সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

চা শ্রমিক: কষ্টে যাদের জীবন গড়া : অন্জন কুমার রায়


প্রকাশিত:
২৪ আগস্ট ২০২২ ০১:৪৩

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০২:১৫

 

ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে চা চাষের জন্য দরিদ্র্য মানুষদের নিয়ে আসা হতো। তাদের দিয়ে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টিলাভূমিতে চা চাষ শুরু করা হয়। সে সময় হাজার হাজার শ্রমিককে কোন ধরণের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ব্যবস্থা ছাড়াই নিয়োজিত করা হয়েছিল। দৈনন্দিন কর্ম পরিচালনার জন্য শ্রমিকরা বিশেষ ধরণের মুদ্রা পেতেন। তবে, তা প্রচলিত মুদ্রা ছিল না। বাগানের গন্ডির ভেতরেই ব্যবহারের সীমাবদ্ধ ছিল। তাই, চা বাগানই ছিল এ সকল শ্রমিকদের জীবনধারণের মুল উৎস।
১৮৭৩ সালে বেঙ্গল অ্যাক্টের বিলে উল্লেখ ছিল- চুক্তিবদ্ধ চা শ্রমিকরা ইচ্ছামত চা বাগান ত্যাগ করতে পারবে না। এমনকি অর্থের বিনিময়েও তাদের মুক্তি সম্ভব ছিল না। কোন শ্রমিক পালিয়ে গেলে ওয়ারেন্টের সাহায্যে তাদের গ্রেপ্তার করে চা বাগানে ফেরত দেওয়া হতো। প্রস্তাবিত আইনে চা করদের নিযুক্ত যে কোন ব্যক্তি আদালতের ওয়ারেন্ট ছাড়াই শ্রমিকদের ধরে এনে চা বাগানে কাজ করতে বাধ্য করাতে পারতো। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এই অধিকারকে আমেরিকার Fugitive Slave Law অধিকারের সঙ্গে তুলনা করে।
তখনকার সময়ে চা শ্রমিকদের উপর ব্রিটিশদের নির্যাতন, শোষণ ও বঞ্চনার প্রতিবাদে সরব হন প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বিভিন্ন সময়ে লিখনীর মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। তাতে অনুপ্রাণীত হয়ে পরবর্তী সময়ে রামকুমার বিদ্যারতœ ‘ উদাসীন সত্যশ্রবার আসাম ভ্রমণ’ নামক একটি বই লিখেন। বইটিতে চা শ্রমিকদের নির্মম অত্যাচারের কাহিনী পাওয়া যায়। এছাড়াও তিনি ‘সঞ্জীবনী’ নামক পত্রিকায় চা শ্রমিকদের উপর নির্যাতনের প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরেন। তাতে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং অনেকেই চা শ্রমিকদের উন্নয়নের স্বার্থে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু, নিষ্পেষিত, নির্যাতীত এ সকল শ্রমিকদের আজও জীবনধারার তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
আমাদের চা শিল্প অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। চা শ্রমিকদের অবদানকে খাট করে দেখার কিছু নেই। তাই, তাদের মজুরির প্রাপ্যতা দেয়া একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ১২০ টাকা দৈনিক মজুরী খুবই নগন্য। চা বাগানে শ্রমিকদের কিছু স্থায়ী এবং কিছু অস্থায়ী শ্রমিক। স্থায়ী শ্রমিকরা এ, বি এবং সি তিনটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। 'এ' ক্যাটাগরির শ্রমিকরা সর্বোচ্চ ১২০ টাকা দৈনিক বেতন পান। বি এবং সি ক্যাটাগরির শ্রমিকরা আরো কম মজুরি পান। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির সময়ে তাদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবি জানান। ইতোমধ্যে, তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করার পর চলমান ধর্মঘট প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল। কিন্তু, আন্দোলররত শ্রমিকদের একাংশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে পুনরায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই, ঢাকা-সিলেট হাইওয়েসহ বিভিন্ন জায়গা অবরোধ করেন। এতে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে। অন্যদিকে, ২২ আগস্ট সকাল বেলা মৌলভীবাজার জেলার চা শ্রমিকরা কাজে যোগদান করলেও হবিগঞ্জ জেলার চা শ্রমিকরা আন্দোলন অনড় থাকে। তবে, পুনরায় আন্দোলনের ডাক দিয়ে ওই দিন বিকালে আবারো মৌলভীবাজার জেলার শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। চলমান ধর্মঘটের কারণে চা বাগানে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে চা শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষায় বঙ্গবন্ধু