সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

তারাশঙ্করের জীবন ও সাহিত্যে মাটি ও মানুষ : আরিফুল ইসলাম সাহাজি 


প্রকাশিত:
৭ মে ২০২০ ২০:৪৩

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২১:১৮

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

 

শরৎ  উত্তর বাংলা সাহিত্যের যুগপুরুষ নামজাদা কথাকার হলেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় । সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর বিচরণ সুদীর্ঘকাল ব্যাপি এক অনন্য গতিতে বহমান ছিল । প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল (৪৫ বৎসর )যাবৎ বাঙালি সমাজের অধঃপতন , অস্থিরতার ছবিকে দক্ষ শিল্পীর মত এঁকেছেন , যা তাঁর সাহিত্য শরীরকে দিয়েছে এক অনন্য শৈল্পিক সৌন্দর্য । তৎকালীন সমাজ বাস্তবতা , বাঙালির চাওয়া পাওয়ার গল্প তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পকে অসম্ভব কথন সৌন্দর্য প্রদান করেছে । গল্প বলবার এই অনন্য স্বকীয়তাই তাঁকে সমকাল অতিক্রম করে যুগউত্তরণ করতে সহায়ক হয়েছে । ব্যক্তি তারাশঙ্কর মনে করতেন , ' মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ ' । এই ঘোষণার রোপণ আমরা তাঁর উপন্যাস , ছোটগল্প ,  প্রায় সর্বত্রই দেখতে পায় । সমাজিক ভাবে  বিত্তশালী পরিবারের প্রতিভূ হলেও সাধারণ গণমানবের সঙ্গে সহযোগ তারাশঙ্করকে এক অপরিমেয় শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য  করেছিল  । এই অভিজ্ঞানই তাঁকে রাঢ় বাংলার চলন্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম রুপকারে পরিণত করেছে  , একথা উপস্থাপন করা  যায় ।

তারাশঙ্করের জন্ম সাল ১৮৯৮ , সেদিনগত তারিখ ছিল ২৪ শে জুলাই , (বাংলা সন , ১৩০৫ এর , ৮ ই শ্রাবণ , শুক্রবার )। পিতা হরিদাস বন্দোপাধ্যায় , জননী প্রভাবতী দেবী । হরিদাস ছিলেন তন্ত্রোপাসক ।  তারা মার প্রসাদে পুত্র জন্ম হয়েছিল বলেই হরিদাস বন্দোপাধ্যায় পুত্রের এইরুপ নামকরণ করেন । হরিদাস বন্দোপাধ্যায়ের ফুলের শখ ছিল , মা প্রভাবতী দেবী ছিলেন বইপ্রেমী , আধুনিক মনন সম্পূর্ণ । তারাশঙ্কর ' আমার কালের কথায় ' আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থে তাঁর জননী সম্পর্কে লিখেছেন , ' আমার বাবার মতো প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ মানুষের জীবনকে শান্ত সংযত বেগবান প্রবাহে পরিণতি তিনি দিতে পেরেছিলেন । ' 

তারাশঙ্করের জীবনে জননী ব্যতীত অন্য আর এক মহিলার ব্যাপক প্রভাব ছিল , তিনি পিসিমা । পিসিমা ছিলেন অসামান্য ব্যক্তিত্বময়ী , তাঁর শাসন এবং নির্দেশে কেটেছে তারাশঙ্করের বাল্যজীবনের দিনগুলো । পাঁচবছর  বয়সে হাতেখড়ি হয় তাঁর । তারাশঙ্করের জীবনে অসামান্য অবদান ছিল মাতা প্রভাবতী দেবীর , পিতার মৃত্যুর পর পিসিমার নির্দেশেই চলত হেঁসেলের খুঁটিনাটি । এই পিসিমা চাইতেন তারাশঙ্কর বড়ো হয়ে জমিদার হয়ে উঠুক , কিন্তু মা তা চাইতেন না । জমিদারির বাইরের যে অনন্ত জগৎ রয়েছে সেইখানে নিজেকে উন্মুক্ত , পরিব্যপ্ত করে দিক তারাশঙ্কর , এমনই চাইতেন জননী প্রভাবতী দেবী । শেষমেষ জয়ী হয়েছিলেন জননী প্রভাবতী দেবীই , জীবনের এক পর্বে এসে , তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় লাভপুর এবং জমিদারী ত্যাগ করে সাহিত্য সাধনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন । 

তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় শরীরী ভাবে খুব একটা সুস্থ ছিলেন না । ভগ্নস্বাস্থ্যর অধিকারী ছিলেন তিনি । ঘন ঘন ম্যালেরিয়া তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলত । এই অসুস্থতা তাঁর পঠন জীবনে ভয়ঙ্কর রকম প্রভাব ফেলেছিল । প্রথম বার প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি তিনি , দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় পাশ করেন । বহরমপুরে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ পাননি  , অতঃপর কলকাতায় আসেন । ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে । এখানে মাত্র কয়েক মাসই পড়েছিলেন তিনি । দেশ তখন পরাধীন , পরাক্রমশালী ইংরেজ শক্তির শোষণ ও শাসনে উত্তাল জননী জন্মভূমি । এই উত্তাল আবাহন অস্বীকার করতে পারলেন না তারাশঙ্কর । যোগ দিলেন বিপ্লবী দলে । হাতে এলো স্বামী বিবেকানন্দ ও সখারাম গণেশ দেউস্করের বই । তারাশঙ্করের এই বিপ্লব যোগ গোপন রইল না । রাজরোষের শিকার হলেন তিনি , জুটলো গৃহবন্দির ফরমান । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর এই বন্দিদশার ইতি হলে তিনি পুনরায় কলেজে ভর্তি হলেন  , এবার সাউথ সুবারবন কলেজে । এবারও ডিগ্রি লাভ হল না তাঁর , জন্ম সঙ্গী ম্যালেরিয়ার প্রকোপে এতটাই নাস্তাবুঁদ হলেন যে পড়াশুনা সমাপন ঘটিয়ে জন্মভিটা লাভপুরে ফিরে এলেন । 

১৩২২ বঙ্গাব্দে বোন কমলার ননদ উমাশশীর সঙ্গে তারাশঙ্করের বিবাহ সম্পূর্ণ হয় । তাঁর বয়স তখন মাত্র সাড়ে সতেরো , উমাশশী মাত্র এগার বছর দুই মাসের বালিকা । তারাশঙ্করের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না , তিনি নিজেই স্বজীবনের এ পর্ব সম্পর্কে লিখেছেন , ' আমার জীবন বিষাক্ত হয়ে উঠল । সামান্য কলহে বা মতভেদে বিমর্ষ হয়ে কল্পনা করতে বসি - কখনও গৃহত্যাগের কল্পনা , কখনও বা অতীত সারা জীবনটাকে একেবারে উল্টেপাল্টে , নূতনভাবে বিচার করি । বার্ধক্যেও তরুণ বয়সের মতো অভিমান করে বসি । তবুও মনে হয় মনের সাত মহলার কোন গোপন মহলে কোন এক মেয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে , তাকে পেতে চেয়েছিলাম , কিন্তু পাইনি , পাওয়া হয়নি । ' স্ত্রীর প্রতি অমনোযোগের জন্যই কী অন্য কোন নারীর কাছে দুদন্ডের শান্তি চেয়েছিলেন তিনি ? হয়তো বা । 

যৌবনে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় তিনজন ভারতীয় মনীষী দ্বারা প্রভাবিত হন , এই তিনজন হলেন যথাক্রমে , বিবেকানন্দ , রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমচন্দ্র । এঁদের কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন ন্যায়পথ , অন্যায়ের বিপক্ষে চলবার অনন্য অভিজ্ঞান । তাই জমিদারের অত্যাচার , জাতিভেদের মধ্যযুগীয় উন্মত্ততার বিরোধী ছিলেন সারাজীবন । জীবনের প্রথম বত্রিশটি বছর বড্ড বৈচিত্রময় পরিআবহের মধ্যে কেটেছে তারাশঙ্করের , গ্রামের সমাজ সেবক সমিতির মুষ্টিভিক্ষাসংগ্রহক , কখনও সেবাব্রতী , গ্রাম্য পরিব্রাজক , স্বসম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক , আবার কখনও বা ইউনিয়ন প্রসিডেন্ট হিসাবে গ্রামের উন্নয়নে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন । 

স্বজীবন পরিচলন পন্থার পাশাপাশি রাজনীতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তারাশঙ্কর । হিংসাত্মক বিপ্লবী আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তিনি , যোগ দেন গান্ধীজীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে । ১৯৩০ সালে সংঘটিত আইন অমান্য আন্দোলনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি । দ্বিতীয়বারের জন্য রাজরোষের শিকার হন তিনি , ছয়মাসের জন্য আবার কারাবাসের ফরমান জারি হয় । কারামুক্ত হওয়ার পর তিনি অনুভব করেন , ' সাহিত্য সেবার পথেই দেশ সেবা ' । 

জেল থেকে মুক্তির পর নিজেকে গুটিয়ে নেন তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় । ছোট ভাই এর হাতে তুলে দেন জমিদারীর কাজ । দেশপ্রেম মূলক বাণী প্রচার করবেন বলে একটি প্রেস স্থাপনে মনস্থির করলেন কিন্তু গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতায় তা সম্ভব হল না । রুষ্ট তারাশঙ্কর অতঃপর লাভপুর ত্যাগ করলেন । 

এই লাভপূরের সঙ্গত্যাগ বাংলা সাহিত্যের নিঃসন্দেহ এক বিশিষ্ট ঘটনা । তারাশঙ্কর যেমন বিষয়ী মুক্তি পেলেন , সেই সঙ্গে অহেতুক গ্রামীণ রক্ষণশীল সমাজের অনেক বিধিনিষেধ থেকেও মুক্তি পেলেন তিনি , যা মুক্তমনে তাঁর সাহিত্য সাধনায় মনোযোগী হওয়ার পথকে প্রশস্ত করেছিল । 

ব্যক্তিগত জীবনে নানা কষ্ট পেয়েছেন , শরীরী কষ্টের সঙ্গে তাঁর আজীবন সংযোগ , তৎসহ সমাজিক গণ মানুষের লোভ , নানাবিধ অনৈতিক বাসনার উৎপীড়ন তাঁকে আহত করেছে । প্রথম জীবনে অর্থ কষ্ট ছিল কিছুটা , তবুও কোন প্রলোভন তাঁকে আদর্শ চ্যুত করতে পারেনি , এই অমোঘ মানসিকতাই তাঁর চরিত্রকে অসম্ভব দৃঢ়তা প্রদান করেছে । দেশের অগ্নিগর্ব সময়ে নিজেকে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত গৃহে অভ্যন্তরীণ করে রাখতে পারেনি । যোগ দিয়েছেন ১৯ এর অসহযোগ , ৩০ এর আইন অমান্যে , ৪২ এর ভারত ছাড় আন্দোলনেও । ভারতবর্ষের স্বাধীনতা , দেশবিভাগ , পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন , বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের ঐতিহাসিক পটভূমি , সেই সঙ্গে প্রথম , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ , ইংরেজ পীড়ন - শাসন ও শোষণ , মহামারি ও দুর্ভিক্ষের প্রকোপ , উদ্বাস্ত সমস্যার নির্মম ইতিবৃত্ত , অর্থনীতিক বিপর্যয় ও স্বাধীনতা উত্তরকালের রাজনীতিক নেতাদের নীতিবোধের পশ্চাদপদ হওয়ার পরিআবহ তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মননকে পরিপুষ্টতা দিয়েছে । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মানস গঠনের পরিআবহিক দিক সম্পর্কে যথার্থই লিখেছেন , ' তাঁর সাহিত্যের দুই প্রধান উপজীব্য - মাটি আর মানুষ । মাটির মমত্ব আর মানুষের মহিমা । ' এই  মমত্ববোধগত জীবন বিন্যাস তাঁর সাহিত্যকে দিয়েছে এক মহাকাব্যিক ব্যপ্তি এবং অমোঘতা । জীবনের সংবেদময় পরিপুষ্ট চেতনাজাত প্রাপ্ত অভিজ্ঞান ভর করেই তিনি হয়ে উঠেছেন তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী পুরুষ । যা রাঢ় বাংলাকে বিশ্বময় এক অনন্য দ্যুতি প্রদান করেছে ,তা বলবার অপেক্ষা রাখে না । 

 

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top