সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

করোনা দিনের গল্প- জানাজা : জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২০ ২১:৪৯

আপডেট:
১৭ জুন ২০২০ ২১:৫১

 

করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন জব্বার আলী। খবর পেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন এসে নমুনা নিয়ে গেছে পরীক্ষার জন্য। করোনা বিধি (প্রটোকল) মেনে তার জানাজার নামায হবে। বেশী লোক অংশ নিতে পারবে না জানাজায়। এর মধ্যেই উপজেলা নির্বাহী অফিসার এসে গেছেন। সাথে পুলিশ আর দুজন স্বেচ্ছাসেবক। সকলেই পিপিই পরিহিত। সবাইকেই দেখতে কিছুটা অদ্ভুত লাগছে। লাশ পড়ে আছে ঘরে নিতান্ত অবহেলায়। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই পরিবারের কেউ লাশের পাশে নেই।

শেষবারের মতো জব্বার আলীর লাশ দেখার জন্য গ্রামের লোকজনের কোন ভীড় নেই জব্বার আলীর বাড়ীতে। সকলের মনেই এক অজানা আতংক। আশপাশের দশ গ্রামেও আজ পর্যন্ত কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায় নি। লোকজন বলাবলি করছে এতোদিনে যমে বাড়ী চিনেছে!

জব্বার আলীর তেমন বয়সও হয় নি। সারা ইউনিয়নে এক নামে পরিচিত। পরোপকারী দানশীল এবং বন্ধুবৎসল জব্বার আলী পিতার মৃত্যুর পর নিজের চেষ্টায় ব্যবসা বানিজ্য করে কয়েক বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হন। সৎ ব্যবসায়ী হিসাবে সবাই তাকে চেনে। গতবার স্ত্রীকে সাথে  নিয়ে হজ্ব করে এসেছেন। হজ্ব থেকে আসার পর প্রথম প্রথম কয়েকদিন জব্বার আলীর বাড়ীতে অসংখ্য মানুষের আনাগোনা হয়। পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে সাথে আনা খেজুর,মি ষ্টি তেতুল জমজমের পানি নিজের হাতে সবাইকে দিয়েছেন জব্বার আলী। জমজমের পানির প্রতিই সবার বাড়তি আকর্ষণ।

জমজমের পানি পান করলে শরীর থেকে রোগ ব্যাধী দূর হয়ে যায় এমন একটা বিশ্বাস প্রচলিত আছে মানুষের মাঝে। ঘনিষ্ট মানুষজনদের ঘরের ভিতর ডেকে নিয়ে জায়নামাজ এবং তসবীহও দিয়েছেন জব্বার আলী। আজ সেই জব্বার আলী আর নেই!

 

কয়েকদিন ধরেই শরীরটা কেমন জানি লাগছিল। শরীরে আর কোনো অসুখবিসুখও বাসা বাঁধে নি। খুব বেশী জ্বর আর কাশির সাথে শরীর ব্যাথা। প্রথম দুএকদিন জব্বার নিজে এবং পরিবারের লোকজন তেমন একটা পাত্তা দেয় নি। আস্তে আস্তে অবস্থা খারাপ হতে থাকে। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক  সুধাময় ডাক্তারের পরামর্শে কিছু ওষুধ এনে জব্বারকে খাওয়ানো হয়েছে।ভক্তি সহকারে জমজমের পানিও খেয়েছেন ঘনঘন।

জব্বার আলীর বড় ছেলে সাব্বির আলী কলেজে পড়ে। গত তিন মাস ধরে কলেজ বন্ধ থাকায় সাব্বির বাড়ীতেই আছে। লেখাপড়া জানা সচেতন ছেলে স্বাস্থ্য বিভাগের জরুরী হটলাইন নাম্বারে ফোন করে। অনেকবার চেষ্টা করে লাইন পায়। সারাদেশ থেকে হটলাইন নাম্বারে ফোনের চাপ। সারাদেশকেই সরকার করোনা ঝুঁকিপূর্ন ঘোষণা করেছে। দেশের প্রায় সবখানেই কম বেশী করোনার রোগী রয়েছে। নমুনা পরীক্ষায় প্রায় প্রতিদিনই অনেক মানুষের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সংখ্যাটা ৫০ হাজার অতিক্রম করেছে। ৫শ এর বেশী মানুষ এর মধ্যে করোনায় মারা গেছে। করোনা থেকে দেশের মানুষকে রক্ষায় সরকার নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে। মানুষকে সচেতন করতে নানা প্রচার প্রচারনা চালাচ্ছে।লক ডাউন দিয়েছে। গণ পরিবহন বন্ধ করা হয়েছে। মানুষ খুব একটা সচেতন হচ্ছে না। নিয়মনীতি মানতে চাইছে না।নির্দিষ্ট ধরনের কিছু দোকানপাট ছাড়া হাটবাজার  মার্কেট সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সরকারীভাবে। কলকারখানাও বন্ধ। এমনকি মসজিদে মুসুল্লীদের উপস্থিতিও সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এতোকিছুর পরেও মানুষ কেমন জানি উদাসীন।

বিশ্বকাঁপানো করোনার মধ্যেও মানুষ পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাচ্ছে। ট্রাকে করেও চলাচল করছে।ঢাকার পর সর্বাধিক করোনাপ্রবন এলাকা নারায়নগঞ্জ থেকে মানুষ ট্রলারে করে, ট্রাকে করে নিজ নিজ এলাকায় ফিরছে। মাঝে মাঝে ধরাও পড়ছে। মারাত্মক ছোঁয়াছে এ মরণব্যাধির আতংকে সবাই এক অস্থির সময় পার করছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ সব নিয়মকানুন ঠিকঠাকমতো মানছে না। জব্বার আলীও প্রতি রাতে টেলিভিশনে সারাদেশের করোনা পরিস্থিতির খবর শুনেন। মনে মনে উদ্বিগ্ন হন। আবার মনে মনে ভাবেন হায়াত মউত সব আল্লাহর হাতে। মানুষের মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত। যার যখন যাওয়ার সময় হবে কেউ আটকাতে পারবে না। কিছুদিন আগে রফিনগর গ্রামের জব্বার আলীর ভায়রা আকবর আলী নারায়নগঞ্জ থেকে বাড়ী ফিরেন।জব্বার আলী অনেকদিন ধরে আকবর আলীকে দেখেন না। দুই ভায়রায় চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক। প্রায় প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা মোবাইলে কথা বলেন। আকবর আলী বাড়ী এসেই জব্বার আলীকে দাওয়াত দেন তার বাড়ীতে। দুইদিন পর জব্বার আলী রফিনগরের আকবর আলীর বাড়ীতে বেড়াতে যান। মাঝে একদিন থেকে বাড়ী ফিরেন। রাতে ঘুমানোর সময়টা বাদে সারাক্ষণ হরিহর আত্মার মতো দুই ভায়রা গলায় গলায় থাকেন।নারায়নগঞ্জ থেকে আসলেও আকবর আলীর মধ্যে করোনার কোনো লক্ষনই দেখা যায় নি। বাড়ী ফেরার পরের দিনই জব্বার আলীর শরীরে জ্বর আসে। জ্বর বাড়তে থাকে। সাথে কাশি। গলায় ব্যাথা। লক্ষন শুনে সুধাময় ডাক্তার যে ওষুধগুলো জব্বার আলীকে খেতে দেন সাব্বির হটলাইনে ফোন করে কথা বলার পর সেখানকার লোকজনও লক্ষন এবং বর্ণনা শুনে একই ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। সুধাময় ডাক্তারের প্রতি সাব্বিরের ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যায়।কিন্তু ওষুধে কাজ হয় না। আজ সকালে প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হয় জব্বার আলীর। তার বুকটা কামারের হাপড়ের মতো উঠানামা করতে থাকে। সাব্বির দ্রুত ফোন করে উপজেলা সদরের 'মাটির মায়া' অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে। অ্যাম্বুলেন্স আসে। ধরাধরি করে জব্বার আলীকে অ্যম্বুলেন্সে তোলা হয়। সাথে জব্বারের স্ত্রী সোহানা বড় ছেলে সাব্বির আর জব্বারের এক চাচাত ভাই। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলে। কিছুদূর না যেতেই জব্বারের স্ত্রী পুত্র আকাশফাঁটা কান্না জুড়ে দেয়। জব্বারের চাচাত ভাই ড্রাইভারকে অ্যাম্বুলেন্স থামাতে বলে। জব্বার একেবারেই নিথর নিস্পন্দ। বুকের উঠানামা আগেই থেমে গেছে। সাব্বির বুঝতে পারে প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে মৃত্যু হয়েছে তার পিতা জব্বারের।

