সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

কাঠপেন্সিল : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
১ জুন ২০২০ ২৩:৫৮

আপডেট:
২ জুন ২০২০ ০০:০৪

 

রিক্সাটা এসে পায়ের কাছে থামলো। কিছু বলা আগেই রুবিনা রাতুলের হাতটা ধরে সোজা হাঁটা দিল মল চত্ত্বরের দিকে। জোর করার অবকাশ পেলো না রাতুল, করলও না। হাকিম চত্ত্বরে গিয়ে দাঁড়ালো রুবিনা । রাতুল হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে নিরাপদ করার আগেই রুবিনার জেরা শুরু- এতক্ষণ কোথায় ছিল, কী করছিল, কেনো ফোন ধরেনি? হাজারটা জানতে চাওয়া। কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিবে ভাববার সময় নেওয়াও মুশকিল। তার চেয়ে চুপ করে থাকাটা উচিত মনে করে রাতুল চুপ করেই রইল। তার চোখ রুবিনার চোখের দিকে। রুবিনা রাগে ঘরঘর করে, শেষে আশা ছেড়ে দিয়ে উচ্চস্বর করে বলল, ‘চেয়ে আছিস কেন্, চেয়ে আছিস কেনো এমন করে? জানিস না, তুই এভাবে চেয়ে থাকলে আমি তোকে কিছু বলতে পারি না! আমার রাগ পড়ে যায়! আর রাগ পড়ে গেলে ঝগড়া করা যায়! বল, ঝগড়া করা যায়? মাথা নাড়িয়ে রাতুল ‘না’ সূচক সম্মতি দিল। ‘‘আয় আমার সাথে আয়।’বলে রুবিনা আবার দাপিয়ে হাঁটা হাঁটা শুরু করল। ‘‘কোথায়?’’ রাতুল বলল। ‘বললাম না আয়।’ বলল রুবিনা।

যেখানে এসে থাকলো, জায়গাটা পাবলিক লাইব্রেরি। দুজনে কেন্টিনের ভেতর বসলো। চারটা কিমাপুরি, দুইটা আলুর চপ, দুইটা ভেজিটেবল রুলের অর্ডার করল রুবিনা। রাতুল তার পাশে। নীরব। মাঝে মাঝে রুবিনার চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করে সে। বড় বড় লাল চোখ দেখে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে। অনেক দিনের চেনা মেসিয়ার তমিজ পুরি, চপ নিয়ে এলে কোনো কথা না বলে রাতুল খেতে শুরু করল। রুবিনাও। বেলা চারটা গড়ালে বাসার ফোন পেয়ে রুবিনার মনে হলো, তাকে উঠতে হবে। রাতুল রুবিনাকে শাহবাগ থেকে এটিসিএল বাসে চড়িয়ে দিল। রুবিনা বাসে চড়লো এই নির্দেশনা দিয়ে যে, আটটার মধ্যে বাসায় ফিরতে হবে, রাতে নয়টার মধ্যে ফোন দিতে হবে, না দিলে খবর আছে। রাতুল টিউশনি সেরে ঠিক ঠিক বাসায় ফিরে হাতের কাজ শেষ করে ফোন করল রুবিনাকে। লাইনটা কেটে দিয়ে রুবিনা ব্যাক করে। খুশির ঢেকুর গিলে ধন্যবাদ জানায়। রাতুল কারণ না খুঁজে স্বাগত বলে তার ঝারি থেকে বাঁচে। সন্ধ্যায় কী খেল, বাসায় ফিরল রিক্সায় না বাসে, গানের ক্লাসের কত দিন বাকি, রাতের খাবার সেরেছে কিনা...এভাবে কথা চলতে থাকল বহু দূর। কার্তিকের পোয়াতি চাঁদ রাতের অন্ধকার ম্লান করে কোদালি আকাশটায় ঘুরে বেরাচ্ছে মহাজাগতিক নিয়মে। পশ্চিমের জানালা ধরে তার কিছু ছাট পড়ছে বিছানায়। রাতুল ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছে। সে সাত রাজার গল্প বলে, তের নদীর কিচ্ছা বলে, মীরাক্কেলের মীর আর 'হা-শো'র নানান কথা বলে- রুবিনা ফোনের ওপাশ থেকে খিলখিল করে হাসে। আহ্ কী হাসি। রাতুলও এপাশ থেকে হাসে, হাসির মতো শব্দ করে। থেমে গেলে রুবিনা ক্ষেপে যায়, ‘‘কীরে ঘুমিয়ে যাচ্ছিস? আমার আগে তুই ঘুমালে তোর কান ছিড়ে ফেলব। এক মাস আমার সাথে কথা বলতে পারবি না। তোর সব দাঁত আমি নিজ হাতে তুলে নেব।’ইত্যাদি। রাতুল হু-হা করে। ওপাশ থেকে কোন শব্দ না আসলে বুঝে, তার চোখে  ঘুম নেমেছে। এটা প্রতিরাতের গল্প।

