাকারা গ্রামে।
চলতি বছরের ২০শে মে অবসরকালীন ছুটি (পি.আর.এল) শেষ হয়।
মোঃ সানাউল করীম হৃদরোগে ভুগছিলেন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছিলেন না। পেনশনের টাকা পেলে উন্নত চিকিৎসা করাবেন ভেবেছিলেন।
সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী কামরুল হাসান দ্রুত পেনশনের নিষ্পত্তি করে দেবার প্রতিশ্রুতিতে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। কিন্তু টাকা দেবার পরও পেনশনের কাজ হয় না। অফিস সহকারী আরো টাকা দাবী করেন। অসুস্থ শিক্ষক মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। অবশেষে এক রকম বিনা চিকিৎসায়ই চলে যান এ পৃথিবী ছেড়ে।
তার মৃত্যুর পর অফিস সহকারী ২০ হাজার টাকা ঐ শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে ফেরত দিয়ে আসেন। শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, সময় মতো তিনি পেনশনের ফাইলে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন তারপরও কেন পেনশনের কাজ হয়নি তা তিনি জানেন না।
অবশ্য তারই অফিসের কাজ কেন হয়না, কেন ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না; সে বিষয়ে কেউ তাকে ‘শো কজ’ করেছে কি না জানি না।
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন জানতাম ‘স্যার’ শব্দটা শুধুমাত্র শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে যে কোন মানুষ একজন শিক্ষকেকে সম্বোধনের সময় স্যার শব্দটি বলেন। আর অফিসে স্ব স্ব অফিসের লোকজন পদাধিকার বলে স্যার শব্দটি নিজ অফিসে ব্যবহার করেন।
তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী শিক্ষকদের অর্থ, বিত্ত নয় ছিল স্যার নামক একটা সম্বোধন সেটাও এখন বিলুপ্ত। এখন সাধারণ মানুষের কাছে স্যার সম্বোধন শুনবার বাসনায় নানা অফিসের কর্মকর্তারা মাঝে মাঝেই নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটান।
শিক্ষকদের অফিসিয়াল কাজগুলো করার জন্য থানা শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস, এজি অফিসে ঘোরাঘুরি করতে হয়। থানা শিক্ষা অফিসেই সাধারণত কাজগুলোর জন্য প্রায়ই যেতে হয় শিক্ষকদের।
এক সময় অবৈধ লেনদেনে জড়িত ছিল এককভাবে অফিস সহকারী। কিন্তু এখন আর এককভাবে লেনদেন হয় না। দু’এক জায়গা বাদে অনেক জায়গায়ই ঐক্যবদ্ধভাবে ঘুষের টাকা নেয়া হয়।
অনেক শিক্ষা অফিসে দেখেছি অফিস সহকারী শিক্ষকদের নাম ধরে ‘অমুক সাহেব’ সম্বোধন করেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ অফিস সহকারীকে স্যার সম্বোধন করেন। এসব অফিসের অফিস সহকারীদের আয়ের হিসাব নিলে কেঁচো খুড়তে শুধু সাপ নয়, অজগর বের হবে।
শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারীকে সালাম দিলে সালামের উত্তর পেতেও মনে হয় টাকা দিতে হয়। এখানে আছেন তাদের কেন বেতন দেয়া হয় সেটাই ভেবে পাই না। শিক্ষক সানাউল করীম মরে বেঁচে গেছেন হয়রানির গ্লানি থেকে। কিন্তু প্রতি বছরই হাজার হাজার শিক্ষক তাদের সারাজীবনের সঞ্চয়, প্রাপ্য টাকা পাওয়ার জন্য নানা হয়রানীর শিকার হয়ে বেঁচেও মরে থাকেন।
শুধু পেনশনের টাকা কেন হজে যাবার অনুমতি আনতে গেলেও দিতে হয় টাকা। সঙ্গে আবার গলে গিয়ে অনুরোধ করা হয়, যাতে তার জন্য দোয়া করা হয়।
দেশের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ মৃত্যু সংবাদের মাঝে পেনশনের টাকা না পেয়ে চিকিৎসার আগেই একজন শিক্ষকের মৃত্যুর খবর দৈনিক যুগান্তরে ছাপার জন্য শিক্ষক সমাজ কৃতজ্ঞ।
