সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

জমিদার নেই, আছে জমিদারী পাপ : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:৫২

আপডেট:
১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:০৯

ছবিঃ শাকিলা নাছরিন পাপিয়া

 

এ দেশের দরিদ্র কৃষকের রক্ত শুষে নেয়া শ্রেণি হলো জমিদার। সাহিত্য সমাজের দর্পন। বাংলা সাহিত্যে কৃষকদের শোষণ করার জন্য জমিদার, ব্যবসায়ীদের নানা নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কৃষক ফসল ফলাতো অথচ সেই ফসল ভালো হলে উৎসবের জোয়ার বইতো জমিদারের বাড়ি। যাদের শ্রমে, ঘামে, স্বপ্নে সোনার ফসল ফলতো তারা পেট পুরে খেতে পারতো না। তাদের গোটা পরিবার থাকতো অনাহারে।

কৃষকের পরিশ্রমের ফসল চলে যেত জমিদারের বাড়ি। মুখে ভাত, নাক ফোঁড়ানো, কান ফোঁড়ানোসহ নানা উৎসবের আয়োজন হতো জমিদারের বাড়ি। এই উৎসবে আসতো নামীদামী বাঈজী। সাত দিন সাত রাত চলতো উৎসবের আমেজ। দরদী কোন কোন জমিদার দান- দক্ষিণা দিতেন গরীব প্রজাদের। খাওয়াতেন একবেলা। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জমিদারের গুণগান গাইতো দরিদ্র প্রজারা। বাঈজী নাচের সাথে থাকতো মদ। আমন্ত্রিত থাকতেন বিভিন্ন রাজ্যের জমিদার আর নামিদামি ব্যক্তিবর্গ। এই উৎসবের জন্য থাকতো আলাদা নাচঘর।

সাধারণ প্রজাদের এখানে প্রবেশ তো দূরের কথা আশেপাশে যাওয়াও বাড়ন থাকতো। অকর্মন্য জমিদাররা নেশায় বুদ হয়ে মাসের পর মাস কাটাতেন বাঈজীর সান্নিধ্যে।

জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে বহুকাল। শোষণের পরিবর্তন হয়ে এখন নতুন পদ্ধতি যোগ হয়েছে। কৃষকের ভাগ্য বদলায়নি। এখনো কৃষক শুধু দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে হিমশিম খায়। জমিদারী উঠে গেলেও রয়ে গেছে জমিদারদের বান্দীর ঘরে জন্মানো কিছু সন্তান। দম্ভে, অহংকারে যাদের মাটিতে পা পড়ে না। যারা অবৈধ ব্যবসা, অবৈধ উপার্জন দিয়ে এখন নিজেদের জমিদারের সম পর্যায়ের ভাবছে।

 

সমাজে নানা ধরণের উৎসবের সমারোহ চলছে। মিডিয়ার কল্যানে এখন গায়ে হলুদ নামক অনুষ্ঠানটি নিত্য নতুন আয়োজনে সমাজে যন্ত্রণার জন্ম দিচ্ছে। নাক ফোঁড়ানো, কান ফোঁড়ানো, সুন্নতে খাৎনা, বিয়ে সহ নানা ধরণের অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে বাঈজী নামক শিল্পী ভাড়া করে আনা হয়। রাত বারোটার পর শুরু হয় হিন্দি গানের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্য। স্বল্প বসনা নারীগণ, তাদের মোচড়ানো শরীরের কসরত শুরু করে এক ঝাঁক যুবকের সাথে। থাকে নানা ধরণের নেশা জাতীয় সরবত। হজ্জ করে আসা ব্যক্তিবর্গও মনে করেন আনন্দের জন্য একটু আধটু খাওয়া যায়।

গানের সঙ্গে থাকে আলাদা করে দেওয়া বিট। যা মাথার গভীরে আঘাত করে। টাকা আর ক্ষমতার জোরে এমন একটা সমাজ তৈরি হতেই পারে। কিন্তু সমস্যা হলো-- বৃদ্ধ, শিশু, সদ্যজাত শিশু, রোগী এদের জন্য এই শব্দ ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর এবং মানসিক যন্ত্রণার।

সংবিধান অনুযায়ী দেশের প্রতিটি মানুষ শান্তিতে বসবাসের অধিকার রাখে। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতে ঘুমাতে না পারলে পরের দিন ঠিকমতো কাজ করা সম্ভব হয় না। মেজাজ খিটখিটে থাকে। শিক্ষার্থীরা লেখা পড়ায় মন দিতে পারে না। শব্দের কারণে নানা ধরণের শারীরিক এবং মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর নামে একটা অধিদপ্তর আমাদের দেশে আছে কিন্তু নানা ধরণের দূষণে তাদের কোন ভূমিকা লক্ষ করা যায় না। বিশেষ একটি দিবসে তাদের নানা কর্মসূচী পালন ছাড়া আর কোন কাজ নেই। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম গঞ্জসহ সারা দেশে কিশোর গ্যাং বেড়েই চলেছে। এদের প্রতিহত করা যাচ্ছে না। নেশা এবং সাউন্ডবক্সে গান বাজিয়ে এক পৈশাচিক উল্লাস পালন করে এরা নিজেদের ঔদ্ধত্য জানান দেয়। দেশের মানুষ এখন এদের কাছে অসহায়।

আমাদের একটা ভাষা আন্দোলন ছিল। অথচ আমরা কথা বলার অধিকার রাখি না। শহরের ছাদে ছাদে, গ্রামের রাস্তায়, দোকানে উচ্চ শব্দে উচ্ছৃঙ্খল যুবক, কিশোরদের আনন্দের নামে পৈশাচিক উল্লাসের প্রতিবাদ করার সাহস রাখে না সাধারণ মানুষ। প্রশাসন নীরব।

স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনের পথে বাংলাদেশ। অনেক অর্জনের পাশাপাশি কিছু ভয়ংকর অনিয়ম, অত্যাচারে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষের কথা ভাবতে হবে। যাদের ত্যাগে আজ আমরা স্বাধীন তারা এখন বৃদ্ধ। আনন্দের নামে শব্দের এই অত্যাচার তাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্যে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। এই আয়ু নিয়ে মানুষ এখন বিপাকে। কারণ শব্দের কারণে বয়স্ক মানুষের কী সমস্যা হয় তা এ সমাজ অনুধাবনই করে না। হার্টের সমস্যা, কানের সমস্যা, মাথা ব্যথা, খিটখিটে মেজাজসহ নানা ধরণের সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী এই উচ্চ শব্দ। সুতরাং শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক, কলামিস্ট ও কবি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top