সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

মহামারী : ড. শাহনাজ পারভীন


প্রকাশিত:
২০ মে ২০২০ ২০:১২

আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২০:১৮

 

পশ্চিম বারান্দীপাড়ায় যেই কয়টি বাড়ি সম্ভ্রান্ত, তার মধ্যে "অস্থায়ী ঠিকানা" বাড়িটিও অন্তর্ভুক্ত। মেইন রোডের সাথে চারদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটিতে একটি সিংহ দরজা আছে। সিংহ দরজার একপাশে একটি মাঝারি পকেট গেট। দুপাশ থেকেই সেটি খোলা- বন্ধ করা যায়। পকেট গেটটি দিয়ে সব সময় ও বাড়ির সবাই যাতায়াত করে। ও বাড়ির মালিক জনাব আলহাজ মো. নিসার আলী চাচা, তার একমাত্র ছেলে মো. শাহরিয়ার ওরফে বাবু, বুয়া, বাবুর্চি, ড্রাইভারসহ সাধারণ কর্মচারীদের কয়েকজন মাত্র মানুষ অত বড় বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বাড়ির সিংহ দরজাটি সব সময় বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে গাড়ি বের করবার সময়ই শুধু ঐ গেটটি খোলা হয়। প্রতিদিন সকালে শায়মা যখন হাঁটতে বের হয়, তখন প্রায়ই পকেট গেটটি দিয়ে লোকজনের আসা যাওয়ার প্রাক্কালে ভেতর বাড়িতে তার চোখ যায়। সেখানে নানা বর্ণিল ফুল- ফল, ওষধি গাছের সমারোহ, সৌন্দর্য তার হাঁটতে থাকা ক্লান্ত শরীর আর ক্লান্ত চোখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য খচিত ত্রিতল ভবনের বাড়িটির কারুকার্যসহ নাম ফলকের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে শায়মা। নেছার চাচার অসম্ভব সুন্দর শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং দর্শন খুঁজতে থাকে সে। সত্যিই তো, পৃথিবীর এই সমস্ত সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা মানুষের অস্থায়ী ঠিকানা। যতবার সে বাড়িটির দিকে তাকায়, ততবারই তার মনে হয়, এ পৃথিবী ছেড়ে আমাদের যখন তখন চলে যেতে হবে। এই পৃথিবী আমাদের "অস্থায়ী ঠিকানা"।
প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হয়ে প্রথমে সে যখন বাড়িটি অতিক্রম করে, এবং হাঁটা শেষ করে যখন ফিরে আসে, তখন আর একবার এই বাড়িটির নামফলক শায়মাকে ঐ চিরন্তন সত্য কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইদানিং পৃথিবীর এই অসহায় করোনা কালীন মহামারী সময়ের সারাদিনই মনটা ভিজে থাকে শায়মার। কখন কাকে ছেড়ে যেতে হবে, ছেড়ে যাবে! তা মহান আল্লাহ্ একমাত্র ভালো জানেন। বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে, সকালে ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে বের হয় না শায়মা। আজ সকালেই ওর মনে পড়ছিলো 'অস্থায়ী ঠিকানা'র কথা। "অস্থায়ী ঠিকানা"র মালিক নেছার চাচার কথা। আগে প্রায়ই দেখা হতো রাস্তায়, মসজিদের সামনে। দেখা হলেই চাচা আনন্দে যেন খলবল করে উঠতো--
--কেমন আছো মা। তোমার ছেলে মেয়েরা কে কেমন আছে?
--ভাল আছি চাচা। সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?
--এই তো ভালো আছি মা। ভালো থেকো।
কথা শেষ করতে করতে চাচা হনহন করে বেরিয়ে যেতো দ্রুত। নব্বই উর্ধ বয়স, তবুও কেমন ঋজু। সটান মাথা উঁচু, কেতাদুরস্ত চলাফেরা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। দাতা হিসাবে সমাজে সুনাম আছে।
ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে এইসব এলোমেলোা কথা ভাবছিলো শায়মা। হঠাৎ অসময়ে মসজিদের মাইক সচল হতেই ভাবলো-- কোন দুঃসংবাদ! নিশ্চয়ই কেউ গেলো? খরগোশের মতো কান খাড়া করে সে। মনের অজান্তেই হাতে ধরে থাকা চায়ের কাপটা নেমে যায় ট্রেতে।
"একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, আজ সকাল সাড়ে নটায় পশ্চিম বারান্দীপাড়া নিবাসী জনাব আলহাজ নেছার আলী মিয়া তার নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন। 'ইন্না লিল্লাহি অ ইন্না ইলাইহী রাজিউন।' আজ বাদ আসর নাঈম মসজিদ প্রাঙ্গণে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। সকলকে উক্ত নামাজে জানাযায় শরিক হতে অনুরোধ করছি।"

বেশ কয়েক বার একই কথা এনাউন্সড হলো। চাচা ছিলেন এই নাঈম মসজিদের কার্যকরী কমিটির একজন কর্মকর্তা। তাই তাকে বিশেষ ভাবে সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা ছিল বার বার প্রচারিত উক্ত এনাউন্সডে।

কী আশ্চর্য! শায়মার সচেতন মন অবচেতনে ভাবছে-- "ছিলেন" শব্দ টি। অথচ একটু আগেও শব্দটি ছিল আছেন। আর এই এনাউন্সডের প্রথম অংশে চাচার নাম উচ্চারণ করছে, কিন্তু শেষাংশে নামের পরিবর্তে বলছে "মরহুম।"
এই এনাউন্সড শোনা পরেও সে ঠাঁই ব্যালকনিতে বসে থাকে। এখন সময় বড় খারাপ। এই খারাপ সময়ে যে যার ঘরে বন্দি। শায়মার মনে পড়ে, ছোটবেলায়
নানির কাছে শোনা মহামারির নানান গল্প। মাথায় হাজার চোখের উলাদেবী, সরলাদেবীর গল্প। সেই মহামারিতে যে যেখানেই পালিয়ে যেতে চাক না কেন, নদীর পাড়ে ঝুড়িওয়ালা বটতলায় পা ছড়িয়ে বসে থেকেও সে দিব্যি সবকিছু দেখতে পায়। ওর মনে পড়ে যায়, কলেরা সময়ের কথাগুলো। যেখানে এক রাতের ব্যবধানে গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যায় মানুষ। লাশ পড়ে থাকতো যেখানে, সেখানে, রাস্তায়। দাফন, কাফনের জন্য অবশিষ্ট কাউকে পাওয়া যেতো না। খাটিয়ার পরিবর্তে একটি বাঁশের সাথে লাশ ঝুলিয়ে চারজনের পরিবর্তে দুজন স্থানীয় গোরস্থানে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় গ্রাম থেকে দূরে চাপা মাটি দিয়েছে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে নির্বিকার। বিরানভূমিতে কাক, শকুনের ওড়াউড়ি। আকাশ জুড়ে। তারপর কালো মেঘের ঘনঘটা। আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামে আগুন পাখির কল্যাণে। তারপর একদিন সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় সব জঞ্জাল। সব জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে যেতো ধীরে ধীরে। হেসে উঠতো গাছপালাসহ প্রকৃতি।
কিন্তু এমন মূত্য, এমন ভাইরাসের কথা সে আগে কখনও শোনে নি, কেউ শোনে নি কোথাও।

সারা বিশ্ব কাঁপছে মূত্যর আতংকে। আজ পর্যন্ত বিরাশি আশি হাজার মানুষ মারা গেছে এই ভাইরাসে। কী জানি, কোথায় যেয়ে থামাবে এই মৃত্যুর লাগাম?
প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
মানুষ ভয়ে, আতংকে ঘরবন্দি। পুরো দেশ আজ লকডাউনে। নিজের হাতকেও আজ বিশ্বাস নেই। সবাই সবার থেকে আলাদা। মৃত্যুতেও সমবেদনা, চোখের পানির খুব অভাব। লাশের ওপর আছড়ে পড়ে কান্নার গল্পও আজ বিরল।

শায়মার মনে পড়ে গেলো--পবিত্র কোরআনের সেই আয়াতের কথা--

"অবশেষে একটি প্রলয়ংকারী দূর্যোগ তাদেরকে গ্রাস করলো এবং তারা নিজেদের ঘরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো"।

ঠিক এখন যেমন অবস্থা! মনে হচ্ছে যেন এই আয়াতটি আজ এখনি নাযিল হলো। অথচ আজ থেকে পনেরো শত বছর আগে তা নাযিল হয়েছে। তেমনি অন্য একটি আয়াতে বলা হয়েছে--

‘সেদিন মানুষ নিজের ভাই, নিজের মা, নিজের পিতা, নিজের স্ত্রী ও সন্তানাদি থেকে পালাবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর সেদিন এমন সময় এসে পড়বে, সে নিজেকে ছাড়া আর কারও প্রতি লক্ষ্য করার মতো অবস্থা থাকবে না’,

আহা! আজকের এই করোনার দিন ও কেয়ামতের ময়দানের এমন মিল! শায়মা আবারও ভাবনার জগতে ঢুকে যায়।
--শায়মা শুনেছো? নেছার চাচা...
--হুম। শুনলাম। চাচা কী অসুস্থ ছিল?
শায়মা তার বর কায়েস সাহেবকে কথা শেষ করতে দেয় না।
--তা তো জানি না। আজ কতদিন তো মসজিদে যাওয়া হয় না। চাচার সাথে দেখাও হয় না। কেউ তো কিছু বললোও না। অবশ্য ইদানিং দেখাও তো হচ্ছে না কারো সাথেই।
--কিভাবে দেখা হবে? এই মহামারিতে মানুষ মরে গেলেও তো কেউ কাকে দেখতে পারবে না।
--তাই তো। কী সময় আমরা পার করছি, বুঝতে পারছো?
--তাই তো।
--থাক, মন খারাপ করো না, ঘরে আসো। চাচার তো অনেক বয়সও হয়েছিল। ব্যলকনিতে আর বসতে হবে না, রোদ এসে গেছে। আগামীতে কী হয়, কী জানি। করোনার ২৩ তম দিনে যুক্তরাষ্ট্রে রুগী ছিলো ১১ জন। বাংলাদেশের ২৩ তম দিনে ৫১ জন। তবুও টেস্টের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে আমাদের। পুরোপুরি টেস্ট হলে কী হতো কী জানি! এখনও সময় আছে আর একটু সতর্ক হওয়ার। নাহলে চরম মূল্য দিতে হতে পারে আমাদের।
--কিন্তু আমরা কী আসলেই সচেতন হয়েছি?
--যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন এদের মহামারীর দিকে গেছে ৫৫ ও ৫০ তম দিনে। ইতালিতে করোনা সনাক্ত হওয়ার পর ৪৫ তম দিনে মহামারী রূপ ধারণ করে। সুত্র মতে আর ক'দিন হলে বাংলাদেশ মহামারীর পথে পা রাখবে?
--জানো, তবুও অলীক স্বপ্ন দেখি। মৃত্যুর হার তো কমই আছে। তাই থাক। সেই হোক সান্ত¡না।
--ঐ রকম মনে হচ্ছে তোমার। কিন্তু আসল চিত্র কিন্তু পাল্টে যাবে। দেখছো না, সেনাবাহিনী কঠোর হচ্ছে। এক লাখ এর বেশি বেড বানানো হচ্ছে, অস্থায়ী অনেক হাসপাতাল বানানো হচ্ছে। তারপরও চিন্তা হয়, কোথায় গিয়ে ঠেকবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি?
-- তাই তো।
টিভি অন করে শায়মা। গত রাতের টক শোর পুনঃপ্রচার চলছে টিভিতে। কড়া গলায় বলছেন একেকজন বক্তা--

--যিনি চেয়ারে বসে আছেন তাকে সত্যিকারের অবস্থা জানাতে হবে। তেল মারা থেকে বিরত থাকুন। যদি সত্যিকারের নেতা হন, কিংবা সরকারের ভালো চান, তাহলে প্রকৃত সত্যটা সামনে আনুন। এখনি দেশের পুরোপুরি লকডাউন দরকার।

-- মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের এখনও ছয় মাসের খাদ্যের মজুদ আছে। তাহলে আমাদের লকডাউন করতে কোনো সমস্যা নেই তো।

--ছয় মাসের দরকার নেই। মাত্র এক মাস কিংবা দুই মাসের জন্য একেবারে নিম্নবিত্ত ছয় কোটি মানুষের জন্য তাদের আইডি কার্ডের মাধ্যমে তিন হাজার টাকা করে বিকাশ করে পাঠিয়ে দিন। দেখুন এই ক্ষেত্রে খুব বেশি মানুষের প্রয়োজন হবে না।

