সিডনী মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল ২০২৪, ১০ই বৈশাখ ১৪৩১

 ‘অদিতি’ : মিনা মাশরাফী


প্রকাশিত:
২৭ মে ২০২০ ২২:৫৩

আপডেট:
২৭ মে ২০২০ ২৩:০৩

 

অষ্ট্রেলিয়ার সিডনি সিটির মেইন শহরের  রাস্তার মোড়ে একটি জীপের সাথে ট্যাক্সির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে গেল মানে অকস্মাৎ এক্সিডেন্ট। উন্নত দেশ সিডনিতে যা সাধারনত হয়না। নির্দিষ্ট লেন দিয়ে এক শ’ কি: মিটার স্পীডে গাড়ী চলে এসব  শহর গুলিতে সচরাচর। ট্যাক্সি চালক ডা: মামনু সিট বেল্ট ছিন্ন করে ছিটকে পড়লেন ফুটপাতের উপর -- একজন পথচারীর ঠিক্ পায়ের কাছে। নার্সের ইউনিফর্ম পরা  অদিতি ডরমেটরি থেকে বেরিয়েছিলেন হসপিটালের দিকে। আজ ওর ডিউটি রয়েছে মর্নিং সিফটে তাই দ্রুত গতিতে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক্ এই মুর্হূতে রক্তাক্ত অবস্থায় আহত ব্যাক্তিটি  ঠিক তার পায়ের কাছে  ছিট্কে এসে পড়লো ----   প্রথমে কিং কর্তব্য বিমূঢ় ! কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না অদিতি। ইতিমধ্যে  আরও দু’একজন  পথচারী তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন। লেট আছ গো-- লিফট্ হিম ইমারজেন্সি হসপিটাল। একটু ভাবনা হলেও ভাবনাকে এড়িয়ে একজন সেবিকা হিসাবে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে কাল বিলম্ব আর নয় একটু এগিয়ে পাশের পুলিশ স্পট থেকে একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে আহত ব্যাক্তিকে পুলিশের সহযোগীতায় ট্যাক্সিতে তুলে হসপিটালে নিয়ে গেলেন অদিতি নিজেই উদ্যোগী হয়ে।

হসপিটালের বেডে দেয়ার পর ডা: মামুন কথা বলতে পারছেন না কিন্তু ইশারায় বার বার বলছেন  তার পেটের সাইটে ভিতরে রক্তক্ষরন হচ্ছে  ইস্প্লীন্টারের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে জরুরী অপারেশনের কথা বলতে চাইছেন। এক সময় ডা: মামুন, নার্স অদিতির হাত চেপে ধরে অবশেষে বোঝাতে সক্ষম হলেন।  অদিতি সিনিয়ির নার্স ডা: মামুনের বিষয়টা বুঝতে পারলেন এবং মুহূর্ত দেরী না করে দ্রুত ছুটো ছুটি করে কর্তব্যরত  ডাক্তারকে ইনফর্ম করেন এবং জরুরী ভাবে অপারেশনের জন্য বিশেষ অনুরোধ করেন। তার অনুরোধের আকুতি লক্ষ্য করে কর্তব্যরত ডাক্তার অদিতিকে প্রশ্ন করেন: ডু ইউ নো হিম?  অদিতি অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা  করে জবাব দেয় ---   নো স্যার, বাট আই ফিল -- নাউ  হি ইজ  এক্সট্রিমলি  সিরিয়াস প্যাসেন্ট।  এন্ড  আই  থিং  হি ইজ অলসো  এ  ডক্টর স্যার ! হি টোল্ড মি ইন্টারনাল ব্লিডিং ইনসাইড অফ হিজ স্টোমাক এন্ড টেক অফ ইমারজেন্সি  সার্জারী। ডাক্তার : অ... আই সি --- এবং অদিতিকে  বললেন  ডোন্ট ওরি। আই হ্যাব টু ডু সামথিং ইমিডিয়েটলি। খুব দ্রুত অপারেশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অদিতি অনেক বড় একটা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে গলায় ঝুলানো যিশুর ক্রসবিদ্ধ লকেটটি কপালে ছুঁইয়ে যিশুকে কায় মনে  স¦রন করলেন।

ডা: মামুনকে জরুরীভাবে প্রস্তুত করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে য়াওয়া হলো।ক্রেচার থেকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানোর সময় অসুস্থতার মধ্যেও অনেক চিন্তা মাথায় এসে ভিড় করে ডা: মামুনের, বিদেশ বিভ’ঁইয়ে একাকী বসবাস, কে কার আপন? সবই আল্লাহর  ইচ্ছা। তাঁর  বুঝতে মোটেও  অসুবিধা হলো না  অদিতি এ হসপিটালের একজন সিনিয়ার নার্স। মনে মনে  মহান আল্লাহ্র কাছে তাঁর কৃপার জন্য  শুকরিয়া আদায় করলেন। হঠাৎ ডা: ডানকিনের প্রশ্নে সচকিত হয়ে উঠেন । সামনে দেখলেন সুদর্শন ডাক্তার অপারেশনের  প্রস্তুতি নিয়ে হাতে গ্লাবস মুখে মাকস লাগাতে লাগাতে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন:  আর ইউ ডক্টর?  ডা: মামুন কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানাতে পারলেন অতি কষ্টে। ও কে  মাই ফ্রেন্ড বললেন ডা: ডানকিন,তারপর ডা: মামুনের মাথায় হাত বুলিয়ে  সান্তনার সুরে বললেন -- নো প্রোবলেম , নো টেনসন , ইউ আর ওকে, উই আর ট্রাইং আওয়ার বেস্ট। আই থিঙ্ক টুমোরো  ইউ ফিল মোর বেটার।

অপরেশন থিয়েটারে  অদিতি ফুল ইউনিফর্মে ব্যস্ত ত্রস্ত ডাক্তারদের সাথে সহযোগীতা করে যাচ্ছে। অসুস্থ ডা: মামুনের চোখের সামনে ডাক্তার নার্সদের বিচরন অপারেশন যন্ত্রপাতির টুংটাং শব্দ আস্তে আস্তে আবছা হতে হতে গভীর অবচেতনে নি:সাড় হয়ে পড়লেন।

ভোরের আলোয় আকাশ ঝলমল চিক্ চিক্ সোনালী রোদের ঝিলিক্ কেবিনের জানালায় কি যেন বলে যেতে চায়। আহত মামুনের ঘুম ভাঙ্গলো নতুন এক অবর্ননীয়  সকালের সোনা রোদ মাখা  শুভ্র বিছানায়। মামুনের আজ খুব মনে হচ্ছে শরতের শিউলী বিছানো ঘাসের বুকে একটি শিশির বিন্দু – বাংলাদেশের শ্যামল মায়া মমতায় ভরা কত শত স্মৃতি। মনে পড়ছে দেশ মা’ মাটি স্বজনের মমতার  শিহরিত আবেশ। সিডনিতে চাকুরীর সুবাদে আসতে হয়েছে। দেশের বাইরে নানা প্রতিকুলতায় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সাবলীল গতি অনেকটাই ব্যাহত। প্রবাসে একাকী জীবনে দেশের কথা বড় বেশী করে মনে পড়ছে। ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ’ গানটির সুর যেন হৃদয়ের তারে বেদনার সুরে বেজে চলেছে। ভাবতে ভাবতে কখন যেন গাল বেয়ে অশ্রুর ঝর্ণাধারা বয়ে চলেছে  --    আকুলি বিকুলি হৃদয় যখন তোলপাড় , ঠিক্ এ সময়ে --  গুড মর্নিং বলে  অদিতি কেবিনে  প্রবেশ করলেন। ডা: মামুন নিজেকে সামলে নিয়ে  বললেন -- ‘ওয়েলকাম সিষ্টার’  কিন্তু ডা: মামুনের  বেদনা অশ্রু অদিতির চোখ এড়াতে পারেনি। অদিতি  পরম মমতায় ডা: মামুনের কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছেন, আজ কেমন লাগছে, অনেক বেটার নিশ্চই? বাংলা ভাষা অদিতির মুখে? তবে কি অদিতি বাংলা জানে? ও.. তবে বুঝতে পেরেছে আমি বাঙ্গালী, আমি বাংলাদেশী। অসুস্থ ডাক্তার মামুনের মুখে যেন স্নিগ্ধ জোস্নার ঝিলিক  ফুঠে উঠেছে  --- সিস্টার  আপনি বাংলা জানেন? অদিতি শান্ত কন্ঠে জবাব দেন ‘আই এ্যাম ফ্রম বাঙলাদেশ আমি বাঙ্গালী’ । ডা: মামুন : আজ আমি অনেক সুস্থ বোধ করছি। সিস্টার গতকাল আপনি আমার পাশে না থাকলে  আমি বেঁচে থাকতাম কিনা জানিনা। অদিতি: সব ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রভুর কৃপা। না তারপরও আমি একজন ডাক্তার আমি বুঝতে পারছিলাম স্পিøন্টারে রক্তক্ষরন হচ্ছে চট্ জলদি অপারেশন প্রয়োজন – আমি কথা বলতে পারছি না ডাক্তার তখনও কাছে নেই আপনাকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কারন ভেতরের রক্তক্ষরন বাইরে থেকে সরাসরি বোঝা যায় না --  দেরী হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যেত, বাঁচা মরার সম্মুক্ষীন ছিলাম, যা আমি আপনাকে ইশারায় খুব দ্রুত বোঝাতে পেরেছি, ডাক্তারকে বোঝানোর সময়ও ছিলনা। আর আপনার আন্তরিকতার জন্য  ডাক্তারকে কনভিন্স করে জরুরীভাবে দ্রুত অপারেশনের  ব্যাবস্থা করেছেন। আমি কি বলে আপনাকে যে কৃতজ্ঞতা জানাই। চিরকাল  আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। ডা: মামুনের মোবাইলের রিং টোন বেজে উঠলো অদিতির হ্যান্ডব্যাগে। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার সময় পকেটের মানিব্যাগ মোবাইল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র  অদিতির হ্যান্ড ব্যাগে রেখেছিল অদিতি নিজেই। অদিতি হ্যান্ড পার্টস থেকে মোবাইলটা বের করে ডা: মামুনের সামনে এগিয়ে ধরে বলেন , আপনার ফোন দেশ থেকে সম্ভবত। ডা: মামুন মোবাইল হাতে নিয়ে --  হ্যালো আপা সালাম, তোমরা কেমন আছ? আমরা ভাল আছি, তুই কেমন আছিস মামুন? আপু আমি হাসপাতালে , একটা এ্যাক্সিডেন্ট করেছিলাম এখন ভাল আছি। বাংলাদেশের একজন নার্সের মানবিক দয়া ও আন্তরিক সেবায় আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর কৃপায় প্রবাসে এমন স্বজন পাওয়া বড় ভাগ্য। অদিতি : ডা: মামুন  প্লিজ কথা সর্ট করুন, আপনার এখন বেশী কথাবলা  ঠিক নয়, ডাক্তারের নিষেধ আছে। ডা: মামুন মোবাইলে: আপা আমার  খুব ক্লান্ত লাগছে, বেশী কথা বলা এখন  নিষেধ, তুমি আমার জন্য মেয়ে দেখেছ  এসব বিষয় নিয়ে পরে কথা বলবো  চিন্তা করোনা  আমার জন্য দোয়া করো  আজ রাখি। অদিতি  এবার একটু কাছে এগিয়ে এসে বললেন : এবার  একটু উঠে বসতে হবে আপনাকে ওষুধ খাইয়ে দেবো। তার আগে ওয়াসরুমে যেতে চাইলে চলুন হুইল চেয়ারে আমি আপনাকে হেলপ্ করবো। ডা: মামুন  ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এলেন অনেক কষ্টে অদিতির সাহায্য নিয়ে।

হসপিটালের খাবারের ট্রলি এসে গেছে --  অদিতি রোগীর ব্রেকফাস্ট রিসিভ করলেন।ডা: মামুনকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে  প্রয়োজনীয় ওষুধ খাইয়ে  বেডে শুইয়ে দিলেন। অদিতি  এবার বিদায়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে গেলে ডা: মামুন তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন , ভাবছেন কত মায়া মমতায় বাঙ্গালী মেয়েরা রোগী / মানুষের সেবা দিয়ে থাকে, প্রতিটি র্স্পশে সেবায় যত্নে যেন বাংলা মায়ের পরশ অনুভব করছেন তিনি।

অদিতি: এই যে দেখুন  ---    এখানে কল বাটম, জরুরী প্রয়োজনে বাটম চাপবেন সাহায্যকারী চলে আসবে। আজ আমার অন্য ওয়ার্ডে ডিউটি রয়েছে এ্যাটেন করেই আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। ভাল থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন বলে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই ডা: মামুন অদিতির হাতটা চেপে ধরেন : প্লিজ সিস্টার --  আর একটু বসুন। অদিতি : নো প্রবলেম, দরকার হলে আমাকে ফোন দেবেন, এই নিন নম্বর রাখুন,আমি চলে আসবো। আমি সবময় আপনার পাশেই থাকবো চিন্তা করবেন না। আফটার অল একদেশের মানুষ তো দেশী বলে কথা। তাছাড়া সকাল ৯টা ৩০  মি: এ ডা: ডানকিন রাউন্ডে আসবেন তখন আমিও সঙ্গে আসবো। ‘বেস্ট অব লাক’  বলে অদিতি মাথায় হাত বুলিেিয় দিয়ে চলে গেল। পিছন ফিরে বলে গেল আপনার জন্য নিউজ পেপার নিয়ে আসবো , ভালো থাকবেন বাই -- । 

অদিতির আন্তরিক সেবা যত্ন ও ডা:  ডানকিনের  তত্ত্বাবধানে পনের দিনের মধ্যে ডা: মামুন অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও একমাস হসপিটালে থাকতে হবে।

প্রতিদিনের মত  হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে  আজও বাসায় ফিরে  প্রার্থনা সেরে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে। আজ আর খিদে নেই  খাওয়ার ইচ্ছে একেবারে নেই। দাঁতব্রাশ করা হয় নাই ভাবছে একবার উঠতেই হবে। সারাদিন মায়ের সাথে কথা হয় নাই, মা’ ফোন করেছিলেন  --   পরে কথা বলবো বলে রেখে দিয়েছিলো।  এখনও এত্তসব  দায়িত্ব বিছানায় যাওয়ার আগে দুত্ ছাই একটুও ভাল লাগছে না। আগামীকাল রোববার  গীর্জায় যেতে হবে। আজকাল নিয়মিত  প্রার্থনায় বসা হয়না, গীর্জায় যাওয়া হয়না। অনেক ভাবনা অদিতিকে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরে আছে --  ডা: মামুনের বিষয়টাকেও এড়িয়ে যেতে পারছেনা এক মুহূর্ত। ডা: মামুন বেশ হ্রান্ডসাম সুঠাম শরীর সাবলিল কথা বলার ভঙ্গি রোমান্টিক আবেশে অদিতিকে মোহমুগ্ধ করে রেখেছে অনুক্ষন। আর এই আবেশে  অন্যসব কাজে অনিহা  অবহেলা অলসতা অদিতির, কি চায় অদিতি? সেতো কুমারী দীক্ষা নিয়েছে, কোন বন্ধনে মিলবেনা একমাত্র ঈশ্বরের  বন্দনা ছাড়া কোন দিকে মন দেবে না। তবে কেন অবাধ্য উতলা মন বার বার উদাস হয়ে যায়? 

ডা: মামুন দিনে দিনে সুস্থ হয়ে উঠছেন বিশেষ করে  অদিতির আন্তরিক সেবাযত্ন, ওষুধপত্রের নিয়মিত সেবন, বিশ্রাম আরাম ঘুম, একটু হাটাহাটি করানোর সব দায়িত্ব  দিয়েছেন অদিতিকে ডা: ডানকিন। মূলত: অদিতির প্যাসেন্ট হিসাবে স্পেশাল কেয়ার পাচ্ছেন ডা: মামুন।

ইদানিং নাইট শিফ্টে অন্য ওয়ার্ডে নির্ধরিত ডিউটির ফাঁকে অদিতি অধিকাংশ সময় কাটান ডা: মামুনের সাথে। ডা: মামুনের হৃদয়ের আবেশে  জড়িয়ে আছে যেন অদিতির ছায়া যদিও ডা: মামুনের বিয়ের জন্য দেশের আত্মীয়স্বজনকে জানিয়েছেন পাত্রী দেখতে --  আরও জানিয়েছে মেয়ে যেন সুন্দরী ফর্সা লম্বা হয়। বড়বোন মেয়ে দেখেছেন ছবি পাঠিয়েছেন  এ পযর্ন্ত একটা মেয়েও পছন্দ হয় নাই  ডা:মামুনের । বড় আপাকে এ নিয়ে খুব বিরক্তই করছেন তিনি।

ডা: মামুনের স্বপ্নের কল্পনার জীবন সঙ্গীর আকৃতি প্রকৃতি রুপ লাবন্য অদিতির সাথে একটুও মেলেনা অথচ .. .. ইদানিং হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে আছে অদিতি। ভোরের স্নিগ্ধ আলো ফুটে উঠার মুহূর্ত থেকে  অপেক্ষার প্রহর গুনে পথ চেয়ে থাকেন ডা: মামুন। সারারাত কি আবেশে মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকে --   ভোর হলেই দেখা হবে অনিমেষ প্রত্যাশায় বুক কাঁপে।

গতকালও ফোন করেছিল বড় আপা পাত্রী বিষয়ে মতামত জানতে , মামুন  বলতে পারেনি কিছু  শুধু সময় চেয়েছে অজুহাত দিয়েছে,  একটু সুস্থ হয়ে উঠি তারপর এবিষয়ে জানাবো ---   কথার মাঝ খানেই অদিতির আগমন মোবাইলে কথা বলতে দেখে  মামুনের হাতটা ধরে  পালস্ চেক করে নিল অদিতি। কপালে হাত দিয়ে টেম্পারেচার দেখলেন। তারপর থার্মোমিটার বের করতে করতে কানে এলো  - অদিতি একজন সিনিয়ার নার্স আমাকে যত্ন আত্মি করে সারিয়ে তুলছেন  আপন জনের মত সেবা দিয়ে । খুব ভাল মনের মানুষ। বাংলাদেশের মেয়ে তো। আপা তুমি একটু  অদিতির সাথে কথা বলো --  মোবাইল টা এগিয়ে দিয়ে  অদিতিকে কথা বলতে অনুরোধ জানালেন ডা: মামুন। অদিতি স্নিগ্ধ নরম সুরে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে, বড় আপা সম্মোধন করে  অস্ট্রেলিয়ায় আসবার জন্য আমন্ত্রন জানালেন।ওপার থেকে বড় আপা বললেন :  আমার ভাইটার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে তারপর নিশ্চই যাব, তখন তোমাদের সাথে দেখা হবে। মামুনের মুখে তোমার অনেক প্রশংসা  শুনেছি ওর এ্যাক্সিডেন্টের পর তুমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করেছ অসুস্থ অবস্থায় তুমি খুব সহযোগীতা করে যাচ্ছ আন্তরিক ভাবে। তাই তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। অদিতি : না আপা  তেমন কিছু করিনি এটুকুতো মানবিক দায়িত্ব। বড় আপা আসুন অস্টেলিয়ায় আমরা মা’ ভাই বোন  সবাই এখানেই থাকি। দেশ থেকে কেউ এলে খুব ভাল লাগে। বড় আপা : ও শুনেছি তোমরাতো বাংলাদেশী। দেখা হতে পারে। মামুনকে দেখে রেখো  ও দেশেতো আর  আপনজন কেউ নেই দেশী হিসেবে তোমরাই আপন। কথা শেষ করে মোবাইলটা মামুনের হাতে দিয়ে  স্প্রীট তুলা দিয়ে থার্মেমিটার মুছে নিয়ে  জ্বর মাপলেন ,  বি পি চেক করে  প্রেসক্রিপসন দেখে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। অনেক কিছু নিয়ে ভাবনার মাঝে ডুবে আছে মামুন। অদিতি মামুনের ভাবালুতা লক্ষ্য করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে , মুগ্ধ দু’চোখের দৃষ্টির মাঝে হঠাৎ নিজেই হোচট খেয়ে স্বাভাবিক হতে চাইলে বুঝতে পারে  ততক্ষনে  মামুন তার হাতটা বুকে চেপে ধরে বিমুঢ় চেয়ে আছে তারই পানে ---   চোখের ভাষা বুঝতে  পেরেছে অদিতি, লজ্জায় লাল হয়ে  হাত ছাড়িয়ে নেন দ্রুত  --  এ কি করছেন ডা: মামুন?  দু’জনে পরস্পরের চোখে চোখ-- কি যেন বলিতে চাহে ভাষাহীন চোখে চোখে । বাতাসের কানে কানে দু’ চোখের কি ব্যাকুল  আকুলতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় দু’টি হৃদয়ের কথকথার মিহি সুর। অদিতি ছুটে বেরিয়ে যায় ৭নং কেবিনের বাইরে। মামুন এখন  একা উঠে দাঁড়াতে পারে বিছানা ছেড়ে। মামুন বিছানা ছেড়ে  খুব সাবধানে দাঁড়াতে  চেষ্টা করছেন, দরজার কাছেই দাঁড়ানো ছিল --  অদিতি কাছে এসে উঠতে সাহায্য করলেন পরম মমতায়। মামুন জানালার দিকে এগিয়ে যেতে চায় অদিতির কাঁধে হাত রাখে --   দু’জনে দু’জনার এত কাছাকাছি তবু বহু দূরে না বলা কত কথা বলা হয়ে উঠে না। অদিতির চোখ জল ছলছল ঠোঁট কাঁপছে , নিজেকে সংবরন করে নেয় অনেক কষ্টে। ভাবছে ডিউটি চেঞ্জ করবে নাকি? ক’দিন ছুটি নিয়ে দূরে দূরে থাকা উচিৎ। জানালার গ্রীল ধরে  দূরে  বহু দুরে যতদূর দৃষ্টি যায়  মামুন চেয়ে চেযে কি যেন খুঁেজ ফিরে --- মন যারে চায় সে কি তুমি? অদিতির ডাকে চমকে উঠে  মামুন । আসুন বেশীক্ষন দাঁিড়য়ে থাকা ঠিক নয় এবার বেডে চলুন  -- মামুন  না সিস্টার  আর কত শুয়ে থাকবো, শুয়ে থাকতে ভাল লাগে না । অদিতি : শুয়ে থাকতে না চাইলে  চেয়ার এগিয়ে দেই চেয়ারে কিছুক্ষন বসুন, গ্রীলটা শক্ত করে ধরুন আমি চেয়ারটা টেনে দেই। মামুন : সিস্টার আমাকে ঐ সোফার কাছে নিয়ে যান আমি সোফায় বসবো আর আপনি আমার পাশে বসে থাকবেন প্লিজ । অদিতির বুকের ভিতর যেন বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব বয়ে গেল শেষের কথাগুলোয়  --  ‘ আপনি আমার পাশে বসনে প্লিজ’ মনে মনে ভাবে অদিতি নিজেকে প্রশ্ন করে  আমি কি তবে চোরা বালিতে পা রেখেছি?  যা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছি না। না না তা হয়না , এ অন্যায়  ---  আমি তো সেবিকা , আমি নার্স, মানুষের সেবা আমার ধর্ম আমার দায়িত্ব , এ কোন অনুভ ূতি আমাকে আমার ভেতর থেকে আঁচড় কাঁটছে। আমি ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি, না আর নয়  মাথা ঠান্ডা করে আমাকে এথেকে  দূরে সরে যেতে হবে। বুকের কষ্ট চেপে স্বাভাবিক কন্ঠে  উত্তর দিল  ঠিক্ আছে চলুন আপনাকে সোফায় বসিয়ে দেই। সোফায় বসিয়ে দিলেন ডা:মামুনকে। ক্লান্ত মামুন সোফায় গা এলিয়ে বসে হাতের ইশারায়  অদিতিকে পাশে বসতে বলেন। অদিতি: হ্যাঁ বসছি---   আপনি চোখ বন্ধ করে  একটু জিরিয়ে নিন বলে একটু খানি কাছে বসলেন অদিতি। তারপর বললেন: আমাকে সপ্তাহ খানেক  ছুটি নিতে হবে । এ সময় যিনি দায়িত্বে থাকবেন তাকে আমি সব বুঝিয়ে দেব আপনার কোন অসুবিধা হবে না। আপনি নিজেও নিজের প্রতি একটু যত্নশীল হবেন দেখবেন খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। একা একাই লেকের পাড়ে ঘুরে আসতে পারবেন। তখন আর বোর লাগবে না। ডা: মামুন : না সিস্টার আপনি এখন ছুটিতে যাবেন না, আমি সুস্থ হলে তখন ছুটি নেবেন সিস্টার। আপনি না থাকলে আমার ভাল লাগে না  আমি ভাল হবো না। অদিতি: ভাল না হলে হসপিটালেই থেকে যাবেন ! আরে মশাই  তাড়াতাড়ি সেরে উঠলে  আপনি এই হসপিটালে চাকরীও পেতে পারেন, আপনিতো একজন ডাক্তার। ডা: মামুন কে বলেছে আমি ডাক্তার? আপনিই আমার নাম দিয়েছেন ডাক্তার।  অদিতি: আপনাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগে আপনার আই ডি কার্ড,মানিব্যাগ আমার কাছে রাখতে হয়েছিল তাই জেনে গেছি। অদিতি : ঘড়ির দিকে তাঁঁকিয়ে  প্লিজ আপনি এখন  বেডে চলুন অনেক ট্রেস নিয়েছেন আর নয়। তাছাড়া ডা: ডানকিন  রাউন্ডে আসার সময় হয়ে গেছে।

