সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

পৃথিবীটা শুধু মানুষের হোক: ধর্ম থাকুক অন্তরে : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০২১ ২১:৪৪

আপডেট:
২৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:২৪

ছবিঃ ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

প্রকৃত শিক্ষক হয়ে ওঠা খুব সহজ কাজ নয়।টাকা-পয়সা নিয়েই তো আমরা গভীরতর ভাবে ব্যস্ত, কোথায় আদর্শ? কোথায় আত্মনিবেদন? এই 'অদ্ভুত আঁধার': আমাদের অনেককেই হয়তো বেদনাহত করছে বলে মনে হয়। মোহময় এই দুঃসময়ে বারবারই মনে হয়েছে প্রায় ৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষক হিসেবে যখন আত্মসমালোচনায় নিজের সীমাবদ্ধতাটা বুঝতে পারি, তখন ভীষণ অসহায় বোধ করি। বুকে এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে কচি-কাঁচা স্বপ্নবিলাসী ছেলে-মেয়েগুলোকে গড়ে পিঠে মানুষ করবো বলে মনে করেছিলাম- পেরেছি কি? সমাজের প্রতি কি নিষ্ঠা সহকারে দায়িত্ব পালন করেছি? শিক্ষার আদর্শ, শিক্ষকের আদর্শের যে ছবিটি আমাদের চোখে আঁকা ছিল, সেটা কি ক্রমাগত বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে না? দোষটা কার? দায়ী কে? 

প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, আমার  পেশা ও নেশা রাজনীতি নয়। আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ  হিসাবে আমার সাদা চোখে দেখা বাস্তব জীবনের কিছু  উপলব্ধির কথা  বলতে  চাইছি। কাউকে  আহত ও আঘাত করার স্পর্ধা  পোষণ করি না কখনো। মুক্ত ও ইতিবাচক ভাবনা থেকেই  কিছু বলার চেষ্টা করলাম মাত্র।  আপনার ভালো  লাগতে পারে, আবার  ভালো  লাগতে নাও পারে।  দয়া করে অন্যভাবে নেবেন না, গালাগালি  দেবেন না।  আসলে আমি শিরদাঁড়া সোজা করে চলতে  ভালোবাসি, এটা আজো বিক্রি করতে পারিনি। সবাই বলে  বোকা মানুষ। শিরদাঁড়া সোজা থাকলে সাফল্যের  সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ বলে আপনার ভাবনা  একেবারেই মান্ধাতার আমলের। একটু আধুনিক হন,বাস্তববাদী হন। আমি একটু হতাশ হয়ে পড়ি। আমার বিবেক আমাকে নিষেধ করে, এই ভাবে সাফল্যের সোপান পেরনো অনৈতিক। ফলে এটাই আমার ভবিতব্য বলেই পরম আনন্দে ও সুখে আছি। আসলে এক-একজনের কাছে সুখের অর্থও আলাদা। সেটাই স্বাভাবিক।  ভেবে অন্তত গর্ব অনুভব করি,  নিজের কাছে তো আমি সৎ। এটা কি পরমপ্রাপ্তি নয় ? নানান ধরনের ভাবনার স্রোতে ভেসে যাই, তবু আঁকড়ে ধরে আছি একটা  মূল্যবোধ  নিয়েই। এটাই আমার চরিত্রের চরমতম দুর্বলতা, এটাই নিয়ে আমার সাদা-মাটা যাপনচিত্র। 

এই কারণেই  সাফল্যের  মাইলফলক নেই। কিন্তু  জীবনের  অপরাহ্ন বেলায় খুব ভালো লাগছে। এ ভাবেও সুন্দর ভাবে জীবন প্রবাহে নিজের  নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে থাকার একটা আলাদা  আনন্দ আছে, যা অর্থ দিয়ে  হাটে-বাজারে পাওয়া যায় না। আসলে অর্থ আর ক্ষমতার গোলকধাঁধায় আমরা  হারিয়ে যাচ্ছি, আমরা আজো বুঝে উঠতে পারলাম না, অর্থ জীবনে প্রয়োজন কিন্তু অর্থই সবকিছুই নয়। আগামী প্রজন্মকে কোন আলোকিত পথ দেখাতে পারছিনা। আসলে আমাদের সনাতন, শাশ্বত নৈতিক মূল্যবোধ গুলিকে আগের মতো লালন-পালন করি না। যেন-তেন প্রকারে  অর্থ রোজগার করাই আমাদের মোক্ষ লাভ। এটাই বেদবাক্য। পরিণাম ভয়াবহ হতে  চলেছে। কিছু কিছু আগাম সতর্কতা পাচ্ছি। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, জানি না। রাজনীতির  আঙিনায় সৎ, নিঃস্বার্থ, আদর্শবাদী মেধাবী উচ্চ শিক্ষিত মানুষের আসাটা খুব দরকার বলে মনে হয়, এটা আমার নিজস্ব বিশ্বাস প্রসূত ভাবনা। এই মুহূর্তে এই ধরনের মানুষের উপস্থিতি রয়েছে রাজ্যের ভোটের মানচিত্রে। অসাধারণ ঝকঝকে রেজাল্ট করেও নিশ্চিত সুখের জীবন ত্যাগ করে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে মহান আদর্শের জন্য রাজনীতির আঙিনায় মেধাবী একদল তরুণ-তরুণী এসে পড়েছে।