সরকার চা শ্রমিকদের শ্রমকল্যাণ নিশ্চিত করেন। যেমন: বিনামূল্যে বাসস্থান, সুপেয় পানি, বেবি কেয়ার সেন্টার, প্রাথমিক শিক্ষা এবং রেশন প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। তারপর স্বাধীনতার অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও চা শ্রমিকদের জীবন বদলায় নি। এ সকল শ্রমিকরা মুলত পেশাগত কারণে চরম অবহেলার শিকার হচ্ছেন। কাজ করার স্বার্থে বসবাসের জন্য বাগান মালিকের পক্ষ থেকে নাম মাত্র খোপড়ি ঘর তৈরি করে দেয়া হয়। কিন্তু, তাদের কেউ ভূমির মালিকানার দাবিদার হতে পারে না। কাজ না থাকলে বা কাজ না করলে গৃহহীন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। মজুরি কম হবার কারণে আয়ের উৎস থেকে দু'পয়সা জমানোর ভাগ্যে জুটে না। কাজেই বড় কোন অর্থনৈতিক বিপত্তি দেখা দিলে কিংবা অসুস্থ হলে তারা আরো নি:স্ব হয়ে পড়ে। মশার কামড় খেয়ে বেড়ে উঠা এ সকল শ্রমিক জন্ম-জন্মান্তরে লড়াই করে চরম দুর্ভোগের মধ্যে জীবন গড়ে। দুর্ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে চা বাগানই হয়ে উঠে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সঙ্গত কারণেই চা শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার দায় বাগান মালিকদের।
কিছু কিছু বাগানে বিদ্যালয় থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। ফলে, তারা শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের চিকিৎসা সেবাও প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। পুষ্টিহীনতায় ভোগে শিশুরা বড় হয়। অন্যদিকে, শিক্ষার সু ব্যবস্থা না থাকায় তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো নেই। শিক্ষার আলো না পৌছায় বাল্য বিবাহের হার বেশি। যার ফলে মাতৃমৃত্যু হার বেশি। স্যানিটেশন ব্যবস্থা কি তারা এখনো সেটা বুঝে না। ফলে, কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া কিংবা পানিবাহিত রোগ লেগেই থাকে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যাÐ রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) ২০১৮ সালে চা বাগানে নারীদের উপর একটি গবেষণা তথ্য প্রকাশ করে। তথ্য মতে, চা শ্রমিক জনগোষ্ঠির প্রায় ১৫ শতাংশ নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত থাকে। বিবিএস- এর এক জরিপের তথ্যমতে, অপুষ্টির কারণে চা বাগানের ৪৫ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতি এবং ৪৭.৫ শতাংশ স্বল্প ওজনের হয়। তাতে আরো দেখতে পাওয়া যায়, ৪৬ শতাংশ মেয়েদের কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়, ৬৭ শতাংশ শ্রমিকদের ন্যূনতম স্যনিটেশন ব্যবস্থা নেই।
নিবিড় পরিচর্যায় যারা চা গাছগুলোকে প্রাণবন্ত করতে সাহায্য করে তারা হলো চা শ্রমিক। গাছ থেকে চায়ের কুঁড়ি সংগ্রহ করে পিঠে ঝুলানো থলের মাঝে ভরে রাখে। দিনশেষে কখন থলেটি ভরে উঠবে সেই অপেক্ষায় থাকে। কাঠফাটা রোদ কিংবা বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা চা সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। এমনকি করোনাকালীন সময়েও পূর্ণোদ্যমে চা কাজ করেছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই আমাদের চা শিল্পে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রয়েছে।
মুলত, আমাদের সামগ্রীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় চায়ের অবদান অনেক। আমাদের দেশীয় ভোক্তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশেও চা রপ্তানী হয়। কাজেই, চা শিল্পকে প্রাধান্য দিতে হলে অবশ্যই চা শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিকতা থাকতে হবে। সেজন্য চা বাগানের শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা মেটানো, পুষ্টির স্তরের উন্নয়নসহ শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন করতে হবে। পাশাপাশি চা বাগানে জনস্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে সক্ষম করে তুলতে হবে।

 

অন্জন কুমার রায়
ব্যাংক কর্মকর্তা ও লেখক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top