রাত গভীর এপাশ ওপাশ করছে অদিতি -- কি এক অস্বস্তিতে রাত ভোর হলো, ঘড়েিত এলার্ম বেজে উঠলো ভোর ছ’টা। হসপিটালে যাওয়ার জন্য তড়ি ঘড়ি প্রস্তুতি অদিতির। মা’ নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছেন, ডাকাডাকি শুরু করেছেন। অদিতি রেডি হয়ে  টেবিলে এসে মায়ের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে বললো  মা’ তাড়াতাড়ি দাও সময় নেই । অদিতি তাড়াতড়ি করে খেয়ে যাচ্ছে মায়ের চোখ এড়ায় না  অদিতির চোখের নীচে কালি পড়েছে মুখাবয়বে ঘমুহীন রাত্রি যাপনের ছাপ ভেসে উঠেছে। মা’: কি হয়েছে অদিতি  রাতে ঘুম হয়নি বুঝি? হসপিটালে কোন ঝামেলা ..?  ক’দিন ধরেই দেখছি তুই খুব অন্য মনস্ক খবু টেন্সট হয়ে এ  আছিস। অদিতি: না  মা’  ওসব তেমন কিছু না --- বাদ দাও তো --  আমার টিফিন সাজিয়েছ দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি। টিফিন বক্স নিয়ে দৌড় ঝাপ করে রাস্তায় নেমে পড়ে অদিতি। মনের সাথে যুদ্ধ করেও গতকাল ছুটির দরখাস্ত সাবমিট করতে ব্যর্থ হয়েছে, রয়ে গেছে তার হ্যান্ড পার্সে।

 

মিনা মাশরাফী
কবি ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top