সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


ফিরোজা বেগম: নজরুলসঙ্গীত সাধিকা : ড. আফরোজা পারভীন


প্রকাশিত:
২৯ জুলাই ২০২০ ০০:৩০

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১০:২৬

ছবিঃ  ফিরোজা বেগম

 

ফিরোজা বেগম (২৮ জুলাই ১৯৩০ - ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪) বাংলাদেশের কিংবদন্তি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী। নজরুল সঙ্গীতের জন্য তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারত উপমহাদেশে।
ফিরোজা বেগম ১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই গোপালগঞ্জ জেলার রাতইল ঘোনাপাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল এবং মায়ের নাম বেগম কওকাবুন্নেসা। ত্রিশের দশকের সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে স্থানীয় ব্রিটিশ অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনা, গল্পগুজব চলত অহর্নিশ। ঘন্টায় ঘন্টায় চা-জলখাবার আসত। পরিবার প্রধান খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল ফিরোজার পিতা। বৃটিশ সরকারের কৌঁসুলি তিনি। তিনিই প্রথম মুসলমান সরকারি কৌঁসুলি। তাদের তিন ছেলে, চার মেয়ে। এদেরই তৃতীয় কন্যা ফিরোজা।
শৈশবেই সঙ্গীতের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মে। ১৯৪০-এর দশকে তিনি সঙ্গীত ভুবনে পা রাখেন । ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গানে কন্ঠ দেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে চিত্ত রায়ের তত্ত্বাবধানে তাঁর ইসলামী গানের প্রথম রেকর্ড বের হয়। তিনি গেয়েছিলেন ‘মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল’ গানটি। সেটা ১৯৪২ সাল। এর কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে তাঁর উর্দু গানের রেকর্ড বের হয়। এগুলো হলো- ‘ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ’ এবং ‘প্রীত শিখানে আয়া’ । কিছুদিনের মধ্যেই পরপর চারটি রেকর্ড বের হলো । বরাবরই কঠিন সুর শেখার দিকে ঝোঁক ছিল তাঁর। এ নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতো। ১২ বছর বয়সে প্রথম রেকর্ড বের হলেও তিনি মঞ্চে প্রথমবার গান করেন অনেক পরে, ১৯৭২ সালে। পরিবারের কাছ থেকে গান-বাজনা করার উৎসাহ পেয়েছিলেন। তাই সঙ্গীত সাধনায় তাঁর কোনো বাধা ছিল না।
দশ বছর বয়সে ফিরোজা বেগম কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি তাঁর কাছে গানের তালিম গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে নজরুল ইসলামের গান নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়।
এক গ্রীষ্মের ছুটিতে ফিরোজা ছোট মামা আর চাচাতো ভাইদের সঙ্গে কলকাতায় গেলেন । ভাগ্নিকে নিয়ে মামার বড়ই উচ্ছ্বাস। ভাগ্নি খুব ভালো গান জানেন। তিনি মামার বন্ধুদের গান শোনাচ্ছেন। ছোট্ট মেয়ের গায়কীতে মুগ্ধ সবাই। এমনই একদিন গুণীজনদের মজলিসে গান শুনিয়ে খুবই প্রশংসিত হলেন ফিরোজা। বাসায় ফিরে মামা বললেন, ‘জানিস তুই কাকে গান শুনিয়েছিস আজ?’ ‘আমি কী করে জানব? আমি কি ওদের চিনি, দেখেছি নাকি কখনো?’ মামা বললেন, ‘ওই যে টুপি পরা, বড় চুল, আসরের মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন, তোকে আদর করে পাশে বসালেন, উনি বিখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম।’
পরবর্তীকালে একাধিক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আসলে আমি তখন অনেক ছোট। তাছাড়া এমন পরিবেশে যাইনি কখনো। তাই তাকে তো চেনার কথাও নয়। নজরুলের ছবি পাঠ্যবইতেও দেখিনি। কারণ তখনও তার ছবি বইতে ছাপা হয়নি। ফলে আমার মধ্যে আলাদা কোন অনুভূতি হয়নি। সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একজন মেয়ে গান গাইছে, গান গাইতে চায়, এটা জেনে দারুণ খুশি হয়েছিলেন নজরুল। আমার গান শুনে বলেছেন, ‘এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?’ বলেছি, কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি। এটা শুনে কেবল তিনি নন, উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছেন।” সেদিন নজরুলকে তিনি শুনিয়েছিলেন, ‘যদি পরানে না জাগে আকুল পিয়াসা’।