রুবিনা ঘুমিয়ে গেলে রাতুল ঘুমিয়ে পড়ে,  না হয় রাতটা কেটে যায় সুনীলের নীরার সঙ্গে, সৈয়দ হকের নূরলদিন, আকবর হোসেন অথবা কবির সুমনের প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই- কবিতা আর গানের সাথে। সকালে সাড়ে ন’টা বেজে গেলে রাতুলের ঘুম ভাঙ্গে ফোনের রিং-টোনে। রুবিনার ফোন, ‘‘কিরে আর কত ঘুমাবি, রাতে ঘুমাস না? এ জন্যই তো আমাদের পাড়ায় চোরের এত উৎপাত! তা হলে তুই'ই এসব করিস!’’ রাতুল হাসে। রুবিনা হাসে। ‘উঠ্, তাড়াতাড়ি উঠ্। সোয়া দশটায় রোবায়েত স্যারের ক্লাস, ধরতে পারবি? বলে তার গলা কড়া করে। ‘পারব, উঠছি।’’ রাতুল বলে। ‘‘উঠছি বলে কোনো কথা নেই, আমি লাইনে আছি, উঠ্, ফ্রেশরুমে যা, তারপর রাখছি। উঠ্. . .।’’ রুবিনা ফোন কাটে না। রাতুল ফ্রেশরুমে ঢুকে ঝরনা ছাড়লে জলপড়ার শব্দে লাইন কাটে রুবিনা।

দুপুর পৌনে এক’টায় আসিফ স্যারের ল্যাকচার শেষ হয়। বন্ধু প্রবীরের সাথে বের হয়ে শাহবাগ থানার কোণাায় রকির দোকানে এক কাপ চা নেয় রাতুল। পেছন থেকে কানে আসে, ‘‘এই রাতুল. . . আমি এই দিকে।’’  বুঝতে বাকি থাকে না এটা রুবিনার স্বর। ‘‘এখানে আয়।’’ রুবিনা আবার ডাকে। এড়ানোর উপায় নেই। অর্ধেক চা শেষ না করেই পা বাড়ায়। রুবিনার হাতে এক ঝুড়ি ছোট ছোট বক্স। মুখটা লাল। হাতের রগগুলো টানটান। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে, সে  ছাপ স্পষ্ট। প্রবীর বিদায় নিল। তারা লিচু তলায় এসে বসল। একে একে সবকয়টা বক্স খুলে মুখের সামনে ধরে রুবিনা, ‘‘নে ঝটপট করে খেয়ে নে। ঘুম থেকে উঠে কিচ্ছু খাসনি জানি। খাবি কেনো,  ঠিকমতো খেলে যদি শরীরটা ভালো থাকে, তা করবি কেনো। ভন্ ভন্ করে সারাদিন ঘুরবি আর বিস্কুট, সিঙ্গাড়া খেয়ে দিন সাবার করবি। নে, খেয়ে নে।’’ হরহর করে তার পেটের কথা পড়তেই থাকে, পড়তেই থাকে। রাতুল স্থির চেয়ে থাকে রুবিনার মুখের দিকে। কথা বলার দিকে। রুবিনা ফের বলে, ‘‘নে, হা কর।’’ রাতুল কথা মতো হাঁ করে। সে জানে কোন বাধাতেও রক্ষা হবে না। তাই বাধাও দেয় না। একটানে লুচি, হালুয়া, মিষ্টি, ডিম-বন, ভূনা-গোস্ত, পুডিং সব মুখে পুরতে থাকে নি:শব্দে। এই মুহূর্তে 'না' বলা মানেই হলো বিকট চোখ, কটমট দাঁত, সব ছুঁড়ে ফেলা, অবশেষে হাউমাউ কান্না। তারপর বাড়ির কথা বলে কোনো  চিপায় ঘাপটি মেরে থাকা। শত ফোনেও রিসিভ না করা। ফোন বন্ধ। সাতদিন পর রাগ নামলে গলা চেপে ধরে, ‘‘সব দোষ তোর। তোর জন্যই তো এমন। তোর জন্যই তো সব খাপছাড়া। তোর জন্যই তো...।’‘ যেন রাতুলই নষ্টের মূল। এরপরও বকে-বেঁেক একসারা করা। চোখের জলে থৈথৈ হওয়া। সারি-সারি অভিযোগ, ‘‘তুই রাগ করস কেনো, 'না' করস কেনো, আমারে রাগাস কেনো!’’ আরও কত কি। কে নেয় এত ঝামেলা। পেট ভরে গলা পর্যন্ত পূর্ণ হলেও বারবার ঈশ্বরের নাম নিতে নিতে মুখটা হাসি হাসি করে রাতুল গিলতে থাকে। খাওয়ার পরে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে নিজের হাতটা মুছে রাতুলের হাতটাও মুছে দেয় রুবিনা। পাশ থেকে লিচু তলার চেনা পাগলা সদরুল খিলখিল করে হাসে আর বলে, ‘‘মায়া গো মায়া।’’ রাতুল খানিকটা লজ্জায় পরে। সদরুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায়। যেনো কিছু শোনেনি।

রাতুলের বুকটা চিন্ করে ওঠে, ধরে আসে ভিতরটা। নিজেই যেনো নিজের মুখটা দেখে, ফ্যাকাশে। প্রকাশ করে না সে। রুবিনার সাথে ছবির হাট, সোপার্জিত স্বাধীনতা, ভাষ্কর্য-চত্ত্বর, লাভরোড, পলাশী, শহীদ মিনার, কনার চায়ের দোকান, স্বপন মামার মরিচ চা করে করে সারাটা দিন টইটই । রুবিনার সেই-না কত কথা। স্কুলের রবিন স্যারের প্রেম সম্বোধন, হাসিনা ম্যাডামের শাস্তি, পরীক্ষার সময় অঙ্ক খাতা বদল করে ধরা পড়ে সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে না পারা, কলেজে অনিলের পাগলামী আর ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে চার সপ্তাহ হসপিটালে ভর্তি, একই টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য কী কৌশল- যেন স্মৃতির ব্রিপকেস খুলে বসা। রাতুল হাঁটে আর শোনে। দুই একটা জবাব দেই তো, কোনটার দেই’ই না। রুবিনা মেজাজ দেখালেও সে জানে। বেশির ভাগ সময়ই এ মেজাজ থাকে না। তারপরও চটে গেলে সেই হয়ে যায়। রাতুল মেনে নেয় সবকিছুই। কেনো মেনে নেয় তার সঠিক ব্যাখ্যা তার কাছে নেই।

রুবিনা ইদানিং আগের কথা, পরের কথা, হঠাৎ হঠাৎ আজগবি কথা, জীবনের কথা, ঐহ্যিক-পারত্রিক কথা খুব বেশি বলে। কারণে অকারণে মন ভার করে, বায়না ধরে, অভিমান করে কথায় কথায়। নিজেকে নিয়ে সাত সমুদ্র তের নদী-পাড়ের হাবিজাবি বলে যখন তখন। রাতুল কিছু বলে না। পাছে ভিতরে স্বচ্ছ আকাশটা মেঘলা করে আসে। কখনো সে বসে থাকে স্থির হয়ে, কখনো উঠে গিয়ে চোখ মুছে আসে, না হয় কথার বাঁক ঘুরিয়ে অন্য কথা বলে। গোপাল ভারের ভাঁড়ামি, মিস্টার বিনের কোনো অ্যাপিসোর্ড বলে চেষ্টা করে রুবিনার মন হালকা করার। হালকা যে হয় না তা না। কিন্তু রাতুল তার নিজেকে নিজের কাছে প্রতারক মনে করে। মিথ্যুক মনে করে। অপরাধ বিবেকের মধ্যে টোকা দিয়ে দিয়ে তাকে আহত করে বারবার, ‘‘একজন মানুষকে মিথ্যা বলে বলে আমরা ভুলিয়ে রাখছি। সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি। জানার অধিকার থেকে নীরবে বঞ্চিত করছি। বলতে চেয়েও আমরা বলতে পারছি না!’’  রাতুল ভাবে। ভাবে, ‘‘একি ভালোবাসা, না নিজেকে বাঁচানোর জন্য সত্য থেকে হাসি হাসি মুখ করে পালিয়ে বেড়ানো? বাস্তবতার যে রূঢ় রূপ আছে সে রূপ আমরা দেখতে চাই না বলেই কি আমরা লুকিয়ে ফেলি পরম বাস্তবতাকে? সত্য যে কঠিন...কঠিনেরে তবে কি আমরা ভালোবাসতে ভয় পাই? কোনটা ঠিক তা ঠাওর করতে কষ্ট হয়। তবু চর্কার মতো ঘুরি আমরা। দক্ষ অভিনয় শিল্পীর ন্যায় অভিনয় করে চলি। চলতে হয়। এমন মুখোচ্ছবি দেখলে কেউ পারবে না সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধ, ঠিক-বেঠিক, ন্যায়-অন্যায় নির্দিষ্ট করতে। পারবে না মুখোমুখি হয়ে তাকে বলতে। যা বলা দরকার। যা জানানো দরকার। বিবেক, যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন হবে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এলোমেলো হবে চোখ, ভাবনা। সিদ্ধান্ত নিতে বেগ পেতে হবে, কী বলা উচিত, কী করা উচিত। দেব কন্যার মতো তার মুখোশ্রী। বাঁশিসম নাক। কালো কাজলের কোনো লেশ নেই তবু কাজলটানা চোখ। ময়ূর ছানার মতো দেখতে। খারা কান- খরগোশ যেমন হয়।

পেঁয়াজ পর্দার মতো ঠোঁট, জোড়ালাগা ভ্রƒ । ডান গালের বাম কোণের তিল অপ্সরীর রূপের মতো আঁকা। শিশিরে ধোয়া নারী হয়ে জাগা ছিপছিপে নদীর মতো টলমল বহতা। টুনটুনি পাখির মতো চঞ্চল; শুভ্র বেলি ফুলের মতো পবিত্র মন; এমন সুন্দর মানুষটি পৃথিবীতে আর মাত্র কয়েকটা মাস উপস্থিত, সে কি কল্পনা করা যায়! কল্পনা করা যায় কি- কোনো ভাবেই তাকে আর ধরে রাখা যাবে না এই বিপুলা পৃথিবীর আলো বাতাসে, মায়া মমতায়, সম্পর্কে! আর সে কারো উপর রাগ করবে না, অভিমান করবে না, যখন তখন দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে না, যা ইচ্ছে তাই বলে নিজেই আবার হু-হু করে কাঁদবে না! বায়না ধরে শহর চষে বেড়াবে না। অলিগতিতে, রোদে, বৃষ্টিতে মাতবে না!’’ এসব অনেক অনেক কথা রুবিনার চোখের অগোচরে গাঢ় ধোঁয়ার মতো ঘোরে রাতুলের অস্তিত্ব অভ্যন্তরে। সে ধোঁয়ার আচ্ছন্নতা দেখা যায় না।

রুবিনা-রাতুল শহীদ মিনার আঙিনায়। আষাঢ়ের আকাশ ভেঙ্গে ঝুপ করে বৃষ্টি নামে। রাতুল উঠতে গেলে রুবিনা তার হাতটা মুঠ করে ধরে। রাতুল স্থির হয়ে যায়। রুবিনার চোখ রাতুলে চোখের দিকে। অনড়। এ চোখ অন্য অনেক দিনের চেয়ে ভিন্ন চোখ। রাতুলও ফেরায় না চোখ। ‘‘চল আমরা আজকে বৃষ্টিতে ভিজি। পুরোটা বৃষ্টিতে তুই আর আমি থাকি. . .ভিজবি?’ রুবিনা বলে। ভেতরটা মোচড়ে ওঠে রাতুলের। রাতুল ভেতরে কাঁপে। কেন? রাতুল জানে না হা। বলে, ‘‘না, এ সময়ের বৃষ্টি ভালো না, জ্বর ধরবে। তোর শরীর খারাপ করবে। চল। ‘‘কে বলেছে শরীর খারাপ করবে, করবে না। আর করলে তোরও করবে। না-হয় দুজনেই বাসায় পড়ে থাকবো দুদিন। আমি অত সহজে মরবো না। তোকেও মরতে দিবো না।’‘ বলে রাতুলের হাতটা শক্ত করে ধরে টান দেয় রুবিনা। তার মরার কথাটা রাতুলের বুকে তীরের মতো বিঁধে। নড়ে ওঠে সমস্তা। স্তব্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

এক দলা বৃষ্টি বইতে থাকে রাতুলের উপর, রুবিনার উপর। দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না। কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে আসে সব। কাছেও কাউকে দেখা যায় না। দূরেও কাউকে দেখা যায় না। রুবিনা রাতুলের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে। ধরেই রাখে। রাতুলের মনে হয়, একটা সামুদ্রিক ঝড় প্রবল ঢেউ দিয়ে ভাসিয়ে নিচ্ছে রুবিনাকে, তার থেকে বাঁচার জন্য সর্বশেষ বাঁচার আশায় হাতটা আক্রে আছে রুবিনা, এমন শক্তিতে। বৃষ্টি আরও বাড়ে, লিচু তলার পাগলা সদরুলের কথাটা ফিরে আসে রাতুলের ভাবনায়। মনে পড়ে, ‘‘মায়া গো মায়া।’’ বৃষ্টি আরও বাড়ে। আরও বাড়ে। রাতুলের শরীর তিরতির করে বরষের মতো ঠান্ডা হয়ে আসে। ভিতরে কাঁপন ধরে। অজানা ভয়ের কাঁপন। সে টের পায়, রুবিনাও কাঁপছে। রাতুল আর ফিরবার কথা বলে না। বলে না, ‘চল।’ বৃষ্টির ফোঁটায় আর অনন্তের কান্নায় একাকার হয় অঙ্গন। সমস্ত দিয়ে রাতুল চেপে রাখে সে কান্না। সে কান্না চাপা থাকে না আকাশ সীমায়।

শেষবার কোলকাতা থেকে ফেরার সময় ডা. অনিল পোদ্দার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘আমরা অনেক চেষ্টা করলাম, সুফল তেমন পাইনি। গোড়াতেই গলদ হয়ে আছে। এমন সময়ে আপনারা এসেছেন যখন জীবাণু তার ফুসফুসের একপাশের বেশির ভাগ কোষ দখল করে নিয়েছে। এই অসুখ মৃত্যুর আরেক নাম হয়েই মানুষের শরীরে বাসা বাঁধে। বুঝতে দেরি করলে উপায় থাকে না! তাই হয়েছে! অলৌকিক ভাবে মেয়েটির যতটুকু দুর্বল হবার কথা ছিল অতটা সে নয়। তাই বলে নিশ্চিন্ত থাকবার কিছু নেই। সময় খুব কম! হঠাৎ করে থেমে যাবে। তাকে তার ইচ্ছে মতো বাঁচতে দিন।’’ ডা. অনিল পোদ্দার যেমন পারেনি সেদিন কথাগুলো রুবিনাকে বলতে, রুবিনার বাবা যেমন পারছে না, রাতুলও পারে না রুবিনাকে বলতে, তুমি আছো- আর কয়েকটা দিন। রাতুলের চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। জোড় দিয়ে বৃষ্টিটা বাড়ে। বৃষ্টিতে আলাদা করা যায় না কোনটা চোখের জল, কোনটা বৃষ্টির।

 

জোবায়ের মিলন
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top