---এইভাবেই কিন্তু আমাদের অচেনা শত্রু যাকে আমরা চিনি না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে হবে।
করোনাকে সহজ ভাবে নেওয়ায় আর সুযোগ নেই।

নাহ্! আর ভালো লাগছে না। টিভির সুইচ অফ করে শায়মা।

--আজ কতদিন এই ঘরের মধ্যে বন্দি আছি বলো তো, কফি খাবে তুমি? কায়েসকে জিজ্ঞেস করে শায়মা।
--নাহ, কফি খেতে ইচ্ছে করছে না। ঝাল মুড়ি খাওয়া যেতে পারে।
-- তাও হয়। তাই হোক।
ঝাল মুড়ি খেতে খেতে এনড্রয়েড মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট অন করে শায়মা । নানান রকম খবর আর স্ট্যাটাসে ভরে আছে ওয়াল।

"গাইবান্ধা মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে ঠাঁই না পেয়ে রাস্তায় অটোরিকশায় সন্তান প্রসব করেছেন এক প্রসূতি। সোমবার (৬ এপ্রিল) রাত পৌনে ৮ টার দিকে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দুশ' গজ যাওয়ার পর মধ্যপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন তিনি।"

"সুমনের বন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী শাহীদুর রহমান শান্ত বলেন, ‘ওর নিজের ভবিষ্যতবাণীই সত্যি হলো। করোনা সন্দেহে বিনা চিকিৎসায় আরেকটি মৃত্যু হলো। ফুসফুসের পানি বেড়ে যাওয়ায় তার অসুস্থতা বেড়ে যায়, আর ঢাকার কোনো হসপিটাল এডমিট নিতে রাজি না হওয়ায় অবশেষে ধীরে ধীরে মৃত্যু হলো তার।"
'এসময় সে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যায় কিন্তু কোথাও তাকে ভর্তি নেওয়া হয় না। পরে সে নিজ বাড়িতে চলে যায়।’

আহা! কত মানুষ যে এভাবে করোনার ভয়ে বিনা চিকিৎসায় জন্ম নেবে রাস্তায়, মারা যাবে বাড়িতে এই সময়! কত প্রাণ ঝরে যাবে অকারণ!
শায়মা আবার দেখে-

--মসজিদ বন্ধ হয়নি বরং মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি ঘরকে মসজিদ বানিয়ে দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ।
--চাচা ৫ জন ৫ জন করে বার বার জামাত করা যাবে। ৫ বেরিয়ে গেলে আবার ৫ জন ঢুকবে, এভাবে চলবে। ইনশাআল্লাহ ।

শায়মা আবারও অধৈর্য হয়ে যায়।
বাঙালি স্বর্গে থাকলেও নরক দেখার শখ থামাতে পারে না। নাহ! চিন্তা করো কী অবস্থা।
বরের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আবারও
--এই অবস্থায় আসলে সাধারণ মানুষের খাবারের যোগান দেয়াই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই না?

-বর্তমান সময়ে আমরা যে দুর্দিন পার করছি; কিংবা অতীতেও মানুষ যখন এ ধরনের দুর্দিন পার করেছে, তখন মানুষের খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।

-- সরকার যেই সমস্ত প্রণোদনা ঘোষণা করছে, এ ধরনের দুর্দিনে বিত্তশালী নাগরিকরা যদি সরকারের পাশাপাশি স্ব উদ্যোগে এগিয়ে আসতো তাহলে কাজটি আরও সহজ হতো।
--সরকার শিল্পখাতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করলেও শিল্পপতিরা সরকারের জাতীয় তহবিল গঠনে বড় ধরনের কোনো ভুমিকা রেখেছে, তা কিন্তু আমরা দেখছি না। অথচ এই ব্যক্তি মালিকানার পুঁজিবাদি সমাজে এমন সব ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, যারা ইচ্ছে করলে এই সংকট মোকাবেলায় বড় বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