১৯৫৪ সাল থেকে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন তিনি। ১৯৫৫ সালে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কমল দাশগুপ্তের সাথে দেখাও কবি নজরুলের কারণে। প্রথমবার কবিকে গান শোনাবার সময়, কবি কমল দাশগুপ্তকে ডেকে এনেছিলেন ছোট মেয়েটির অদ্ভুত সঙ্গীত প্রতিভা দেখাতে। কমল দাশগুপ্ত কবির খুব প্রিয় একজন সংগীতকার ছিলেন। কবি শুধুমাত্র তাঁকেই অধিকার দিয়েছিলেন নিজের লেখা গানে সুর বসাবার। কমল দাশগুপ্ত প্রতিভা চিনতেন। তাঁর হাত দিয়েই গানের জগতে যুক্ত হয়েছেন অনেক নামি শিল্পী। ফিরোজা ও কমলের প্রেম কাহিনি তখন বাতাসে ভেসে বেড়াতো। দুই বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, তাতে দুজনের ধর্ম ভিন্ন। আলোচনা, নিন্দা, চর্চা করার অনেক উপাদানই পেয়েছিল মানুষ। তবে এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনা ছিল না এই শিল্পীযুগলের। একসাথে আধুনিক ও নজরুলসঙ্গীত গাইতেন। বিয়েও করলেন। নিজেদের বন্ধনকে তাঁরা সঙ্গীতেও প্রকাশ করেছেন, “মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান” (১৯৭২ সালে রবীন্দ্র সদনে গাওয়া)। স্বচ্ছল ছিল না তাঁদের সংসার। তাঁদের বিয়ে ফিরোজার বাবা-মা মেনে নেননি। কিন্তু ফিরোজা নিজে যা বিশ্বাস করেছেন তাকেই সব সময় অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কলকাতেই জন্মেছে তাঁর তিন সন্তান- তাহসিন, হামীন ও শাফীন। তখন স্বর্ণকণ্ঠী ফিরোজার গানের স্বর্ণযুগ । অথচ স্বামী-সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে টানা ৫ বছর গান গাইতে পারেননি তিনি। দারিদ্র্য এবং বিরূপ প্রতিকূলতা বহুবার ত্াদের সংসারে ছায়া ফেলেছে। কিন্তু একসাথেই ছিলেন তাঁরা। শুধু মৃত্যুই তাঁদের আলাদা করতে পেরেছিলো।
১৯৬৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় বঙ্গ-সংস্কৃতি-সম্মেলন-মঞ্চে কমল দাশগুপ্তের ছাত্রী ও সহধর্মিণী হিসেবে তিনি ছিলেন মুখ্যশিল্পী। উভয়ের দ্বৈতসঙ্গীত সকল শ্রোতা-দর্শককে বিমোহিত করেছিল। আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়েন কমলবাবু। ২০ জুলাই, ১৯৭৪ তারিখে কমল দাশগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন। যতি পড়ে মাত্র ১৮ বছরের সুখময়, সুরময় দাম্পত্যের।
এ দম্পতির সন্তান - তাহসিন, হামীন ও শাফীন। । হামিন ও শাফিন রকব্যান্ড দল মাইলসের সদস্য।
ফিরোজা বেগম এক ব্যতিক্রমী শিল্পী। খ্যাতি তাঁকে কখনোই বিচলিত করেনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীতের সাধক। খ্যাতি বিত্ত কোনোটার পিছনে ছোটেননি। প্লেব্যাক করেননি।
ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন নিজের ব্যাপারে সচেতন। নিজস্ব স্টাইল ছিল তাঁর। ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী। সাথে ছিল
ব্যক্তিত্বের বিভা। আমৃত্যু নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন প্রচারের প্রখর আলো থেকে। যেমন ছিল অসাধারণ মাধুর্যময় গলা, তেমনি দেখতে, মানুষ হিসেবে অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়।
শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্প অবলম্বনে নির্মিতব্য ছবিতে ‘আমিনা’ চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু রাজি হননি তিনি। নিজেকে সব সময় আলাদা রেখেছেন । আলাদা রেখেছেন গানের ক্ষেত্রেও। আর কোনো গান নয়, সে গান নজরুলগীতি।
নজরুল যখন গান লিখছেন তখন নজরুল সঙ্গীত বলা হতো না, বলা হতো আধুনিক গান। পরে ‘নজরুল গীতি’ বলা হয়। আর এর পেছনে ফিরোজা বেগমের চেষ্টার কমতি ছিল না।
এক নাগাড়ে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় সঙ্গীত সাধনার নজির পৃথিবীতে আর নেই। সারাবিশ্ব তিনি পরিভ্রমণ করেছেন নজরুলের গান নিয়ে। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগ্রহে তাঁকে নজরুল সঙ্গীত ও অতুলপ্রসাদের গান শিখিয়েছেন ফিরোজা।
