রিনার ভালবাসা : তিয়েন আন্দালিব (২য় পর্ব)
প্রকাশিত:
১৮ এপ্রিল ২০২০ ০১:৪৪
আপডেট:
১৮ এপ্রিল ২০২০ ০১:৪৬

ইশ কি কষ্টই না লাগছিল শরিফার! বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কি যেন। চলে যাওয়ার সময় মানুষটার দিকে সে তাকাতেই পারছিল না। নিশ্চয় অপমানে-কষ্টে মানুষটার চোখ মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছিল। বাইরে গিয়ে নিশ্চয় সে কেঁদেছে। অনেক কেদেঁছে। শরিফা নিজেই তখন ঝর ঝর করে কাঁদছিলেন। কান্না আর থামছিল না তার। এক নাগারে কেঁদেই যাচ্ছিলেন। এশার আযান পড়ার পর হটাত কান্না থামিয়ে একদম স্বাভাবিক হয়ে গেলেন।
শরিফা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে রিনার ঘরের দিকে এগিয়ে যান। পাত্রের ছবিটা রিনাকে দেখাতে হবে। রিনা তার বাবার পছন্দ করা পাত্রের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর ভাঙা গলায় বলে, মা! শরিফা বলেন, কি মা পছন্দ হল? রিনা হটাত মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। শরিফা ভীষন অবাক হয়ে মেয়েকে আদর করতে করতে বলেন, কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন?
-মা আমি সুমনকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
-আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। এত কাঁদছিস কেন?
-মা প্লিজ তুমি কিছু একটা কর মা।
-আচ্ছা আচ্ছা, আমি দেখছি। কান্না থামা তো!
করিম সাহেব পানি খেতে গিয়ে স্পষ্ট শুনলেন, রিনা কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘মা আমি সুমনকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না মা।‘ করিম সাহেব বুকে একটা ধাক্কার মত খেলেন। তার হিসাবে কি কিছু ভুল হয়ে গেল? হটাত করে তার নিজের সংসারকে অচেনা মনে হতে লাগল। মনে হল এটা তার নিজের বাসা না। অন্যকারো বাসায় তিনি ভুলে এসে পরেছেন। তিনি ধীরে ধীরে রিনার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।
রিনা মাকে জড়িয়ে কাঁদার সময় হটাত চমকে উঠে বলে, বাবা!
শরিফা রিনাকে ছেড়ে দিয়ে তার স্বামীর দিকে তাকান। করিম সাহেব কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিজের ঘরে চলে গেলেন। একটু পরেই করিম সাহেবের বুকে ব্যাথা শুরু হল। ভয়ানক ব্যাথা। মনে হল সমস্ত জগত তার বুকে চেপে বসেছে। তিনি চিৎকার করে উঠলেন। শরিফা আর রিনা আতঙ্কে অস্থির হয়ে ডাক্তার ডাকলেন। করিম সাহেবকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। হাসপাতালে যাওয়ার আগে করিম সাহেব রিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা, তোর যাকে পছন্দ তুই তাকেই বিয়ে করিস!’ রিনা ঝর ঝর করে কেঁদে উঠ বলে, ‘না বাবা। আমি তোমার পছন্দেই বিয়ে করব। প্লিজ তুমি সুস্থ হয়ে আস। প্লিজ!’
-আমার সময় শেষ রে মা। আল্লাহ ডাক দিয়েছেন। আল্লহর ডাককে কি উপেক্ষা করা যায়? একটাই আফসস, তোর বিয়েটা দেখে যেতে পারলাম না। মা তুই কিন্তু তোর পছন্দের মানুষকেই বিয়ে করবি!
-না বাবা না!
রিনা কাঁদতেই থাকে।
হাসপাতালে নেয়ার সাথে সাথেই করিম সাহেব মারা গেলেন। শরিফার সংসারে নেমে এল ঘন কাল আঁধার।
বাবা মারা যাওয়ার পর রিনা ভীষণ অন্যরকম হয়ে গেল। নিজেকে গুটিয়ে নিল শামুকের মত। একদম চুপচাপ থাকে। কারো সাথে তেমন কথা বলে না। সারাদিন বিছানায় পড়ে এপাশ ওপাশ করে। রাত হলে আকাশের তারার দিকে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। শরিফা মেয়েকে দেখে চমকে চমকে উঠেন। একি অবস্থা হয়েছে মেয়ের! শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। মুখটা রক্তশুন্য ফ্যাকাশে। মেয়ের চিন্তায় শরিফার পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হল। রাতে ঘুমুতে পারেন না। ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন দেখেন। ঘুরে ফিরে তার সুমন ছেলেটার কথা মনে হতে থাকে। রিনাকে স্বাভাবিক করার জন্য সুমনের ভালবাসাই কি যথেষ্ট নয়?
শরিফা একদিন নিজে থেকে সুমনকে ডেকে আনলেন। তাকে রিনার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সুমন রিনাকে দেখে ভয়ানক চমকে উঠল। কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলল। কি হয়েছে তার রিনার? এরকম মরার মত লাগছে কেন? রিনার পাশে বসে সে ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিয়ে তাকিয়ে থাকে।
রিনা সুমনকে দেখে বেশ স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল, মা! এখানে দুই কাপ চা দাও তো!
