সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২৮শে মার্চ ২০২৪, ১৪ই চৈত্র ১৪৩০

অপু তপু মেথি-দের মনে পড়ে : বেগম জাহান আরা


প্রকাশিত:
১৫ মে ২০২০ ১১:১৩

আপডেট:
১৬ মে ২০২০ ০০:০৩

 

ওরা সবাই ভালো আছে। সন্তানাদির বাবা মা হয়েছে। ব্যস্ত থাকে ভরা সংসারে। ভালো নেই শুধু গয়না খালা। বয়স হয়েছে। কাজের মেয়ে তুলিকে নিয়ে একাই থাকেন একটা দুই রুমের ফ্ল্যাটে। ভর ভরন্ত সংসার তাঁরও ছিলো। চারটে পাখির ছানা মানুষ করে উড়িয়ে দিয়েছেন সাত সমুদ্র আর অসংখ্য নদ নদী পারের দেশগুলোতে।

একটা মেয়ের আশা করতে গিয়ে পর পর চারটা ছেলে এসেছে সংসারে তার। অপার স্নেহ আর যত্ন দিয়ে মানুষ করেছেন চার ছেলেকেই। তারপরও অপু, তপু, মেথি, বুলু-রা এসেছে তার জীবনে। স্থায়ী হয়ে নয়, সাময়িক মেলামেশার ফাঁকে ফাঁকে ফুলের অবাধ সুবাস হিসেবে। উড়ে আসা সুখ, উড়ে আসা দুখ ওরা। সামাজিক জীবনে ওরা সবাই কাছের মানুষ এবং কোনো না কোনো ভাবে আত্মীয়। যাওয়া আসা থাকা খাওয়া নেয়া দেয়া সবই ছিলো। জীবনের পড়ন্ত বেলায় অলস দুপুরে, কিম্বা নিঘুম রাতের কষ্টকর অস্থিরতার মধ্যে মনে পড়ে ওদের কথা। বিশেষ করে এই 'করোনা' কালে সুমন রায়ানেরা যখন কথা বলে, তখন মনে পড়ে যায় ওদের কথাও। মনে মনে দোয়া করে।

ঢাকা শহর তো আর সেই আগের মতো ছোটো নেই। লালমাটিয়া থেকে উত্তরা কিংবা মিরপুর চৌদ্দতে গেলেই বোঝা যায় কথাটা, যদি গাড়ি না থাকে। মীরপুরে গয়নার ছোটো বোন ঝুমকার বাসা। বিয়ের আগে থেকেই প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিলো, বোনের বাসায় এলেই দুদিন থেকে যেতে হবে গয়নাকে। ঝুমকা তার একমাত্র ছোটো বোন।

চলছিলো এই ভাবেই। বছরে দু তিন বারের বেশি তাই যাওয়া হয়না ঝুমকার বাসায়। দেখতে দেখতে ঝুমকার ছেলেটার চারবছর পূর্ণ হলো। জন্মদিনের আয়োজনে যেতে হবে গয়নাকে। তার নিজের দুই ছেলে, সুমন, রায়ান, এবং একটা অর্ধেক। ছয়মাস চলছে। বেতালে চলে শরীরটা মাঝে মাঝেই। কিন্তু যেতেই হবে অপুর জন্মদিনে। আর অপুটাও এতো ন্যাওটা খালার! তাদের বাসায় গেলে খালার সাথে আঠা হয়ে যায়। খালাতো ভাই সুমন রায়ানও উল্লসিত হয়ে যায় ঝুমকা খালার বাসায় এলে।

ঝুমকার স্বামী, আরমান এতিম ছেলে। মা বাবা একাত্তরে মারা গেছে। ছোট্ট একটা অসমাপ্ত বাড়ি ছিলো। কি মনে করে বিহারি পট্টিতে বাড়ি কিনেছিলো তার বাবা, কে জানে? সেটাই  ঠিক ঠাক করে তারা বাস করে। কর্মঠ মানুষ। চাকরির পরেও কিছু একটা করতে হয় তাকে। বাড়ির পাশে সামান্য জায়গায় ফুলের গাছ ছিলো। শেফালি, কাঁঠালচাঁপা, রাধাচূড়া এবং কাঠ করবির ছায়ায় ছায়ায় মৌসুমি ফুল ফুটে থাকতো। আনাচে কানাচে নিজে থেকেই হতো কাঁটা নটে, মিষ্টি নটে, নোনা আর বথুয়া ( কেউ বলে বৈত্থা )  শাক। বছর কয় থেকে সবজি বাগানের সখ হয়েছে আরমানের। সব গাছ কেটে  সবজি বাগানের জমি তৈরি করেছে। অনেক অনুরোধে দেয়ালের পশ্চিম কোনায় ঝুমকার সাধের শেফালি গাছটা বেঁচে গেলো। মেতে  থাকে আরমান বাগান নিয়ে। মনটা তার আকাশের মতো। ছোটো জিনিস চোখে পড়ে না। ছোটো কিছু ভাবতে পারে না। অপু আর ঝুমকা তার প্রাণ। ঝুমকার সমস্ত আত্মীয় স্বজন তার অতি আপন। গয়না যেনো সহোদর বোন।