--দেখছো না, ভারতের রতন টাটা যেমন এই মহামারী উত্তরণে পনেরশ কোটি রুপি দিয়েছেন, শাহরুখ খান, সালমান খানদের মতো ব্যক্তিরাও ব্যাপক প্যাকেজ নিয়ে হাজির হয়েছেন; তেমনটি আমাদের দেশে হবে বলে আমার মনে হয় না।

-- তাহলে তো দিন আনা দিন খাওয়া মানুষজনকে রাস্তার মিছিলে নেমে আসতে হতো না।

--সাংস্কৃতিক সংগঠন কিন্তু এ ব্যাপারে এগিয়ে। তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে কিছু কিছু করে সংগ্রহ করে আবার নি¤œবিত্তদের ঘরে ঘরে যেয়ে সেগুলি পৌছে দিচ্ছে। তাদের বিত্তের অভাব থাকলেও চিত্তের অভাব নেই।

--তা ঠিক। যুগে যুগে এমনই হয়। হয়ে আসছে। যদি আইন প্রয়োগে আরো কঠোর হওয়া যেতো, মানুষ কে ঘরে বন্দি করা যেতো তাহলেই আমাদের দেশকে এই মহামারির হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা করা যেতো।
-- তা ঠিক।
-- নেসার চাচার জানাযায় যাবে?
--নাহ । যেখানে নামাজের জন্য মোয়াজ্জিন, খাদেম, ইমামসহ মোট পাঁচ জন মুসল্লী এলাউ সেখানে জানাযায় যাওয়া ঠিক হবে না। সরকারি নির্দেশনা আমরা যদি না মানি তো?
--হুম। তাই তো। এখন আমাদেরকে ঘরে থেকেই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। দেশকে নিরাপদ রাখতে হবে। নিজেদেরকে নিরাপদ রাখতে হবে।

আসরের আযানের পর ধীরে ধীরে জানালায় দাঁড়ায় শায়মা। শায়মাদের শোবার ঘরের উত্তর দিকের জানালা দিয়ে সোজা নায়েম মসজিদ রেখে একেবারে ঢাকা রোড লাগোয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা পর্যন্ত দেখা যায়। আর দক্ষিণের জানালা দিয়ে কদমতলা মোড় ছাড়িয়ে একেবারে প্রায় রাঙামাটি গ্যারেজ পর্যন্ত চোখ যায়। আর পশ্চিমের জানালা দিয়ে সামনের রাস্তাসহ সামনের বাড়িগুলোর সবকিছু।
নেছার চাচার জানাযার নামাজ দেখতে শায়মা আর কায়েস দুজনেই গা ঘেষাঘেষি করে উত্তরের জানালায় দাঁড়ায়। ও অবাক হয়ে দেখতে থাকে- এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ-- পাঁচটি কাতারে কাঁধে কাঁধ রেখে মানুষ দাঁড়িয়ে গেল শত শত। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুতে মানুষ কী ভুলে গেলো আমাদের এই কোয়ারান্টাইনের কথা? আমাদের মহামারির কথা?
কী করে আমরা এ থেকে রক্ষা পাবো মহান আল্লাহ্র ভালো জানেন।
হে আল্লাহ্ তুমি নিজ গুণে আমাদেরকে ক্ষমা করো। রক্ষা করো। জানাযা শেষ হতেই লাশ ওঠানো হলো ট্রাকে। জানালায় দাঁড়িয়েই নেছার চাচাকে চিরবিদায় জানিয়ে
খুব শান্ত হাতে জানালার ভারী পর্দা টেনে দিয়ে আসরের নামাজের প্রস্তুতি নেয় তারা। মহামারি সময়ে নেছার চাচাকে একবার শেষ দেখা হলো না। জানাযায় শরিক হওয়া গেলো না।
আহা!
অজানা কষ্ট আর আশংকায় ভার হয়ে থাকে দুজনেই। এরই মধ্যে পূর্ব বারারন্দীপাড়ার মসজিদ থেকে অস্পষ্ট ভেসে আসে আর একটি মৃত্যু সংবাদ।
শোক সংবাদ, শোক সংবাদ।
অত্যন্ত গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, ...
শায়মা খান খাড়া করে বুঝতে চেষ্টা করে, জোড়া দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসা অস্পষ্ট শব্দগুলো স্পষ্ট করতে...

 

ড. শাহনাজ পারভীন
কবি, কথাসাহিত্যিক, উপাধ্যক্ষ, উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top