সিডনী শনিবার, ৫ই অক্টোবর ২০২৪, ২০শে আশ্বিন ১৪৩১

অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে গত অর্ধশত বছর যাবৎ এ জাতিকে দয়া করছেন প্রাথমিকের শিক্ষকবৃন্দ : শাকিলা নাছরিন পাপিয়া


প্রকাশিত:
৯ মার্চ ২০২৩ ০০:৪১

আপডেট:
৯ মার্চ ২০২৩ ০১:০৫

 

জাতিগতভাবেই আমরা যে অকৃতজ্ঞ সে প্রমান ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট দিয়েছি। একটু নিবিড়ভাবে যদি ভাবি তাহলে দেখবো স্বাধীনতার অর্ধ শত বছর পার হবার পর আমাদের অর্জন অবাক হবার মতো অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু শিক্ষক, যারা গুরু এবং যে গুরু অক্ষরজ্ঞান শিক্ষা দিয়ে আমাদের জ্ঞানের অন্ধত্ব দূর করেন শুধু তাদের জীবনমানে কোন পরিবর্তন আসেনি।
সময়ের সাথে সাথে প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় পরিবর্তন এসেছে কিন্তু তাদের বেতন গ্রেডে তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি।
আমরা কি কখনো ভেবেছি আমরা যে শিক্ষাগুরুদের কাছে প্রথম আমাদের বর্ণমালা চিনতে শিখেছি তাদের আমরা জাতিগতভাবে দরিদ্রতা ছাড়া আর কী উপহার দিয়েছি? শৈশবের গুরুদের নিয়ে পরিণত বয়সে কি ভেবেছি? যে শিক্ষক তার সময়, জীবনের ভোগ বিলাস সব বিসর্জন দিয়ে শুধু শিশুদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে দেন পুরোটা জীবন সে শিক্ষকের কী অবহেলা, অপমানের জীবন প্রাপ্য? কেন জাতিগতভাবে আমাদের মনে হয় না, অন্যসব পেশার মানুষ যখন তড়তড় করে ওপরে উঠে যায়, আর্থিক সুবিধা ভোগ করে তখন একজন শিক্ষক সময়ের সাথে তার জীবনমানে পরিবর্তন না এনে ঠাঁয় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কর্তব্য পালন করে এ জাতিকে দয়া করে! মা বাবার ঋণ কি টাকায় শোধ হয়? তাহলে গুরুর ঋণ কী করে টাকায় শোধ হয়?
কিছু কুলাঙ্গার, অহংকারী কথায কথায বলে, না পোষালে চাকরী ছেড়ে দেন। ওনারা জানেন না, শিক্ষকতা চাকুরী নয় পেশা। সম্ভবত মা বাবার সাথেও তাদের আচরণ একই। যদি উন্নত সভ্য দেশগুলোর প্রতি লক্ষ করি তাহলে দেখবো সেসব দেশে শিক্ষকের মর্যাদা অন্য সব পেশার চেয়ে উর্দ্ধে।

আসুন কয়েকটি দেশে শিক্ষকদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা জানি,

১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ভিআইপি বিবেচনা করে এমন দুটি ধরণের লোক রয়েছে: বিজ্ঞানী ও শিক্ষক।
২) ফরাসী আদালতে কেবল শিক্ষকদেরই চেয়ারে বসার অধিকার রয়েছে।
৩) জাপানের পুলিশ সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার পরেই একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করতে পারে।
৪) দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি শিক্ষক কেবল তার আই-কার্ড প্রদর্শন করে দক্ষিণ কোরিয়ার মন্ত্রীর সমস্ত অধিকার পান।
৫) আমেরিকান এবং ইউরোপীয় দেশগুলিতে প্রাথমিক শিক্ষকরা সর্বাধিক বেতন পান, কারণ তারা কেবল কাঁচা মাটি পাকা করেন।
৬) ফিনল্যান্ডে টপারদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে।

আমাদের দেশে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যই শুধু নয় শিক্ষকদের অসম্মান অপমান করে কথা বলার মাঝে এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ খুঁজে পায় কেউ কেউ।
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুত গতিতে। দ্রব্যমূল্য যেমন আকাশ ছুঁয়েছে, জীবন যাপনের খরচ যেমন বেড়েছে তেমনি পরিবর্তন এসেছে বিভিন্ন পেশাজীবি, চাকুরীজীবিদের বেতনে। দেশ যখন আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে ছিল তখন শিক্ষক সমাজ নিজেদের উন্নত জীবনমানের কথা না ভেবে, এ জাতিকে এদেশকে অক্ষরজ্ঞান দান করেছেন সামান্য বেতনের বিনিময়ে। এখন দেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। যথেষ্ট সক্ষম। তাহলে উন্নত দেশের মতো সম্মান আর বেতনে কেন শিক্ষকদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হবে না?

একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় অন্যদের সাথে শিক্ষকদের বৈষম্যের চিত্রটা হলোঃ

১/ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ যোগ্যতা ঃ স্নাতক/ সমমান -- ১০ ম গ্রেড।
২/ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টরদের নিয়োগ যোগ্যতা ঃ স্নাতক/ সমমান-- ১০ম গ্রেড।
৩/ উপ- সহকারী কৃষি কর্মকর্তা-- শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ স্নাতক/ সমমান-- ১০ গ্রেড।
৪/ নার্স-- এসএসসি, ডিপ্লোমা-- ১০ ম গ্রেড।
৫/পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ শিক্ষাগত যোগ্যতা ঃ স্নাতক ( ২য় বিভাগ)।
৬/ ড্রাইভার ঃ অস্টম শ্রেণি পাশ --১২ তম গ্রেড।
৬/প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক -- শিক্ষাগত যোগ্যতা ঃস্নাতক ( ২য় বিভাগ)-- ১৩ তম গ্রেড

এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অর্ধশত বছর পর আওয়াজ তুলেছে প্রাথমিকের শিক্ষকবৃন্দ।

এই আওয়াজ পছন্দ হয়নি অনেকেরই। তারা প্রাথমিকের শিক্ষকের যে চিত্রটি দেখতে পছন্দ করেন তা হলোঃ
"দুর্বল, অসহায়, দরিদ্রতার ভারে ন্যুজ্য, মলিন পোশাক জীবন যুদ্ধে পরাজিত এক নুয়ে পড়া মানুষ।"
সম্প্রতি জনৈক সচিব মহোদয়ের অমৃত বাণী, " ১১ হাজার থেকে ২২হাজার দিলেই কি ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে? বিশ বছর আগের এসএসসি পাশ শিক্ষকরা ডেডিকেটেড ছিলেন। শিক্ষকতা চাকুরী নয়, ব্রত।"
একজন শিক্ষক হিসাবে জানতে চাই, শিক্ষক শব্দের অর্থ কি উনি জানেন? বিশ বছর আগে ছিল বিএনপির শাসন। তাহলে বিশ বছর পর আওয়ামী লীগের অর্জন কী? ডেডিকেটেড হবার দায় শুধুই শিক্ষকের?
শিক্ষকরা কি এলিয়েন? তাদের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চিকিৎসা থাকতে নেই?
এসএসসি পাশ দিয়েই যদি চলবে তাহলে নিয়োগ নীতিমালায় কেন স্নাতক চাওয়া হলো? এটা কি তাহলে প্রতারণা নয়?
লক্ষ লক্ষ শিক্ষকদের অপমান, অসম্মান করে এই যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ শব্দ চয়ন এর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে এই সচিবকে। একের পর এক এ ধরণের অসম্মানজনক কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। ফলে, শিক্ষকদের সৌজন্যকে দুর্বলতা ভেবে শিক্ষকদের অপমান করতে মনুষত্বে বাঁধছে না।
উনি বাংলা ঠিকমতো উচ্চারনের যোগ্যতা রাখেন না। প্রমিত উচ্চারণে বাংলা বলতে পারেন না বলেই, কোন একটা বাক্য পুরো বলতে পারেন নি। ডেডিকেটেড শব্দটি বলতে পেরেছেন স্পষ্টভাবে। এই ডেডিকেটেড শব্দ দিয়েই অসম্মান করেছেন সাড়ে চার লক্ষ শিক্ষকদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদেরই পদোন্নতি দিয়ে নিয়োগ দেয়া উচিত। শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তির কাছে শিক্ষকদের সাথে বিনয়সুলভ আচরণের পরিবর্তে হালার রুজির উপদেশই বেশি পাওয়া যায়। আশাকরি, শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে উনি সৌজন্যের এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top