মৃতদেহ নিয়ে বাড়ী ফিরে আসে তারা। এর মধ্যেই গ্রামের মেম্বার ফোন করে ইউএনওকে ঘটনা জানিয়ে দেয়। প্রশাসনের লোকজন এসে প্রটোকল মেনে জব্বারের দাফন কাফন সম্পন্ন করবে বলে ইউএনও সাহেব মেম্বারকে জানিয়ে দেন। তিনি আরোও জানান ছলিমপুরেও একজন আজ করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে। সেখানকার দাফন-কাফনের কাজ শেষ করে তারা জব্বার আলীকে দাফন করতে গনেশপুরে আসবেন। পরিস্থিতি এখন এমন যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা করোনার লক্ষন নিয়ে কেউ মারা গেলে তার লাশ দাফনের জন্যও কেউ এগিয়ে আসে না। পারলে বাঁধা দেয়।সেদিনও সাব্বির ফেসবুকে দেখেছে সুনামগঞ্জের এক গ্রামে করোনা লক্ষন নিয়ে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির মৃতদেহ বহন করার জন্য মসজিদের খাটিয়াটাও দিতে চায় নি গ্রামের মানুষ। পরে পুলিশ গিয়ে দাফনের কাজ সম্পন্ন করেছে। আরও অনেক জায়গাতেই করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের জানাজা ইউএনও ওসি সাহেবগন পড়িয়েছেন এমন খবর ও ছবিও সাব্বির সোস্যাল মিডিয়াতে দেখেছে। তার পিতার ভাগ্যেও একইরকম পরিণতি ঘটবে এমনটা সে ভুল করেও কখনো ভাবে নি। সবই ভাগ্য আর আল্লাহর ইচ্ছা।নিজেকেই নিজে শান্তনা দেয় সাব্বির। জব্বারের মৃত্যুতে বেশী আঘাত পেয়েছে সাব্বিরের একমাত্র ছোট বোন হালিমা। হালিমা জব্বার আলীর  খুব বেশী আদরের। কিছুদিন আগেই হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে।সিক্সে পড়ে। অনেকক্ষণ কেঁদেকেটে এখন একদম পাষাণ মূর্তির মতো নিস্পলক ও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। সাব্বির ভাবে বোধ হয় এ অবস্থাটাকেই বলা হয় অধিক শোকে কাতর।

করোনা রোগীর মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। এ কথা সে সোস্যাল মিডিয়াতেই জেনেছে। অনেক বড় বড় ডাক্তারেরাই লিখেছেন।তারপরও মন থেকে ভয় যায় না। পিতার মৃতদেহের পাশে যেতে সাহস পায় না। মোড়লবাড়ীর সগির মিয়া মৃতদেহের সিঁথানে কয়েকটি আগরবাতি জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল। কবেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আজ জব্বার আলীর মৃতদেহের পাশে বসে সামাজিক প্রথা অনুযায়ী দোয়া দুরুদ পড়ারও কেউ নেই! কিছুকিছু মৃত্যু বুঝি মানুষকে এভাবেই মর্ত্যের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়-সাব্বির ভাবে।অথচ বেঁচে থাকতে জব্বার আলী অনাথ এতিমের খেদমত করেছে।বিপদে আপদে সাহায্য করেছে। অনেক নিঃশ্ব লোকের দাফন কাফন নিজ উদ্যোগে করেছে। সব সাব্বিরের জানা!