এই মৃত্যু দেশ বাসীর কাছে কেন গুরুত্ব পেল না? অন্তত এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অবৈধ লেনদেনের শিক্ষা অফিসগুলো শুদ্ধ করার একটা চেষ্টা করা যেত। তুলে আনা যেত কোন কোন খাতে কীভাবে শিক্ষকদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা হয় সে তথ্য।
প্রতিটি কাজের জন্যই যদি টাকা দিতে হয় তাহলে সরকার এদের কেন বেতন দেয়? তদন্তের মধ্যেই আটকে থাকে সব অন্যায়। কোন সমাধান আর হয় না। শিক্ষকদের শুনানো হয় সততার বাণী। শিশুদের ঠিকমতো না পড়ালে ইহকাল এবং পরকালে তাদের জন্য কী কী ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করছে তা বর্ণনা দেন কর্মকর্তাবৃন্দ। কিন্তু তাদেরই অফিসের অফিস সহকারী বাড়তি টাকা ছাড়া কোন কাজই করেন না এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেই। উপদেশও নেই।
কথায় কথায় অনেকেই বলেন, ‘শিক্ষকতা মহান পেশা। টাকা নয় সম্মানের কথা ভেবেই শিক্ষকদের এ পেশায় আসা উচিৎ।’ আহা! এতো মহান পেশা বাদ দিয়ে এতো সম্মান রেখে কেন অন্য পেশায় যায় মানুষ!
মানুষের নুন্যতম যে অধিকার সে অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। যে শিক্ষক শিশুদের শিক্ষা দেন। ‘অন্যায় করা এবং অন্যায় সহ্য করা সমান অপরাধ। সে শিক্ষক ঘুষ দেয়া ছাড়া তার অফিসিয়াল কোনো কাজই করতে পারেন না। এমন কি ফান্ডের টাকার স্লিপটা পর্যন্ত ঘুষ ছাড়া নেয়া সম্ভব হয় না তার পক্ষে।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যিনি যোগদান করেন তিনি সারা জীবন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী থেকেই অবসরে যান। তার কোন প্রমোশন নেই। কর্মচারী থেকে কর্মকর্তা হবার সুযোগও নেই।
অথচ একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসাবে অন্য কোনো পেশায় যোগদান করলে কর্মকর্তা হিসাবে সে প্রমোশন পেয়ে অবসরে যায়।
তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর কাছে রাষ্ট্রের প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী আশা করা কি প্রহসন নয়?
দিনের পর দিন কতিপয় শিক্ষা অফিস শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। একজন শিক্ষকের অবসরকালীন টাকা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু খুব বড় ঘটনা মনে না হলেও এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধে এই মৃত্যু কি ভূমিকা রাখতে পারে না?
শিক্ষক সংগঠন, সাধারণ শিক্ষক এবং নীতিবান কর্মকর্তারা সবাই মিলে প্রতিটি থানায় থানায় ঘুষ মুক্ত শিক্ষা অফিস ঘোষণা দিয়ে এই হতভাগ্য শিক্ষকের প্রতি মৃত্যুর পর সম্মান দেখাতে পারে। দেশের প্রতিটি ঘটনাই যদি স্বাভাবিক হয়ে যায়, আমাদের নৈতিকতায়-মানবিকতায় নাড়া না দেয় তা হলে একের পর এক ঘটবে অঘটন; কিন্তু বদলাবে না কিছুই।
নতুন বছরে ‘ঘুষ মুক্ত’ শিক্ষা অফিসের ঘোষণা দিয়ে এই তুচ্ছ মৃত্যুকে আমরা স্মরণীয় করে সম্মান দিতে পারি। শুধুমাত্র সেমিনার, বক্তৃতা, নানা আলোচনায় নানা দিবস পালন না করে মানবাধিকার কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করে পরিবর্তনের সূচনা করতে পারি।
মৃত্যুটা যেন তুচ্ছ হয়ে না যায় সেটা প্রতিষ্ঠা করাও মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে। প্রতিটা জীবন সমান সম্মানিত করতে আমরা ব্যর্থ। অন্তত প্রতিটি মৃত্যু আমরা সমান গুরুত্বপূর্ণ করার চেষ্টা করতে পারি।
নতুন বছরের আগমন। পুরনো বছরের বিদায় আমাদের মানুষ করুক। আমাদের আশা আর ভালোবাসায় উজ্জীবিত করুক।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট
বিষয়: শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: