সিডনী বুধবার, ১৭ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

সিঁদুরে মেঘে বিয়ে : সাঈদা নাঈম


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২০ ২২:১২

আপডেট:
১৭ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৫৭

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে অহনা জানালার পর্দা দুপাশে সরিয়ে দিলো। বাইরের আবহাওয়া দেখে ওর মনটা ভরে গেল। কী সুন্দর নীল আকাশ! চকচকে সবুজ পাতা প্রতিটি গাছে। ফুরফুরে বাতাস জানালা দিয়ে আসছে। সারারাত অবশ্য বৃষ্টি ঝরেছে। এখন আকাশ একেবারে ঝরঝরে পরিস্কার। জানালা দিয়েই পাশের বাড়ির বাগানটা দেখা যায়। হাসনাহেনা ফুলগুলো এখনও ফুটে আছে। সামনে গেলে নিশ্চয়ই সুবাস পাওয়া যেত। কেমন মাতাল করা সুবাস। খুব ভালো লাগে অহনার। 

ভালো লাগা মন নিয়ে ফ্রেস হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে গেল। ওখান থেকে বের হয়ে সোজা ডাইনিং রুমে। প্রথমে পানি খেল এরপর কাজের মেয়েটি চা নিয়ে এলো মগ দিয়ে। পিছনে অহনার মা। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,

---কত যে বলি কিছু একটা মুখে দিয়ে এরপর চা খা। একদিন একটা অসুখ বাধাবি তখন মজা বুঝবি।

অহনা যে কিছু খাওয়ার চেষ্টা করেনি, তা নয়। কিছু মুখে দিলেই সকালবেলা ওর কেমন বমি বমি লাগে।

তাই আর চেষ্টা করে না। মায়ের বকুনি খেয়ে চা খায় পরম তৃপ্তীতে। চা খেয়ে প্রতিদিন কলেজে যায় ক্ষিধা লাগলে তখন কিছু খেয়ে নেয়। বাসায় থাকলেও তাই করে। আজ আর মা বেশিকিছু বললেন না। চা খেতে খেতে বরং কিছু উপদেশ দিলেন। আজ অহনার জন্য একটি বিশেষ দিন। আজ ওকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে এবং আংটি পড়িয়ে বিয়ের তারিখ ফিক্সড করবেন।

অহনার আগেই শর্ত ছিল, এম.বি. শেষ না করে বিয়ে করবে না। পরীক্ষা শেষ এখন শর্ত পূরণ করার সময়। আগে থেকেই সম্বন্ধটা ঠিক করা ছিল। অহনার কোনো দ্বিমত নেই। অহনা খেয়াল করলো নাস্তার টেবিলে ওর মা বেশি সময় থাকলেন না। রান্না ঘরের দিকে চলে গেলেন। কেমন উৎসব উৎসব ভাব আজ বাসায়। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আজ তো তিনি মহাব্যাস্ত মানুষ। কত শখ এই বিয়ে নিয়ে। রান্না - বান্না, ঘর গুছানো সবকিছু করছেন। বাবা বেঁচে থাকলে আজ এমনই খুশি হতেন নিশ্চয়ই। নাকি মেয়ে বিয়ে দিলে চলে যাবে, পর হয়ে যাবে নাকি? সব ভেবে মন খারাপ করে থাকতেন?

অহনা আর কিছু ভাবতে চায় না। নিজে তন খারাপ করে মায়ের মনটা খারাপ করতে চায় না। তাই তাড়াতাড়ি নিজের রুমে চলে এলো। একটু পর ওর মা এসে বলে গেলেন,

----- দুপুরের পর একটু পার্লারে যাবি। আর তোর বান্ধবী কণাকে বলেছিস? দে ফোনটা করে দে ওর মাকে বলি কণাকে পাঠিয়ে দিতে। দুপুরে এখানেই খাবে। বেশী কাউকে বলিস না।

অহনা বলল, তা না হয় বলবো না। কিন্তু পার্লারে কেন? ওরা দেখতে আসবে। ন্যাচারাল লুকটাই তো ভালো মা।

------ হ্যাঁ, সেই ন্যাচারাল ভাবটাই পার্লার থেকে একটু পরিপাটি করে আসবি। তোকে তো পার্টি মেকআপ নিতে বলিনি।

-----ঠিক আছে মা। আজ তোমার দিন, যা বলবে তা করবো।

মায়ের আনন্দ দেখে অহনা আর না সূচক কোনো কথা বলে আনন্দটা নষ্ট করতে চাইলো না। আর কী চাই অহনার! মা আনন্দে থাকবে, ছোট বোনটা পড়াশোনা করে ভালো রেজাল্ট করবে। এটুকুই চাওয়া। প্রাপ্তি কতটুকু তা সৃষ্টিকর্তা জানেন। তিনিই নির্ধারন করে রেখেছেন। আমরা শুধু চেষ্টা করে যেতে পারি, এরচেয়ে বেশিকিছু না।

যথারীতি মায়ের কথা মতো দুপুরের পর কণাকে নিয়ে পার্লারে গেল। একেবারে ন্যাচারাল লুক একটা মেকআপ নিলো। চুলটা ছাড়া রাখলো। ময়ূরকন্ঠী রঙের একটা শাড়ি পরলো। বর্ষা ঋতুতে নীল, আকাশি, ময়ূরকন্ঠী রঙগুলো খুব ভালো লাগে। অহনাকে বেশ সুন্দর লাগছে। পার্লার থেকে ফেরার পর ওর মা খুব খুশি হলেন মেয়েকে দেখে।

হঠাৎ তিনি বললেন,

-----দাঁড়া, একটা জিনিস বাদ গিয়েছে।

অহনা, কণা আর ছোট বোন অবাক হয়ে জানতে চাইলো,

------ কি বাদ গেল আবার! সবই তো ঠিক আছে।

ওর মা ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে টিপের পাতা বের করে ম্যাচিং করে একটা টিপ পরিয়ে দিয়ে বললেন,

---- এবার ঠিক আছে। পারফেক্ট। আর শোন ওদের সামনে ধীরে ধীরে কথা বলবি। এই তোরাও।

সবাই আশ্বস্ত করলো। আর বলল,

----- চিন্তা করো না। আমরা ধীরেই কথা বলবো। তুমিও একটু রেডি হয়ে নাও।

-----হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাইতো যাচ্ছি। ওরা আসবে সাতটার দিকে। বেশি সময় নেই। 

ওর মা রুমে থেকে যাওয়ার পর অহনা আবার জানালার সামনে গেল।

       সূর্য ডুবে গেছে কিছুক্ষণ আগে। রক্তিম আভা এখন মিশে যায়নি। তবে আকাশে মেঘ জমেছে। কোথাও ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, কোথাও পুঞ্জে পুঞ্জে উড়ু উড়ু মেঘ। এখন মনে হচ্ছে সিঁদুরে মেঘ। কণাকে ডেকে দেখালো। কত সুন্দর লাগছে আকাশটা!

----কণা দেখ, মেঘের খেলা।

-----মেঘের খেলা?

-----হ্যাঁ, এখন গলা ছেড়ে গান গাইতে পারতাম যদি।

----গা, না করলো কে?

----- না, যে কোনো সময় ওরা চলে আসবে।

------হ্যাঁ রে কণা এখন যদি বৃষ্টি আসে কি হবে?

-----আসুক, তখন তুই গান গাইবি ;বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এলো বান "

      কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁদুরে মেঘ কেটে গেল। ভেবেছিল মেঘের পাহাড় বুঝি গলতে শুরু করবে, কিন্তু না। মেঘরাজাও বোধ হয় আজ আনন্দে আছে। পাত্রপক্ষ আজ আংটি পড়িয়ে তারিখ ঠিক করবে, কথা যেন মেঘরাজা বুঝতে পেরেছে। তাই দলবল নিয়ে ভেসে গেল।

 কণা অহনাকে প্রশ্ন করলো

____কি রে তোর "মেঘদূত "কে দেখতে পেলি?

------মেঘদূত!

------ যাকে দিয়ে খবর পাঠালি।

অহনা হেসে বলে পারিস তুই।

----ধ্যাৎ, দুষ্টুমী করিস না। তোর সিঁদুরে মেঘকে বলে দে পক্ষকে যেন গিয়ে বলে আসে, তুই তৈরি হয়ে বসে আছিস। উড়ে উড়ে যাবি কিন্তু।

   এইকথা শুনে দুজনেই হাসলো। হাসি শুনে ছোটবোন দৌঁড়ে এলো।

----কি হয়েছে আপু? তোমরা হাসছো কেন?

----কিছু না, এমনিতেই।

-----দেখোতো আপু, আমি ঠিক আছি কি না? নাকি ড্রেসটা চেইন্জ করবো?

-----না, ঠিক আছে। ডানাকাটা পরী লাগছে। মা কোথায় রে?

------রান্নাঘরে।

অহনা কণাকে বলল, চল রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা কি করছে। 

----না, এখন গেলে আন্টিও তোকে বোকা দিবে। টিভি দেখি চল। 

অহনা ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো পুরো বাসাটির চেহারা মা বদলে দিয়েছে। সব মায়েরাই মেয়ের বিয়ের জন্য অনেককিছু জমিয়ে রাখে। শখ, ইচ্ছে, নতুন জিনিস।

ওর মা ফ্লোর ম্যাট থেকে শুরু করে ঘরের পর্দা, বিছানার চাদরে, আরোও নতুন সংযোজন ফ্লাওয়ার বাস্ক,সো পিছ সবকিছু নুতন। অহনার দেখতে ভালো লেগেছে। ড্রয়িং রুমে থেকে চিৎকার করে বলল,

------মা তুমি তো বাসাটাকে একেবারেই বদলে দিয়েছো। আমিই চিনতে পারছি না।

মা রান্নাঘরে থেকে জবাব দিলো --

-------তুই মা হলে, তুই স্বপ্ন দেখবি কি করে সন্তানের বিয়ের সময় বাসাকে নুতন করে সাজানো যায়। অহনার মনে হচ্ছে বাসাটিকে একটা স্বপ্নপুরী বানিয়েছেন। রাজকন্যা আর আদনান রাজপুত্র।

হ্যাঁ, আদনান। যার সাথে ওর বিয়ের কথা হচ্ছে আজ আংটি পরাবে। এই রাজপুত্রের নাম আদনান।

এরই মধ্যে মামা - মামী চলে এলেন। সবার জন্য কিছু না কিছু গিফট কিনে এনেছেন। ছেলের পক্ষের সবার জন্য। এটি মামীর স্বভাব। কেনাকাটা করতেও পছন্দ করেন। অহনার বাবা মারা যাওয়ার পর এই মামা - মামী সবসময় মা' সাথে ছিল। এমন মামা - মামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অহনার মায়ের জন্য একটা শাড়ি এনেছেন। জোর করে শাড়ি চেইন্জ করালেন। এরপর নিজে ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে।

সন্ধ্যার ঘনঘোর মেঘের ভেলায় চড়ে যেন ছেলের পক্ষের যাদের আসার কথা ছিল সবাই এলেন। সুন্দরমতো সবকাজ সম্পন্ন করে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সালাম পর্ব শেষ করে সবাই বিদায় নিলেন। সব যেন স্বপ্নের মতো লাগছে। বেশি রাত হয়ে গিয়েছে বলে কণার মাকে ফোন করে অহনার মা ফোন করে অনুরোধ করলেন আজ রাতটা থেকে যাক। কাল যাবে। কণার মা সম্মতি দিলেন।

অহনারও ভালো লাগলো। গল্প করা যাবে কণার সাথে। কিন্তু ঘটলো উল্টো ঘটনা। আদনান অহনার মোবাইল নাম্বার নিয়েছিল। রাত বারোটা বাজতেই আদনান ফোন করলো। কথাতে প্রথম লাজুক ভাব থাকলেও ধীরে ধীরে সেটি কেটে যায়। আর কখন যে রাতও কেটে গেল কেউ টের পেলো না। আর কণা তো পাশে আয়েস করে ঘুমাচ্ছে।

অহনার মনে হচ্ছে মেঘের ভেলায় চড়ছে। আর ওর সারথী আদনান। কিন্তু এরই মাঝে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সবকিছু কেমন যেন ওলট পালট লাগছে। কাঠফাটা রোদ্রের মাঝে যেমন বৃষ্টির প্রয়োজন। তেমনি জীবনের চলার পথে সঙী প্রয়োজন। সেই দায়িত্ব আজ থেকে আদনান নিয়েছে। বাকীটা আল্লাহ জানেন, কী আছে ভাগ্যে?

 সকালের আলো ফুটে উঠেছে গুনগুনিয়ে অহনা ওর প্রিয় একটি গান গাইছে "আজি ঝরো ঝরো মুখরও বাদল দিনে,

জানি নে জানি নে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না ...."

জীবনের কোনোকিছুই কেউ জানে না। সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। অভিভাবক সৎ এবং সু পাত্রেই কন্যাকে পাত্রস্ত করতে চান। কেউ সফল সার্থক হোন, কেউ হোন না। এই ভেবে অহনার মা সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। মেয়েটি সুখী হবে তো? ভালো থাকবে তো? ভিতরে এখন নুতন স্বপ্ন।

মা আর মেয়ের নুতন স্বপ্নের ভাবনারা একত্রিত হয়ে সুন্দর একটি দিনে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। আর বিয়ের রাতে আদনান অহনাকে অবাক করে দিয়ে একগুচ্ছ হাসনাহেনা ফুল উপহার দেয়। আদনান জানতো অহনার ফুলটি খুব পছন্দ। কারণ আদনান প্রায়ই খেয়াল করতো, অহনা ওদের বাগানের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসনাহেনা গাছটিই দেখতো। বিশেষ করে বর্ষার দিনে। অহনার জানালা দিয়ে আদনানদের বাড়ির বাগানটিই সবার আগে চোখে পড়ে।

 

সাঈদা নাঈম
(লেখক ও প্রকাশক, সংগঠক)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top