সিডনী বুধবার, ২৪শে এপ্রিল ২০২৪, ১১ই বৈশাখ ১৪৩১

বিদগ্ধ বেদনা এক : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
১৬ মে ২০২০ ২০:৩৪

আপডেট:
১৬ মে ২০২০ ২০:৩৫

 

অফিসে নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। বার্তা প্রযোজক বিভাগে তিন দিন অফিস বারো ঘন্টা করে, পরের তিন দিন ছুটি; অর্থাৎ হোম-কোয়ারেন্টাইন। আর একদিন সমন্বয় করে চালানো হবে। গণপরিবহন বন্ধকালীন সার্বক্ষণিক পিক-ড্রপ অফিস দেখবে। আমার বাসা সিটির ঢালে হওয়ায় পিক-ড্রপ পাবো কিনা এ নিয়ে জটিলতা তৈরি হলো। যদিও বছর কয়েক আগে এ সুবিধার আওয়াত ছিলাম। কিছু দিন আগে ব্যয়-সংকোচন নীতিতে দূরত্বের কারণ সে সুবিধা বাতিল করা হয়েছে। এখন আপদ-কালীন ছুটিতে রাস্তায় দ্বিতীয় সুযোগ থাকবে না। কিভাবে অফিসে আসবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। আমার পক্ষ হয়ে এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার কথা বললেন। কয়েকজন সহকর্মী প্রতিবাদ করলেন- ‘‘এই নিরুপায় সময়ে পিক-ড্রপ না দিলে এত দূর থেকে একজন কর্মী কিভাবে তার ডিউটি করবে তা কোম্পানিকেই ভাবতে হবে।’’ ম্যানেজমেন্ট ‘দেখছি’ বলে সামালে নিলো।
এদিকে দশ দিন সারকারি ছুটি ঘোষণা হয়েছে। গণপরিবহন, লঞ্চ, ট্রেন সীমিত আকারে চলাচলেনর আদেশ। জরুরি দরকার ছাড়া ঘর থেকে কেউ বের হবে না। নিত্য প্রযোজনীয় দোকানপাট ছাড়া সব বন্ধ। কাঁচা বাজার খোলা থাকলেও মার্কেট না। প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে সেনাবাহিনী। সারা দেশ অঘোষিত লকডাইন। মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশে এমন পরিস্থিতি আগে কেউ দেখেছে কিনা বলা যাচ্ছে না। যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের আমি কখনো দেখিনি, এটা বলতে পারছি। বিশ্বজুড়ে মহামারি ছোঁয়াচে করনোভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রচুর বিস্তার ঠেকাতে সরকারের এই সিদ্ধান্তে সবাই সাধুবাদ জানালেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথার তুষাণ। এই ফেইজবুক আরেক ভাইরাস। যদিও তা দৃশ্যত না। আজব গুজব অস্থিরতার মাহফিল।
দ্বিতীয় রোটায় আমার ডিউটি। প্রথম ডিউটি রবিবার, দুপুর দুইটা থেকে রাত দুইটা। আমি অফিসে। অফিস ফাঁকা ফাঁকা। কোথাও বেড়াতে এসেছি মনে হচ্ছে। টেলিভিশন স্টেশনগুলোর একটা বিশেষ দিক হলো এখানে সব সময় কর্মীরা হৈ-হুল্লুরের মধ্যে থাকে। অন্য করপোরেট অফিসের মতো বস্-বস্, জুনিয়র-জুনিয়র ভাবের গতি নেই। অফিসটা গমগম করে। এখন ওরকম না। আজ সোমবার। কাজের ফাঁকে নিউজরুমে সাঁটা চব্বিশটি টেলিভিশনের স্ক্রল দেখছি। স্পেনে একদিন মৃত্যু আড়াই’শ ছাড়িযে, আমেরিকায় দুই’শ বিশ, ইতালিতে সাত’শ, ইরানে প্রতি দশ মিনিটে একজন. . .সারা পৃথিবীতে মৃত্যু আর মৃত্যু। শেষ ক্রিয়ার জন্য লোক নেই। কেউ এগিয়ে আসছে না। কর্মীরা লাশ ছুঁতে অনিহা প্রকাশ করছে। ক্রেন দিয়ে কবর দেওয়া হচ্ছে অনেক দেশে। শ্মশানে, কবরাস্থানে লোক নেই। যে প্যাকেটে মৃত্যু সে প্যাকেটেই কবর। আত্বিয়-স্বজন কেউ কাছে ভিড়ছে না। নিদিষ্ট দূরত্বে খাবার রেখে সন্তান দাঁড়িয়ে আছে অনেক দূরে। মা কাঁদছে। শিশু সন্তান কাঁদছে। কেউ কাউকে ছুঁয়ে দেখতে পারছে না। অনুন্নত দেশগুলোতে হাসপাতালের স্বল্পতা, চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব, সেফটি পোশাক, কীটের অপ্রতুলতায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি। ঘন্টায় ঘন্টায় দেশে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা আগের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, নতুন নতুনর শহর নগরে অসুস্থতার খবর ছড়াচ্ছে। এফটিভি, এপিটিএন, ই-ওয়ানে খবর আসছে। ইন্টারন্যাশনাল, ন্যাশনাল ডেস্কের কর্মীদের দ্রুত ছুটোছুটি। নিউজ এডিটরদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। রিপোর্টারদের বসবার অবসর নেই। প্রোডাকশনে নিউজ নির্মাণের ব্যস্ততা। হায় মৃত্যু! চোখের কোণটা ভিজে উঠলো। হাত দিয়ে চোখ ছোঁয়া নিষেধ। পকেট থেকে একটুকরো টিস্যু নিয়ে মুখ ধুতে গেলাম ওয়াশরুমে। ফোনটা বেজে উঠলো। খটকা লাগে। এত রাতে ফোন!
‘‘হ্যালো।’’
‘‘স্যার, আপনার বাসা থেকে ফোন। আপনাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না বলে টিএনটিতে ফোন দিয়েছে।’’
‘‘আসছি।’’
লাইনটা কেটে দিয়ে দেখি বাসা থেকে এগারোটা মিস-কল। কখন যে ফোনটা মিউট হয়ে আছে বুঝি নি। হাতটা অন্য টিস্যুতে মুছে কল ব্যাক করতেই ইরিনের হাউমাউ কান্না।
‘‘কী হয়েছে ইরিন!’’ আমি চমকে উঠলাম।
‘‘আম্মার শরীর ভালো না। ক্যামন যেন করছে।’’
‘‘ক্যামন যেন মানে কী। শরীর ঘামছে? বুকে ব্যথা হচ্ছে? শ্বাসকষ্ট আছে?’’ আম্মা হার্টের রোগী বলে তার পূর্বের লক্ষনগুলো একটানে জিজ্ঞেস করি।
‘‘না। বুকে ব্যথা নেই। হঠাৎ করে খুব কাশছে। গায়ে জ্বর।’’
‘‘গলা ব্যথা?’’ জিজ্ঞেস করি।
‘‘জানি না। কাশিতে কথা বলতে পারছে না। দুর্বল হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে।’’ বুকটা চিনচিন করে উঠলো। স্ত্রী ইরিনের ফোনটা রেখে প্রোডিউসারকে বললাম, ‘‘ভাই, আমার আম্মার অবস্থা ভালো না। বাসা থেকে ফোন আসছে। আমাকে ছেড়ে দিলে ভালো হয়।’’ প্রোডিউসার কথা বাড়ালেন না। বললেন, ‘‘যা।’’ নিচে নামলাম। পথে কিচ্ছু নেই। থাকার কথাও না। ছোঁয়াচে রোগের ভয়ে সবাই যার যার ঘরে। আবার ফোন করলাম প্রোডিউসারকে। ‘‘ভাই, রাস্তায় তো কিছু নাই। এডমিনে বলে একটা গাড়ী কি. . .’’ ‘‘দাঁড়া দেখছি।’’ ইরিনের ফোন- মায়ের শ্বাসকষ্ট বাড়ছে।
আমাদের টিনশেড বাড়ি। মেইন গেইট খোলাই ছিলো। দরজায় নক করতেই ইরিন দরজা খুলে দিলো। ছোট বোন শারমিন দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো। ছোট ভাই আরিফ আমাকে টেনে নিয়ে গেলো তার ঘরে । ‘‘শোন, আমি সন্দেহ করছি আম্মা করোনায় আক্রান্ত । গত কাল ডায়াবেটিকস বাড়লে বিকালে নাকি হাঁটতে গেছিলো। বিদেশ থেকে আসছে এমন একজনের আত্বিয়ের সাথে কথা বলছে।’’ ওয়াসরুমে যেয়ে হাতমুখ ধোয়ার সময়টুকু তারা আমাকে দিলো না। দূর থেকে দেখলাম আম্মা বালিশে হেলান দিয়ে আধ-বসা, আধ-শোয়া। চেহারাটা অন্য রকম। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আম্মার কাছে যেতে চাইলাম। ইরিনের তাড়ায় দ্রুত ওয়াসরুমে নিজেকে পরিস্কার করে বের হয়ে আসতেই বাসায় আসা ছোট খালা বুঝানোর চেষ্টা করলেন, ‘‘ এখন কি করবা বাবা! যদি করোনা হয়ে থাকে! কাছে যাওয়া কি ঠিক হইবো?’’ ইরিন পেছন থেকে শার্টে মুঠো করে ধরে রেখেছে। আম্মার ঘরের দরজা অর্ধেক চাপানো। ব্লাউজটা ঘামে ভেজা। মুখ, চোখ বিধ্বস্ত। আগেও আম্মার চেহারা এমন দেখেছি প্রথম ও দ্বিতীয়বার হার্টঅ্যাটকের আগে। বড় মামা বাসায় এসেও চলে গিয়েছেন মামীকে নিয়ে। যাওয়ার সময় বলেছে, ‘‘কী করবা জানি না। করোনা হইলে একজন তো দশজনকে মারবে।’’ একজন মানুষ কি বিনাচিকিৎসায় ঘরে পড়ে মারা যাবে! সবাই আমার সাথে তর্কে লিপ্ত হলো। কেউ আম্মার কাছে যাচ্ছে না। আমাকেও যেতে দিচ্ছে না। কী করবো! কী করা উচিত? ভেতরটা ভেঙ্গে আসছে। ফোন করলাম বন্ধু ডা. অর্জিত পোদ্দারকে। আগে সে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ছিলো। এখন জয়পুরহাট উপজেলা হাসপাতালে। সে জানালো, ‘‘একটা হাসপাতালে নিয়ে যাও আগে। জানি না এই লক্ষনের উপর কেউ ধরবে কিনা। না দেখে বা এই মুহূর্তে ওষুদের কথা বলাও তো রিস্ক। নাপা দিতে পারো। পানি খেতে দাও, ভিটামিন-সি জাতিয় কিছু থাকলে তরল খাওয়াও বেশি। হাসপাতালের বিকল্প নেই।’’ বলে ফোন রাখলো। পাশের বাসার কামালকে স্মরণ করলাম। হাতে টাকা নেই। ‘‘কামাল, উঠ্। আম্মা অসুস্থ। হাসপাতাল নেব। কিছু টাকা লাগবে।’’ ‘‘আয়।’’ কামাল দরজা খুললো। ‘‘কী হয়েছে কাকীর?’’ ‘‘জানি না। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, কাশি হচ্ছে, গলা ব্যথা।’’ ‘‘কি বলিস! কখন থেকে!’’ আতকে উঠলো কামাল। দরজাটা বন্ধ করে দেয় দেয় অবস্থা। ‘‘এ কি করেছিস। তুই আসলি ক্যান তাহলে। তোর কি আক্কেল-জ্ঞান নাই!’’ কী উত্তর দেব। কামাল আমাকে ঘরে ঢুকতে তো দূরের কথা, এক ধাক্কায় যেন সরিয়ে দেয় দরজার সামনে থেকে। একটা হ্যাক্সিসলের বোতল দূরে থেকে আমার দিকে ঢিল দিয়ে দিলো। বললো, ছয় ফিট দূরে দাঁড়া। সব নিয়ম আমি জানি। কিন্তু মাথাটা আমার খালি খালি লাগছে। কিছ্ ুমনে করতে পারছি না। কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। দরজার নিচ দিয়ে দেওয়া টাকাটা নিয়ে চলে আসলাম।