ক্যারিয়ার সর্বস্ব জীবন ত্যাগ করে সমাজের জন্য তাদের ভাবনাকে কুর্ণিশ জানাই। আজ রাজনীতি আর সেবা নয়, একটা  লোভনীয় ইনডাস্ট্রি। কোন বিনিয়োগ নেই, শুধুমাত্র লাভ। তবু সবাই এই পথের পথিক  নন, বহু প্রণম্য মানুষ ছিলেন, তারা রাজনীতিতে এসেছিলেন মানব জাতির সেবার জন্য। এখন এই ভাবনা,  কষ্ট কল্পিত। যুব সমাজ থেকে যারা আসছেন তারা একটা দৃঢ় আদর্শগত কারণেই  আসছেন, এটা অত্যন্ত ভালো বার্তা সমাজের কাছে এই মুহূর্তে। মত ও পথের তফাত থাকলেও এদের আসাটা একটা আশার বার্তা  বলে মনে হচ্ছে।    
পৃথিবীর অসুখ -গভীর থেকে গভীরতর। একটা চরম দুঃসময়ের মুখোমুখি আমরা। ঘরে--বাইরে আমরা শত্রুর মুখোমুখি। মানবতা – মনুষ্যেত্বর অপমৃত্যু দেখতে হচ্ছে, প্রতিটা সকাল রাতের চেয়েও বড় বেশি অন্ধকার লাগছে। অবিশ্বাসের দেওয়াল বেড়ে চলেছে। বিভেদের সীমান্তরেখা প্রলম্বিত, কমা -পূন্যচ্ছেদ নেই। মৃত্যুর মিছিল থামতেই চায় না। অনাহারে মরছে সংখ্যাতীত প্রান্তিক মানুষজন। যাদের এল, আই, সি, নেই- পি, এফ নেই। শুধু ডাল-ভাত খেয়ে একটু মানুষের মতোই বাঁচার স্বপ্ন দেখে। এইটুকু চাওয়া কি খুব অন্যায়?

সরকার-রাষ্ট্র অদ্ভুত ভাবে দশকের পর দশক নীরব। পুঁথি পাঠের শিক্ষা দিয়ে সমাজ বদলানো খুব কঠিন, দরকার বেশি বেশি করে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা। নাহলে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা নেই  আগামী প্রজন্মের। চেনা মানুষটাকে একেবারে অচেনা লাগছে। শুধু পেশী শক্তির গগনভেদী আস্ফালন। অথচ পেটে ভাত নেই, হাতে  কাজ নেই, শিল্প নেই মাথা গোঁজবার আশ্রম ভূমিটুকুও নেই, পরনে সম্ভ্রম রক্ষার সাদা-মাটা পরার কাপড় নেই, নতুন করে বাঁচার  রসদ নেই, স্কুল-কলেজে সুশিক্ষা নেই সর্বোপরি গনতন্ত্র নেই, শুধু নেই- নেই আর নেই, কিন্তু আছে রাজনৈতিক নেতাদের গালভরা শুধু মিথ্যার ফুলঝুরি। এক- একজন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এই মুহূর্তে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে আমাদের চারদিকে, সেই সঙ্গে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ-ভাবে কি সত্যিই বাঁচা যায়? মোহময় দুঃসময় কবে কাটবে কেউ জানি না! সবাই একটা আলোকিত জীবন চাই। সম্প্রীতি আর সৌভ্রাতৄত্বের অমল বন্ধনই দুঃসময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের একমাত্র বলিষ্ঠ হাতিয়ার বলে মনে হয়। হয়ত, এটাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের একমাত্র মাথা উঁচু করে বাঁচার রক্ষা কবচ, একে বাঁচিয়ে রাখা সকলেরই সামাজিক দায়বদ্ধতা। হিংসা-বিদ্বেষের মারণ উৎসব বন্ধ হোক প্রত্যেকের সদাজাগ্রত শুভবুদ্ধি ও চেতনা আর বিবেকের উন্মেষে। খুব বড় মানের ভাবান্দোলন না ঘটাতে পারলে একুশ শতকে আমাদের সম্পূর্ণ অধঃপতন ঠেকানো যাবে না বলেই মনে হয়। সেই আন্দোলনে সকলেরই কিছু না কিছু করণীয় কাজ আছে। ইতিহাসের গতি অনেকটাই মানুষের ভাবনা-চিন্তা এবং সমবেত চেষ্টার ওপরে নির্ভর করে। অর্থ আর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে, জীবনকে মিথ্যার মোহের রোশনাইয়ে বন্ধক রেখে, মানুষ আর মানুষের অনুপম শৈলীতে গড়া সমাজ আজ কোন পথে এগোচ্ছে? ভাববার সময় আগত।

শেষ কথা, পৃথিবীটা মানুষের হোক, ধর্ম থাকুক অন্তরে। মসজিদে আজান হোক। মন্দিরে-মন্দিরে মঙ্গল কামনা করে ঘন্টার ধ্বনি বাজুক। লড়াইটা শুধু হোক ভাত আর রুটির জন্য, ধর্মের জন্য নয়। 

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোক গবেষক, প্রাবন্ধিক, অণুগল্প, ফিচার, ছোটগল্প, রম্যরচনা এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top