চা খেতে খেতে রিনা সুমনকে বলল, ‘কি রে সুমন, কেমন আছিস?’
সুমন বলে, ‘আমি তো ভাল। কিন্তু তোর একি অবস্থা রে রিনা!’
রিনা শান্ত গলায় বলে, ‘সুমন তোকে একটা কথা বলি।‘
-হ্যা বল।
-যে ভালবাসা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে সেই ভালবাসা তো আমি টিকিয়ে রাখতে পারি না!
সুমন আহত গলায় বলে,’ কিন্তু রিনা, আগেও তোকে একবার বলেছি। যে ঘটনা ঘটেছে সেটা তো একটা কাকতলীয় ব্যাপার। তুই শুধু শুধু আমাদের ভালবাসাকে দায়ী করছিস কেন?’
-‘কাকতলীয় হোক আর যাই হোক, আমাদের ভালবাসার কথা শুনেই বাবার হার্ট এটাকটা হয়েছিল।‘
বলেই রিনা বিছানায় মুখ ফিরে শুয়ে পড়ল।
সুমন বলল,’ কিন্তু, কিন্তু এখানে আমার দোষটা কোথায়? আমার কেন শাস্তি পেতে হবে রিনা?
রিনা গম্ভীর কন্ঠে বলল,’ প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর। ধরে নে প্রকৃতি তোর সাথে একটা নিষ্ঠুরতা করেছে।‘
সুমন হতভম্ব হয়ে রিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে গিয়েও আর বলে না। বুঝতে পারছে এই মেয়েকে বোঝানোর সাধ্য জগতের কারো নেই। এক বুক হতাশা নিয়ে সুমন বাইরে বেরিয়ে আসে। মনে হচ্ছে যেন নিজের প্রাণটাকে রেখে চলে আসছে। রিনা ছাড়া তার কি আছে? কি আছে? বুক ঠলে অবাধ্য অশ্রু বের হয়ে আসতে চায়। ঠোটঁ কামড়ে সে নিজেকে সামলিয়ে নেয়। একটা সিগারেটের দোকান তার চোখে পড়ে। সে প্রায় দৌড়ে সেখানে যায়। অনেকদিন পর সিগারেট খাওয়াটা যেন জরুরি হয়ে পড়ে।
শরিফা এখন দিন রাত নামায পড়েন। মেয়ের জন্য দোয়া করতে থাকেন। আল্লাহ তুমি মেয়েটাকে ভাল করে দাও, আমি আর কিছু চাই না। শুধু মেয়েটার মুখে আবার হাসি ফুটাও। তার হাসিতে আবার ঘর আলো করে দাও। আল্লাহ যেন শরিফার প্রার্থনা কবুল করলেন। একদিন হটাত করেই রিনা একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল। সেদিন পূর্নিমার রাত ছিল। এশার আযানের পর পর রিনা হটাত করে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। রান্নাঘরে গিয়ে নিজে হাতে দুই কাপ কফি বানাল।
কফি নিয়ে রিনা মায়ের ঘরে এসে পড়ল। মায়ের দিকে কফি বাড়িয়ে দিল। তার মুখ হাসি হাসি। বলল,’ মা কফি নাও। অনেকদিন কফি খাই না, আজ খেতে ইচ্ছা করল, তাই বানিয়ে এনেছি!’
আনন্দে শরিফার চোখে পানি এসে গেল। তিনি এক হাত দিয়ে চোখের কোণা মুছে বললেন,’ আয় মা, বস। বস আমার পাশে।
রিনা মায়ের পাশে বসল। শরিফা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। আর কফিতে চুমুক দিতে থাকেন। কফি খেয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ইশ কতদিন এত ভাল কফি তিনি খান নি! তার মেয়ে এত অসাধারন কফি বানানো কিভাবে শিখল?
রিনা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘মা, বাবার পছন্দের যেই ছেলেটা ছিল, তার সাথে কি যোগাযোগ করা যাবে মা?
শরিফা একটু অবাক হয়ে বলেন, ‘হ্যা যাবে তো মা। কিন্তু কেন?’
রিনা লজ্জা মাথানো গলায় বলে, ‘আমি উনাকে বিয়ে করব মা। তুমি ব্যবস্থা কর।‘
শরিফার আবার আনন্দে চোখ ভিজে আসতে চায়। চোখের জল আটকানোর জন্য তাড়াতাড়ি বলেন, ‘মা, তুই এত চমৎকার কফি বানাস কিভাবে? আমাকে শিখাবি?’
রিনা বলল,’ কোথায় কফি চমৎকার হয়েছে? আমার কাছে তো একদম সাদামাটা মনে হচ্ছে।‘
-‘না মা, অসাধারন কফি হয়েছে। সত্যি অসাধারন!’ বলতে গিয়ে টপ টপ করে শরিফার চোখ থেকে পানি পরে গেল। আর আটকানো গেল না।
তিয়েন আন্দালিব
লেখক ও সংগঠক
বিষয়: তিয়েন আন্দালিব
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: