সিডনী মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নামের শুভঙ্করের ফাঁকি : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৩:১১

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০১:০৮

 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে গত এক দশকেরও বেশি সময় নানাভাবে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির সাথে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকার মিল না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপস্থিতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল।
দেখা যায় বড় বন্ধগুলো আগে- পরে হবার কারণে এবং বেশি -কম হবার কারণে অভিভাবকবৃন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছুটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়াতে যান। ফলে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা অনুযায়ী বিদ্যালয় খোলা থাকলেও উপস্থিতি আশংকাজনকভাবে কমে যায়।
ভিজিটে গিয়ে কর্মকর্তাবৃন্দ তখন উপস্থিতি কম থাকার জন্য শিক্ষকদের “শো কজ” করেন ।
এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য অনেক লেখালেখি করা হয় প্রাথমিক এবং মাধ্যমিকের ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করার প্রস্তাব রাখা হয়। অবশেষে এই প্রস্তাব অনুযায়ী দুই বিদ্যালয়ের ছুটির মোটামুটি একটা সমন্বয় করা হয়।
কিন্তু এ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা দেখে মনে হচ্ছে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। সবাই যখন ছুটি ভোগ করবে তখন তাদের বিদ্যালয়ে আসতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটির অবস্থা এখন ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের মতো। কারণ সমন্বয়হীনতার কারণে সারা বছরই ঢাকা শহরের রাস্তা কাটা থাকে। কখনো বিদ্যুৎ বিভাগ, কখনো ওয়াশা, কখনো তিতাস তাদের কাজের প্রয়োজনে রাস্তা কেটে তাদের কাজ করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের জন্য সীমাহীন দুর্ভোগ তৈরি করে। এই দুর্ভোগ বুদ্ধি হবার পর থেকেই দেখে আসছি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে গত এক দশকেরও বেশি সময় নানাভাবে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছুটির সাথে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকার মিল না থাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপস্থিতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছিল।
এ নিয়ে পত্রিকায় লেখা হয়, মিডিয়ায় প্রতিবেদন তৈরি হয়, কিন্তু কোনো সমাধান নেই।
হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তা কার্যকরী করতে গিয়ে লেজে গোবরে অবস্থা সৃষ্টি করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা সেরা। সময় যায় সমস্যা বাড়ে। সমাধান তো দূরের কথা, সমাধানের কোনো চেষ্টাই থাকে না।
করোনা শেষে দীর্ঘ বিরতির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর শীতকালীন অবকাশ রেখে ছুটির তালিকা প্রকাশ করা হলো। প্রাথমিক শিক্ষায় বেশির ভাগই নারী। চাকুরীজীবী মহিলাদের বাড়িতে মেহমান আসা, আত্মীয়দের বাড়ির উৎসব অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা, আত্মীয়দের পরিবারকে সময় দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ছুটিকে বেছে নেয়া হয়।
পরীক্ষা নেই, খাতা নেই, ভর্তির কোনো ঝামেলা নেই তারপরও ছুটির নির্ধারিত তারিখের আগের দিন দুপুরের পর প্রজ্ঞাপন জারি হলো ছুটি বাতিল। ছুটির তালিকায় বিশেষ বিশেষ দিবসগুলো ছুটি দেখানো হলেও ঐ দিনগুলোতে প্রতি শিক্ষককে বাধ্যতামূলক উপস্থিত থাকতে হয়।
লেখাপড়া বহির্ভূত দিন হিসাবে জাতীয় দিবসগুলোর নামকরণ হতে পারে। কোনমতেই ছুটির তালিকায় ছুটি হিসাবে এই দিনগুলো ব্যবহৃত হতে পারে না।
২০২২ সালের ছুটির তালিকায়ও ছিল শীতকালীন অবকাশ। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষা না নিয়ে যারা তাদের আশা আর বিশ্বাসে ভর করে এই অবকাশ নিয়ে নানা ধরনের প্রোগাম সেট করেছিলেন এবারও তারা অপমান আর হয়রানির সম্মূখীন হলেন।
অবশ্য বৃত্তি পরীক্ষার কারণ দেখিয়ে যে ছুটি বাতিল হয়েছে সে ছুটিতে আমরা কতিপয় শিক্ষকের কক্সবাজারে তোলা সেলফি দেখে ধন্য হয়েছি।
যেমন মাঝে মাঝেই দেখি এত এত ভিজিট পাহারাদারের মাঝও পাঁচ বছর/সাত বছর অনুপস্থিত থেকেও বেতন পাওয়া ক্ষমতাধর শিক্ষকদের।
প্রশাসন বুঝে গেছে সংখ্যায় সাড়ে চার লক্ষ হলেও প্রাথমিক শিক্ষকদের জোরে আওয়াজ তোলার ক্ষমতা, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মেরুদন্ড নেই।
অষ্টম শ্রেনি পাশ ড্রাইভারের চেয়ে মাস্টার্স পাশ প্রাথমিকের সহকারীর বেতন যখন এক ধাপ নিচে থকে তখন বুঝে নিতে হবে এদেশে লেখাপড়া করা বোকামী। ৬.৬৬ টাকা দৈনিক টিফিন ভাতা, ঝাড়ুদারের সমমানের বেতন, সামাজিক নানা অসম্মান শিক্ষকদের শিক্ষক হতে দেয়নি। ফলে, নিজেরা যেমন মেরুদন্ডহীন হয়েছে তেমনি মেরুদন্ডহীন উন্নতমানের চোর তৈরি হচ্ছে দিন দিন এদেশের শিক্ষিত সমাজ।
অতীত সমস্যার সামাধান হয়ে আশা আর সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয় মানুষের নতুন বছর। কিন্তু বছরের শুরুতেই ছুটি নিয়ে অসম্মান দিয়ে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের নতুন বছর।
প্রাথমিকের ছুটি সবচেয়ে কম অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্টের কারণে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
ভ্যাকেশন ছাড়া ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট কী করে হয়? উর্ধ্বতনমহল দয়া করে এ প্রশ্নের উত্তরটি কি দিবেন?
শিশু মনোবিজ্ঞান না পড়েই নীতি নির্ধারণ করলে যা হয় তা প্রতি পদে পদে অনুভব করা যাচ্ছে। শিক্ষার চারটি স্তরের প্রথম স্তর এবং সবার জন্য উন্মূক্ত প্রাথমিক স্তর।
ছুটি, স্কুলের সময়, বিনোদন, খেলাধুলা, বাজেট সবদিক দিয়ে শিশুদের বয়স, সামাজিক অবস্থান, ভৌগলিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থান নানা দিক বিবেচনা করে শিক্ষার চারটি স্তরকে মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী।
হুটহাট অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্তগুলো দেখলে মনে হয়, শিক্ষার উন্নয়নের চেয়ে শিক্ষকদের টাইট দেয়াই মূল উদ্দেশ্য। শিক্ষকতা চাকুরী নয়, ব্রত। নানা ধরনের অসম্মান, নির্যাতন, দুর্নীতির কারণে শিক্ষক শব্দ বিলুপ্তির পথে। শিক্ষক শব্দ ধারণের ক্ষমতা জাতিগতভাবেই আমরা হারিয়েছি। ফলে, শিক্ষার দায়িত্ব শিক্ষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়েছি আমলাদের হাতে।
কোচিং খোলা রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। ছুটি নামক শুভংকরের ফাঁকি আর “ ভ্যাকেশনাল ডিপার্টমেন্ট” নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই আমরা এ বছর।
বিখ্যাত পাকিস্তানি লেখক মারহুম আশফাক আহমেদ লিখেছেন, রোমে (ইতালি) ব্যস্ত থাকার কারণে আমি সময় মতো ফি জমা দিতে পারিনি, যার কারণে আমাকে আদালতে যেতে হয়েছিল।
বিচারকের সামনে হাজির হলে, তিনি কারণ জিজ্ঞাসা করলেন।
আমি বলেছিলাম যে আমি একজন অধ্যাপক, আমি ভীষণ ব‍্যস্ত ছিলাম তাই সময় পেলাম না।
আমি শেষ করার আগে বিচারক বলেছিলেন -

*A TEACHER IN THE COURT ....!*

এবং প্রত্যেকে উঠে দাঁড়াল এবং আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে চালান বাতিল করে দিল, সেদিন আমি জানতে পারলাম সে দেশের সাফল্যের রহস্য!
সম্মানিত নীতি নির্ধারকবৃন্দ ---শিক্ষকদের অবহেলা, অবজ্ঞার ফলাফল কি দেখতে পাচ্ছেন? বাড়ছে জনসংখ্যা কিন্তু মানুষ কি তৈরি হচ্ছে? মানুষহীন দেশে পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল দিয়ে কী করবেন?
বছরের শুরুতেই বিষয়টা ভেবে দেখবেন আশা করি।

 

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top