সুস্থ অবস্থায় ফিরোজা বেগম নজরুলের সঙ্গ পান প্রায় তিন বছর। কবি অসুস্থ হবার পর থেকে তাঁর গানের সংগ্রামের ভার অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে নজরুলের গানের অনুষ্ঠানকে তিনিই বাধ্যতামূলক করেন। সুরের সকল শুদ্ধতা বজায় রেখে নজরুলসঙ্গীতকে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন শ্রোতৃসমাজের কাছে। নজরুল সঙ্গীতের কোনো প্রকার বিকৃতি তিনি মেনে নিতে পারতেন না কখনোই, তাই সবসময় শুদ্ধ স্বরলিপি ও সুর সংরক্ষণের দিকে মন দিয়েছেন। নজরুলের পর তিনিই নজরুলসঙ্গীতের প্রথম স্বরলিপিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
তিনি নজরুলসঙ্গীতের প্রতি তাঁর প্রেমকে অনেকটাই ব্যক্তিগত আন্দোলনের দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “১৯৪৯ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি আমার গলায় নজরুলের গান রেকর্ড করতে রাজি হয়। তখন আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা গেয়েছিলাম। পুজোর রেকর্ডের ক্ষেত্রেও আমি একই সিদ্ধান্তে অবিচল থেকেছি । এজন্য আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। শেষপর্যন্ত জয় আমারই হয়েছে। কোম্পানি পুজোয় আমার গাওয়া নজরুল সংগীতের রেকর্ড বাজারে ছাড়তে রাজি হয়েছিল”।
নজরুলসঙ্গীতের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা ছিল। গোটা জীবন ধরে সে ক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন তিনি। নজরুলসঙ্গীত যখন খুব কম মানুষ শুনতো, তিনি তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু নজরুলের গানই গাইবেন। সকলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে। বুঝিয়েছিলেন, অন্য গান ছেড়ে দিলে তাঁর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়বে, “নজরুলের গান ক’জনই বা শোনে!” আধুনিক গান গেয়ে তাঁর প্রচুর খ্যাতি হয়েছিল তখন। খ্যাতির মোটামুটি শীর্ষে উঠে তাঁর নেয়া এ সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে নিছক আবেগ বলেই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কিন্তু তিনি ঠিক করেছিলেন নজরুলের গান গেয়েই তিনি সকলের কাছে জনপ্রিয় হবেন, জনপ্রিয়তার মুকুট পরবেন নজরুলসঙ্গীতে।
ফিরোজা বিশ্বাস করতেন,
“নজরুলের গান ভালোভাবে গাওয়ার জন্য প্রয়োজন তাঁর গানের চিত্রকল্পগুলোকে রপ্ত করা; সেই সৌন্দর্যকে অন্তরে ধারণ করে প্রকাশ করতে হবে যেমন- আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই অথবা শিয়রে গিরিরাজ হিমালয় প্রহরী/আশিস মেঘবারি সদা তার পড়ে ঝরি ইত্যাদি”।
তাঁর প্রিয় গানের তালিকায় শীর্ষে ছিল ‘দূর দ্বীপবাসিনী’, ‘ মোমের পুতুল’, ‘ খেলিছে জলদেবী’, ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’, ‘নূরজাহান’, ‘ কে বিদেশি বন উদাসী’, ‘রুম ঝুমঝুম খেজুর পাতার নূপুর’, ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ’, ‘বুলবুলি নিরব নার্গিস বনে’, ‘বনমালার ফুল’, ‘বলেছিল তুমি আসিবে’, ‘চাঁদ সুলতানা’, ‘ মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’, ‘নয়ন ভরা জল গো তোমার’, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো’ ইত্যাদি।
তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হিসেবে ধরা হয় ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ ও ‘ মোমের পুতুল’কে। ১৯৬০ সালে দুর্গাপূজায় গান দুটির রেকর্ড বেরিয়েছিল। সুরের ঝঙ্কারে মমির দেশের মেয়ের গল্প বলেছিলেন তিনি। অন্য গানে তিনি বলেছিলেন, দূর দ্বীপবাসিনীকে চেনেন। এ দুটি গান তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়।
সংস্কারমুক্ত মানুষ ছিলেন। অভিজাত মুসলমান পরিবারের মেয়ে হয়েও গান করেছেন। শুধু গান করেনইনি, সমগ্র জীবন সঁপে দিয়েছেন গানের জন্য।