চারদিক খা খা। দু’চারটি কুকুর থাকতো এ মোড়ে, এখন তাও নেই। পাহারদার অনেক দূরে একটা দোকানের বেঞ্চিতে ঘুমাচ্ছে। একটা সিএনজি, একটা অটো. . .একটা কিছু যদি আসে। কিচ্ছু নেই। সামনেই ফায়ারসার্ভিস স্টেশন। তাদের নিজেদের একটা অ্যাম্বুলেন্স আছে। গেইটে জোরে জোরে ডাক শুনে নাইটে কর্মরত ব্যক্তি এগিয়ে এলেন চোখ কচলাতে কচলাতে। ‘‘ভাই, কোনো যানবাহন পাচ্ছি না, আমার মা খুবই অসুস্থ, হাসপাতালে নেওয়া খুব জরুরী। আপনাদের অ্যাম্বুলেন্সটা দিয়ে সাহায্য করেন। আমি মিডিয়াকর্মী, ভয় নেই ভাই।’’ পকেট থেকে আইডি কার্ডটি বের করে দেখালাম। তিনি কার্ডটি ঘুম চোখে নেড়েচেড়ে দেখলেন। ‘‘আমাদের গাড়ী অফিসারের পারমিশন ছাড়া আমরা দিতে পারবো না। অফিসার এখন নেই। এই গাড়ী আমাদের নিজেদের কাজের। বাইরের জন্য দিবে কিনা . . .’’ একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘‘কী হয়েছে আপনের মায়ের?’’ ‘‘কী হয়েছে জানি না, করোনা উপসর্গ মনে হচ্ছে।’’ লোকটি ভূত দেখার মতো চারটা লাফ দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে বললেন, ‘‘ যান যান মিয়া। আমাদের কিছু করার নাই। আমার আইডি কার্ডটি দূরে থেকেই ছুঁড়ে মারলেন। কী করবো? শক্তি পাচ্ছি না পায়ে। মনের জোর যা ছিলো তা এতক্ষণে শেষ। বিজিএমইএ থেকে দেওয়া একটি প্রেসক্রিপশন আছে ডাউনলোড করা, সেটা দেখে ওষুধ খাওয়াবো কিনা বুঝতে পারছি না। ফার্মেসি খোলা নেই। গরীব দেশে সিটির উপকূল বা গ্রামে এই এক বিপদ। নাগরিক ফেসিলেটিজগুলো সীমিত, নেই বললেই চলে। কথাগুলো মাথায় ঘুরলো। মাথাটা ঘুরছে। আরিফ ফোন করছে। পরিচিত একটি সিএনজি নাকি পাওয়া গেছে কিন্তু আম্মার এ অবস্থা দেখে এ রোগী নিতে পারবে না বলে চলে গেছে। ছোট চাচা এসেছেন। তার গাড়ী নিয়ে। আমরা ভাই-বোনেরা হাতে পায়ে ধরে, গাড়ীটি ক্লিন করার সব ব্যবস্থা করে দেবো শর্তে শেষ পর্যন্ত রাজি করালাম চাচাকে, আম্মাকে হাসপাতাল পৌঁছে দিতে।
আমার কাঁধে দায়িত্ব, আমার কাঁধে জীবন। কী করে এড়াবো! কারো বাঁধা মানলাম না। নতুন এক জোড়া মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাভস, মোজা পড়ে আম্মাকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলাম। হাঁটার শক্তি তার নেই। শরীর অনেকটা ছেড়ে দিয়েছে। যেহেতু তিনি পূর্বের হার্টের রোগী সেহেতু হৃৎরোগ হাসপাতালে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যদি তার শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করে থাকে তাই রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর দেওয়া নম্বরে ফোন করলাম অনেকবার। ধরলেন একজন। সব শুনে বললেন, ‘‘গলা ব্যথা, জ্বর, শ্বাসকষ্ট হলেই করোনা, এমন নয়। ওনি যদি হার্টের রোগী হয়ে থাকে আগে সেখানে নেন।’’ সংযোগ কেটে গেলো। হৃৎরোগের চিকিৎসা দিতে পারে এমন একটি হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে প্রবেশ করলাম। দু’জন নার্স আড়মোড়া ভেঙ্গে এগিয়ে এলেন, ধরলেন না। কয়েক হাত দূর থেকে দ্রুত ইসিজি মেশিন সেট করার আগে মুখের মাস্ক আর হ্যান্ডগ্লাভস পড়ে কর্তব্যরত ডাক্টারকে ডাকলেন। ডাক্টার তার কন্ডিশন দেখার আগেই শ্বাসকষ্ট দেখে পিছিয়ে গেলেন কয়েক হাত। ইসিজির নির্দেশ দিলেন। নার্সদের মধ্যে কে যাবেন ইসিজি করতে তারা চোখা-চোখি করতে সময় নিলেন। আম্মা আগের চেয়ে নিস্তেজ। শ্বাস উঠছে নামছে। তাড়া দিলাম। ডাক্টার জানালেন, ‘‘হার্টের অবস্থা পূর্বের মতো। তার গায়ে জ্বর অনেক বেশি। ‘‘আইইডিসিআর-এ যোগাযোগ করেছেন? রেফারর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান।’’ ডাক্টার বললেন। কী করে এই হাসপাতালে পৌঁছলাম জানি না। প্রায় শেষ রাতেও অনেক মানুষের ভিড়। সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার গায়ে জ্বর, কাশি। গলা ব্যথা। আমার মনে হয়, আমিও কি ঢুকে যাচ্ছি আইসোলেশনে! আমিও কি কাল থেকে হোম কোয়ারেন্টাইনে! ভাইরাসটি কি ইত:মধ্যে আমার ভেততেও প্রবেশ করেছে? আমার পাঁচ বছরের কন্যার মধ্যে? ইরিনের মধ্যে? আমি আম্মাকে সতর্কতার সাথে জড়িয়ে ধরি। ‘‘আর পারছি না।’’ বলে আম্মা আমার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলেন, ঘুমের শিশুর মতো। আমি আরেকটু জড়িয়ে ধরলাম। অনেকক্ষণ পর একজন লাইন থেকে সরে, একজন এগিয়ে যায়। আমি আল্লাহ্কে ডাকি, ‘‘আল্লাহ্ এই রাত কি শেষ হবে না! এই লাইন!’’ জরুরী বিভাগের প্রতিটি কর্মী চর্কির মতো দৌড়চ্ছে তখনও। নমুনা নিচ্ছে, পরীক্ষা করছে। রোগী ধরছে, রোগী নামাচ্ছে। মানুষে মানুষে গিজগিজ। এ আরেক দুনিয়া। যারা এসেছে সবাই করোনা পজিটিভ হবে এমন নয়। সবার ভয় পজিটিভ কিনা। সবার চোখে আতঙ্ক, উৎক›ঠা। সুবহে সাদিক’র আযান পড়েছে। আসসালাতু খায়রুন মিনান নাওম . . .। আম্মাকে শোয়ানো হলো বেডে। দুজন ডাক্টার এসে দেখলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জানালেন, ‘‘শি ইজ নো মোর!’’
লাশ নিয়ে আমি বাসায়। কেউ নেউ। আত্মীয় না, স্বজন না, প্রতিবেশী না। ইমাম, মুয়াজ্জিন কেউ না। কবরের বন্দোবস্ত হচ্ছে কিনা আমি জানি না। আমি জানি না, আমি কী করবো। দুপুর বারোটা। একটা ফোন-
‘‘আপনি কি মেজবা, নূরুন নাহার বেগমের ছেলে?’’
‘‘হ্যাঁ!’’
‘‘আপনার মায়ের নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি মিলেনি। ইলেক্ট্রোলাইট অতিরিক্ত ফল করায় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।’’ ফোনের ওপাশ থেকে বললেন। ইরিন নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে জিজ্ঞেস করলো- ‘‘কে ফোন করেছে?’’ আমি বললাম- ‘‘হাসপাতাল থেকে।’’
‘‘কি বলেছে?’’
‘‘আম্মার শরীরে করোনার নমুনা পাওয়া যায়নি।’’ এর বেশি আর কিছুই বলতে পারলাম না আমি ।

আট বছর একই সংগঠনে কাজ করছি বলে আমাদের সম্পর্কটা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও মজবুত। প্রায়-লকডাউন এর পূর্বভাস পেয়ে আমি পিরোজপুর চলে আসায় কয়েকটি দিন যোগাযোগ ছিলো না মেজবার সাথে। সে জানালো এ দু:সংবাদটি। টেলিফোনে তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটি এখনো আমার কানে একটু আগে শোনার মতো বাজছে। আমার চোখে ভাসছে উদ্ভুত দৃশ্যটি। খাটের উপর রাখা সেল-ফোনটি বাজছে আবার। আমি জানি না এই ফোন-কলটি কার।

 

জোবায়ের মিলন
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top