গয়না এলে ঝুমকার বাসায় ইদের আনন্দ বয়ে যায়। প্রতিবার ফিরে আসার সময় অপুর সে কি কান্না! খালার সাথে যাবে সে। সুমন রায়ানও চায়, অপু তাদের বাসায় কদিন থাকবে। কিন্তু ঝুমকা রাজি না। বলে, ছোটো মানুষ, রাতে উঠে কাঁদবে মায়ের জন্য। কিন্তু এবারে সে কথা খাটে না। চার বছর পূর্ণ হয়ে যাবে।

দুটো মাত্র দিন। তিন ভাই একসাথে খায়, খেলে, বিশ্রাম করে, রাতে ঘুমায়। যে কেউ দেখলে বলবে, অপু গয়নারই ছেলে। কোথায় যেনো চিন চিন করে বাজে ঝুমকার কলিজায়। রাতে ওকে ছাড়া ঘুমোতে কেমন খাঁ খাঁ করে বুকের ভেতর। ছেলেটা এমন পাজি, কিছুতেই খালার  বিছানা থেকে আসবে না। উতসবের আমেজে কেটে যায় সময়। এইবার অপুই জিদ ধরেছে, খালার বাড়ি যাবেই সে।

ঝুমকা অনেক বোঝালো মাকে ফেলে না যাওয়ার জন্য। বললো, মা কাঁদবে। বাবা কাঁদবে। বাচ্চা বেড়ালটা কাঁদবে। পাশের বাড়ির বান্টি কাঁদবে। কিছুতেই ভোলানো যায় না অপুকে। সে যাবেই  যাবে  খালার বাড়ি দুদিনের জন্য।

কান্ড দেখে গয়না হাসে। আর ঝুমকা কাঁদে। মনে মনে বলে, কি কঠিন ছেলে রে বাবা! মায়ের চেয়ে খালাই আপন হলো? গয়না আপাটাও যে কি! একবারও বলছে না, মায়ের কাছেই থাকো বাবা। মা কাঁদবে তুমি গেলে। বরং সে বেশ খুশি। মুখে তো বলেই, ‘আমার তিন ছেলে'। শুনতেও ভালো লাগে না ঝুমকার।

মাকে কাঁদিয়ে অপু এলোই খালার সাথে। তিন ছেলেই মহাখুশি। ইশার নামাজের পর ঝুমকা ফোন করে জানতে চায়, অপু ঘুমিয়েছে কিনা? ঠিক মতো খেয়েছে কিনা? অপুর সাথে কথা বলতে চাইলো ঝুমকা। সে তখন লুকোচুরি খেলছে। সময় নেই মায়ের সাথে কথা বলার।

আহত হয় ঝুমকা। গয়না আপা ডেকে দিলেই অপু এসে কথা বলতো। বাচ্চাটাকে ছেড়ে কখনও থাকেনি ঝুমকা। মায়ের চেয়ে খালাকে বেশি ভালোবাসাটা আবার কি জিনিস? কেমন এক অজানা আক্রোশ গুরগুর করে মনের মধ্যে। কাউকে বলাও যায় না। বলবেটাই বা কি?

গয়না খুব খুশি অপুকে কাছে পেয়ে। এমন টুল্টুলে বাচ্চাটা! ভালো না বেসে উপায় থাকে না। সারা দিন খেলে ভাইদের সাথে। কোনো কিছুর বায়নাক্কা নেই। প্রথম দিন  ভালোই কাটলো। দ্বিতীয় দিন সন্ধে বেলা মনে পড়লো তার মাকে। বলে, বাড়ি যাবো। মার কাছে যাবো। সুমন রায়ান খেলনা দেয়। চকলেট দেয়। পিঠে নেয়। হামাগুড়ি দিয়ে হাতি হাতি খেলে। কিছুতেই বান্দা ভোলেনা। গয়না  একটা ডিম আইস চেম্বারে রেখে বলে, বরফের ডিম খাবে সোনা? হঠাত ভালো লেগে যায় প্রস্তাবটা অপুর।

গয়না বলে, এই  ডিম খেলে রাতে আর বাইরে যেতে পারবো না।
-কেনো?
-এতো ঘুম পেতে পারে যে, রাস্তায় রিকশা থেকে পড়ে যেতে পারি।
-কেনো খালামনি?
-রিকশায় ঘুমিয়ে পড়লে পড়ে যাবো না বাবা?
একদিকে বরফের ডিম খাওয়ার ইচ্ছে, অন্যদিকে মায়ের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে। ভাবনায় পড়ে অপু।
অবশেষে অনেক  কথা খরচ করে, বরফের ডিম ভাজি খাইয়ে অপুকে শান্ত করা গেলো। ডিমের মধ্যে লেবুর রস দিয়ে টক টক স্বাদ বানিয়েছিলো গয়না। যেনো বরফের ডিম এমনি হয়। ভাগ্যিস, ডিম ভাজি তার প্রিয় খাদ্য।
পরদিন মিরপুরে নিয়ে গেলো গয়না নিজেই। ঝুমকার মুখ ভার। দুচোখ লাল। রাতে হয়তো ঘুমায়নি ভালো করে।
অপু  ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে উঠলো। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি  নামলো ঝুমকার চোখে। তারপর শরতের উজ্জ্বল সূর্য দেখা গেলো। গয়নার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুমকা হাসে।

কোথায় যে সুর কেটে গেলো, বোঝা গেলো না। কিন্তু সম্পর্কটাই  ছায়া হয়ে গেলো। ঝুমকা শক্ত হয়ে গেছে। আসা যাওয়া কমে গেলো দুই পরিবারের মধ্যে। ছেলেকে আর কখনও খালার বাসায় যেতে দেয়নি। গয়না বুঝে পায় না, মায়ের আত্মবিশ্বাস এতো কম হবে কেনো? বাচ্চাটা তো তার। তার পেট থেকে হয়েছে। তারই রক্ত মাংসে তৈরি। এতো সহজে পর হতে পারে সে? তাকে কেউ ভালোবাসলে মায়ের তো খুশি হওয়ার কথা। টান পড়েটা কোথায়? হতভাগা! ভালোবাসাও নিতে পারে না। বঞ্চিত করে বাচ্চাটাকেও।

সেই অপু এখন ক্যানাডায় আইটি ফার্মে চাকরি করে।

তপুর ঘটনাটাও প্রায় একই রকম। সে হলো দেওরের ছেলে। গয়নার বাসায় তার কি যে ভালো লাগে, বেড়াতে এলে আর নিজেদের বাসায় ফিরে যেতে চায় না। প্রধান আকর্ষণ, সুমন রায়ানের খেলার সরঞ্জাম। বিশেষ করে চাকাওয়ালা কাঠের ঘোড়াটা তার খুব প্রিয়। দেওর ব্যবসা করে। কিছুদিন থেকে মন্দা যাচ্ছে। মন মেজাজ ভালো না কারও। দেওরের বৌ মানে,  তার জা, রেশমি  তপুকে গুলশন থেকে চাকা ওয়ালা একটা কাঠের ঘোড়া  কিনেও দিয়েছে । সেটা তপুর পছন্দ নয়। কারণ, ওতে বসার জিন নেই, মুখে লাগাম নেই, এবং দেখতে ভালো না।

ছোটো মানুষদের কথা। কিছু শুনতে হয়, কিছু শুনতে হয়না। কখনও বোঝাতে  হয়, কখনও শাসন করতে হয়। শিশুর মতো ছোটো হয়ে শিশুকে ভালোবাসতে হয়। রেশমি শাসনটা একটু বেশিই করে। গয়নার কাছে সেইটে নেই। বাচ্চারা কেমন আরাম পায় গয়নার কাছে এলে। তপুও হয়তো পেতো।

এমন মিষ্টি করে ডাকে, ‘বড়াম্মু বড়াম্মু’ বলে, গয়না একেবারে গলে যায়। কোলে নিয়ে আদরে চুমোয় ভরিয়ে দেয়। রেশমি এটা পারে না।

একদিন তপু বলেছে মাকে, বড়াম্মুর গায়ে  ফুলেল গন্ন করে কেনো মা?
-কিসের  গন্ধ? কোন ফুল? কি বলিস তপু?
-হ্যাঁ মা। বাগানেল হাতনু হেনাল ( হাস্নাহেনা ) মতো গন্ন।
- ডাইনিদের গায়ে ওরকম গন্ধ থাকে।
-হাঁউ মাউ খাঁউ  দাইনি মা?
-চুপ করতো, এতো কথা বলিস না।
-বড়াম্মু তো অনেক কথা বলে। গল্প বলে। তুমি লেগে যাও কেনো মা?
-বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না আমার, তাই। মুখ বন্ধ কর এবার।
-কেনো মা? বড়াম্মু বলে, আমার কথা নাকি খুব মিত্তি।
-আমার কথা মিষ্টি না?

অতোটুকু ছেলে কি বলবে আর? এক সময় চুপ করে যায়।

মায়ের চেয়ে বড়াম্মু ভালো, এটা নিতে পারেনি রেশমি। আর গায়ের গন্ধের কথা শুনে লজ্জা পেয়েছে গয়না। এই গন্ধের মালিক তো শুধু  তার  নিজের মানুষ, সোহেল। অন্তরঙ্গ মুহূর্তে  তার কন্ঠার কাছে নাক ঘঁষে ঘঁষে বলে, তোমার ঘাম নিয়ে আমি পারফিউম বানাবো জান। আমার পদ্মিনী বৌ।

- ভালো না বাসলে এই গন্ধ কেউ পায় না, তা জানো? গয়না বলে।
-তাই বলো, ভালোবাসাবাসিরও  একটা গন্ধ থাকে, উম! হাসে সোহেল।

তপুও সেই  সুবাস পেয়েছে? শিশু তো! কোলে নিলে বুকের সাথে মিশে থাকে। তা বাচ্চাতো বুকে রাখারই। হয়তো চাচিকেই মায়ের মতো ভালবেসেছে। তাই পেয়েছে কিছু গন্ধ। হাসি পায় গয়নার।

মিষ্টি  কথা, মিষ্টি গন্ধ, একসময়  তেতো হয়ে গেলো। আসা যাওয়াও কমে গেলো।কেমন করে যেনো তপুকে পর  করে দিলো রেশমি। অসূয়া কাতর মায়েদের কিছু কিছু টেকনিক আছে। উল্টো সিধে বলে  নিজের  সন্তানকে  বিষিয়ে তোলে ভালোবাসার মানুষদের  প্রতি। মা বলে  তপুকে, বড়াম্মু নাকি পর। পৃথিবীতে মা-ই একমাত্র আপন। বেচারা তপু বুঝেই পেলো না, বড়াম্মু পর  হলো কেমন করে?

তপু লেখা পড়ায় ভালো করতে পারলো না। কোনোমতে গ্রাজুয়েশন হলো। তারপর খায় দায় ঘুরে বেড়ায়। আড্ডা দেয়। মোড়ের দোকানে বসে চা খায়। পাড়ার ক্লাবে ফুটবল খেলে। রেশমির  শাসনের বাইরে চলে গেলো তপু। একদিন অকস্মাত বিয়ে করে বৌ নিয়ে এলো ঘরে। সে কি  অশান্তি বাড়িতে! সব শোনে গয়না। কষ্ট হয় ছেলেটার  জন্য।

হঠাত একদিন বৌ নিয়ে চাচির বাড়িতে বেড়াতে এলো তপু। মন ভরে গেলো গয়নার বৌ দেখে। ভারি মিষ্টি মেয়ে নীপা। কথা বার্তাও ভালো। দুজনে মিলে  বাচ্চাদের জন্য একটা কিন্ডার গার্টেন স্কুল দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তপু রাজি। আলাদা  বাসা নেবে। বাবা কিছু থোক টাকা দেবে স্কুলের জন্য। সামনে অনেক  কাজ। গয়না মনে মনে চায়, নীপা যেনো তপুর কস্তুরি কুসুম হয়। সবার দরকার হয় না। কিন্তু কারো কারো হয়। এরা কি গন্ধপুরুষ? ছোট্ট তপুর কথা মনে পড়ে।

যোগাযোগ রেখেছে  তপু। ভালোই চলছে সব। নীপা মা হবে। প্রান থেকে দোয়া করে গয়না। রেশমির পরিবর্তন হয়নি। কেমন ছাড়া ছাড়া ভাব ছেলের সাথে। বৌটাকে আপন করে  নিতে পারে নি। কষ্ট হয় গয়নার। কিছু করার নেই। মন থেকে দোয়া করে, গন্ধপুরুষ তপুর জন্য। এমন বাচ্চা আর দেখেনি গয়না।

মেথি তার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। ফুটফুটে মেয়ে। বয়স দুই বছর। দেশের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখা ওদের সাথে। গয়নার তখন তিনজন ছেলে। দাদুর শততমো মৃত্যু বার্ষীকি উপলক্ষে অনেকেই এসেছে। চাচাতো ভাই , জসিম দেশের বাড়িতেই  থাকে। বিয়ে করেছে একই  গ্রামে। স্থানীয় স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে বুশরা। দেখতে মোটামুটি। রঙ ফরসা।

যেমন হয় গ্রামের সংসার, তার চেয়ে জসিম অনেক ভালো আছে। ঘরে ফ্রিজ আছে, ফ্যান আছে, ব্লেন্ডার আছে, পানি গরম করার জন্যে হিটার আছে। শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া। ঘরের সাজ সজ্জা ভালো। ওদেরই  জিদে গয়নারা সবাই জসিমের ঘরে থাকবে ঠিক হলো। তিন দিনের হামসফর। প্রথম দিনেই তাদের মেয়ে মেথি, থাকতে চাইলো গয়নার চাচির  কাছে।

গয়নার ভালোই  লাগলো। চার ভাই বোনে মিলে সে কি হুটুপুটু বিছানায়। রাতে চাচির কাছে শোবে মেথি। ওব্বাবা, সে আবার কানের লতি ধরে ঘুমায়। গয়নার  পাশা পরা ছিলো। সেটা ধরে বারবার ঘুমের মধ্যে টানছে। বোঝা গেলো, বুশরা কেনো কানে কিছু অলংকার পরে না। অবশেষে গয়না  তার কানের পাশা খুলে বালিশের নিচে রেখে  দিলো।

রাত পোহালো। ফরসা হলো। পাখি ডাকলো। দাঁড়কাকের কর্কশ  ক্কোয়া ক্কোয়া ডাকে মাথা ধরে যাওয়ার দশা। বুশরা  চা এনেছে। বাচ্চারা উঠে বিছানাতেই হুটোপুটি করছিলো। মাকে দেখে মেথি এগিয়ে গেলো। বুশরা বললো, একটু পরে মা মনি। কিন্তু সে শুনলো না। মায়ের পেছন পেছন চলে গেলো। একটু পরেই কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলো  গয়নার কাছে।

-কি হয়েছে সোনা মনির? গয়না কোলে তুলে নেয়।
-মা কথা বলতেনা আমাল  তাতে। উঁ উঁ উঁ , মিহি সুরে কাঁদে মেথি।
-তাই ? চলো তো দেখি, মা কি করছে? বুকের ভেতর জাপটে ধরে মেথিকে।
-না, দাবো না। মা বলেছে, তাতির গলেই তাত্তে। উঁ উঁ উঁ…

গয়না বুঝে ফেলেছে  ঘটনা কি? অবাক না হয়ে পারে না। শিশুকে সবাই ভালোবাসে। গয়নার মতো  শিশুতোষ  মেয়েরা  তো বাসেই। কই,, নিজের বাচ্চার জন্য তার ভালোবাসা তো কমে যায় না। তার বাচ্চাদেরকে ভালোবাসার লোক নেই। চাচি ফুপু খালারা নিজের বাচ্চাকেই ভালোবাসতে পারে না, তো পরের বাচ্চাকে ভালোবাসবে কেমন করে? কেমন  মা এরা?

কোথায় গেলো বুশরা মা? মেথি রানি কাঁদে। এসো, মা মনিকে কোলে নাও। বলতে বলতে গয়না রান্নাঘরে  চলে  আসে।

আঁচলে হাত মুছে গয়নার কাছে এসে দাঁড়ায় বুশরা। হেসে  বলে, খুব জ্বালিয়েছে রাতে না বুবু?
-একটুও না।
-আপনার কানের পাশা কোথায়?
- ওহো, খুলে রেখেছি  রাতে। দুজনেই হাসে। গয়না বলে, বুঝেছি, তুমি কানে কিছু পরো না কেনো? আবার হাসে দুজনে। মনে হলো মেঘ কেটে  গেলো।

শ্রাবনের মেঘ কি সহজে কাটে? ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি হবে কেমন করে তাহলে? মেথি ঘুরে ঘুরে আসে চাচির কাছে। সুমন ভাইয়াদের সাথে খায়, খেলা করে,  দুপুরে বিশ্রাম নেয়। রাতে আবার সেই ঝামেলা, চাচির কাছে শোবে মেথি।

রাতে সোহেল বলে, আমারই ভুল। গন্ধগুলো মেখে খেয়ে শেষ করে ফেলতাম, তাহলে ঝামেলা  থাকতো  না।

-অসভ্যের মতো কথা বলো না তো!  লাল হয়ে গেছে গয়না।
-তোমার ঝামেলা কমতো ভাই। বেচারা বেচারা মুখ করে সোহেল।
-আমার কি ঝামেলা? বাচ্চাকে ভালোবাসতে আমার ঝামেলা নেই। শুধু বুঝে পাই না, এই মহিলারা কেমন মা? নিজের বাচ্চাকে অন্যে ভালোবাসলে আরও  খুশি হওয়ার কথা। তা না, মরেই  যায়!

বুলু তার ওপর তলার ভাড়াটিয়ের শ্যামলা গুলু গুলু মেয়ে। তারও ইচ্ছে করে গয়নার কাছে শুতে। কিন্তু তার মা দেবে না। প্রতিবেশি হিসেবে মেলা মেশা ভালোই ছিলো।  একটা সম্পর্কও  বের হয়েছিলো। তাতে একটু সহজ হয়েছিলো মেলামেশাটা। লক্ষ্মী মেয়ে বুলু। দরজা খোলা পেলে প্রায় প্রায় গয়নাদের বাসায় চলে  আসে। মা এসে নিয়ে যায়। ছেলেরা স্কুলে গেলে বাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। এমনি একদিন দুপুরে বুলু এসে শুয়েছিলো গয়নার কাছে। মা  এসে  জোরা জুরি করে টেনে নিয়ে গেছে। কি বিশ্রি ব্যাপার! এমন করে বাচ্চাটা কাঁদলো! তারপরেও চুপি চুপি আসতো বাচ্চাটা গয়না ফুপুর কাছে।

নিজের ভাই নেই। ফুপু ডাকারও নেই কেউ। বুলুর বাবা গয়নার নাম শুনে বলেছিলো। তার বোনের নামও গয়না। সেই থেকে গয়না বুলুর বাবার বোন। আর বুলুর ফুপু। এমন মিষ্টি লাগে বুলুর ডাক! কেমন করে যে পুরুষগুলো এই রকম খেষ্টু  মহিলাদের নিয়ে ঘর করে, ভাবে গয়না।

বুশরা এখন ব্রাজিলে তার স্বামীর সাথে। দুই বাচ্চার মা। বুলু থাকে নিউ ইয়র্কে। দূর আকাশের গাঢ় মেঘের ফাঁকে হঠাত দেখা তারাদের মতো দেখা যায় তাদেরকে মনের আকাশে। ধরা যায় না, ছোঁয়া যায়না। কিন্তু ঝিক মিক করে দূর থেকেই।

বাঙলা দেশের শীতকালে কুলের আচার ঘরে ঘরেই হয়। একটু  আচার না হলেই চলে না গয়নার। কিন্তু কিছুই করেনি এই বার। সোহেল তার সব গন্ধ নিয়ে চলে গেছে চার বছর আগে। নিগন্ধের ফুল করে রেখে গেছে তাকে। স্মৃতির ঝড়ে  প্রায়ই  কাতর  থাকে সে। ছেলেদের  কাউকে যে দেশে আসার জন্য বলবে, সেই  উপায় নেই। দেশ  বিদেশে আসা যাওয়া বন্ধ ‘করোনা’-র কারনে। আত্মাটা ভয়ে কাঁচুমাচু হয়েই থাকে। মনেপড়ে অপু, তপু, মেথি, বুলুদের কথা। কেমন একটা ভয় ভয় ভাব। এ কি বালা এলো পৃথিবীতে! একটাই সান্ত্বনা, উন্নত দেশে ভালো চিকিতসা আছে।

ভয় দোয়া উতকন্ঠা আর সুচিকিতসার সান্ত্বনার ফাঁক দিয়েই  আচমকা এলো খবরটা। ‘করোনা’ ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে  শ্যামলা মিষ্টি  মেয়ে বুলুকে। ‘ফুপু’  ডাক শোনার সাধ একমাত্র যে বাচ্চাটি  মিটিয়েছিলো।

আহ! নিজের ঘরে গড়াগড়ি করে কাঁদে গয়না।

 

ড. বেগম জাহান আরা
সাবেক প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সক্রিয় ভাষাবিজ্ঞানী এবং কথা সাহিত্যিক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top