প্রেমের গান, ভক্তি কিংবা বিরহের গানেও তিনি ছিলেন অনবদ্য, সিদ্ধকণ্ঠ। নজরুলের যোগ্য শিষ্যাই ছিলেন তিনি। দ্রোহ ছিল সহজাত, পাকিস্তান শাসন আমলে উর্দুর আগে বাংলা গান গেয়েছেন বেতারে, কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করেননি। খাজা শাহাবুদ্দীনকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বাংলা গানই গাইবেন আগে। ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’ গানটি।
সত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে দৃপ্ত প্রত্যয়ে একের পর এক বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়ে গেছেন। পাকিস্তানের ভূমিতে তিনি ‘জয় বাংলার জয়’ গাইবার সাহস দেখিয়েছিলেন। একদিন এজন্যই তাঁকে রেডিও স্টেশন থেকে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে তাঁর গানের সব রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার আগে তাঁকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। পাকিস্তানী শাসকদের রোষানলে, কোপানলে ছিলেন তিনি। যথেষ্ট কারণও ছিল । পাকিস্তানিরা জানতো স্বাধীন বাংলার সংস্কৃতির হাল ধরতে তিনি একটি শক্ত স্তম্ভ হবেন।
ফিরোজা বেগম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৩৮০টির বেশি একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। নজরুলসঙ্গীত ছাড়াও তিনি আধুনিক গান, গজল, কাওয়ালি, ভজন, হামদ ও নাত-সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীতে কন্ঠ দিয়েছেন। জীবদ্দশায় তাঁর ১২টি এলপি, ৪টি ইপি, ৬টি সিডি ও ২০টিরও বেশি অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে।
কিডনি জটিলতায় ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪, মঙ্গলবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
মারা যাবার কিছুদিন আগেও নবীন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে তিনি নজরুলসঙ্গীত শেখাতেন। নিজের যন্ত্রসঙ্গীত, গানের রেকর্ড, গানের স্বরলিপিগুলো নিজ হাতেই গুছিয়ে রাখতেন ফিরোজা বেগম।
ফিরোজা বেগমের সংগ্রাম, গানের প্রতি তাঁর সর্বোচ্চ আন্তরিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১৯৭৯ সালে প্রাপ্ত ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’, একুশে পদক, নেতাজী সুভাষচন্দ্র পুরস্কার, সত্যজিৎ রায় পুরস্কার, নজরুল আকাদেমি পদক, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক, সেরা নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে গোল্ড ডিস্ক, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। ১২ এপ্রিল ২০১২ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে "বঙ্গ সম্মান" পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। বাংলা ১৪০০ সালে কলকাতার সাহিত্যিক-শিল্পীদের দেয়া সংবর্ধনা পান তিনি। ‘এক বৃন্তে দুটি কুসুম’ শিরোনামে নজরুল সঙ্গীতে ফিরোজা বেগম এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুচিত্রা মিত্রকে এ সম্মান জানানো হয়।
এ উপমহাদেশে নজরুলসঙ্গীত জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। নজরুলসঙ্গীতের প্রসারে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হলেও তাঁকে সেভাবে মূল্যায়িত করা হয়নি। কি এক অজ্ঞাত কারণে দীর্ঘ কয়েক বছরে কোনো বিদেশ সফরে তাঁকে নেয়া হয়নি। ভারত আর পাকিস্তান মিলিয়ে এই কিংবদন্তির রেকর্ডসংখ্যা ১ হাজার ৬০০টি, সেখানে বাংলাদেশে খুবই কম।
জানি না, এর নেপথ্যে কী কারণ ছিল! বা কোনো কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র আন্তরিকতার অভাবেই এটা ঘটেছে কীনা। তাঁর যেসব গান এখনও রেকর্ড হয়নি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার এখনও সময় আছে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

ড. আফরোজা পারভীন
কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, কলামলেখক
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top