স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো এই গ্রামেরই মসজিদের ঈমাম নায়েব মৌলভীর কথা। একবার মাঝরাতে এসে চিৎকার চেচামেচি করে গভীর ঘুম থেকে জব্বার আলীকে জাগিয়ে তুলে। এর আগে অনেকবার ফোন করেছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় জব্বার আলী ফোন ধরতে পারেন নি।

ঈমাম সাহেবকে এতো রাতে তার বাড়ীতে দেখে জব্বার আলী জিজ্ঞেস করেন কোনো সমস্যা? নিঃসন্কোচে বলুন আমাকে। ঈমাম সাহেবের সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর তীব্র প্রসব বেদনা এবং নরমাল ডেলিভারী না হওয়ার কথা জেনে ঘুম জড়ানো চোখেই ঘর থেকে ১০ হাজার টাকা দেন জব্বার আলী। কৃতজ্ঞতা বশতঃ এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঈমাম সাহেব আরো কতোবার জব্বার আলীর কাছ থেকে উদার সহযোগীতা আদায় করে নিয়েছেন। নাম উল্লেখ করে দোয়া করেছেন। আজ এখন পর্যন্ত সেই ঈমাম সাহেব জব্বার আলীর লাশটা দেখতেও আসলেন না!

আত্মীয় স্বজন কেউই আসলো না। ঈমাম সাহেবকে দোষ দিয়ে কি হবে।

আসরের নামায শেষ হয়েছে। হঠাৎ বাড়ীর পাশে গাড়ীর আওয়াজ শোনা গেলো। ইউএনও সাহেবের গাড়ী। সাথে আরেকটি গাড়ীতে দুইজন পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবক। গাড়ী থেকে নেমেই ইউএনও সাহেব জানিয়ে দিলেন বেশী সময় নেওয়া যাবে না। দ্রুততার সাথে লাশ দাফন সম্পন্ন করতে হবে। রাতে তাকে আবার জেলা সদরে যেতে হবে। জরুরী ভিত্তিতে ডিসি স্যার ডেকেছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা দ্রুতই কাজে লেগে গেলেন। লাশের গোসল দেওয়া হলো। বাড়ী থেকে খানিকটা দূরেই কবরস্থান। সাব্বিরকে বলা হলো মসজিদ থেকে লাশ বহনের খাটিয়াটা আনার জন্য। খাটিয়ার জন্য মসজিদে লোক পাঠানো হলো। খাটিয়া দিতে আপত্তি জানালেন ঈমাম সাহেব। মসজিদ কমিটির সভাপতি তাকে আগে থেকেই নিষেধ করে রেখেছেন এ কথা জানাতেও ভুল করলেন না। অথচ জব্বার আলীই সবাইকে বলে কয়ে আমজাদ মিয়াকে মসজিদ কমিটির সভাপতি বানিয়েছিলেন। সাব্বির আকাশ থেকে পড়লো। সব শুনে ইউএনও সাহেব নিজে গেলেন মসজিদে। উপস্থিত সবাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাটিয়াটা আনার ব্যবস্থা করলেন। লাশ তোলা হলো খাটিয়ায়। সরকারী লোকজন বাদে লাশের সাথে শুধু সাব্বির। সীমিত পরিসরের জানাজায় ইউএনও সাহেব ঈমামতি করলেন।তারপর যথাযথ ধর্মীয় রীতিতে লাশ দাফন করা হলো। ইউএনও সাহেব দলবল নিয়ে বিদায় হলেন।

যাওয়ার আগে জব্বার আলীর বাড়ী লক ডাউন করে গেলেন। জব্বার আলীর স্ত্রী কন্যা এবং সাব্বিরকে হোম আইসোলেশনে থাকার কঠোর নির্দেশ দিয়ে গেলেন যাওয়ার আগে।

রাতে কিছুতেই সাব্বিরের দুচোখ এক হচ্ছিল না।

কতো কথা কতো স্মৃতি তার মনে পড়তে লাগলো। বারবার পিতার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। অন্য সময় তার পিতার স্বাভাবিক মৃত্যু হলে এলাকায় শোক সংবাদ প্রচার হতো। হাজার হাজার মানুষ জানাজায় আসতো। সবাই তার পিতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতো। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ঈমাম সাহেব ইনিয়েবিনিয়ে কতোভাবে জব্বার আলীর গুনকীর্তন করতো। তিনি কেমন মানুষ ছিলেন? ঈমাম সাহেবের এই প্রশ্নে সবাই একবাক্যে বলে উঠতো খু্ব ভালো মানুষ ছিলেন। এই স্বাক্ষী একবার দুবার নয় তিন তিনবার নিতেন। কবরের পাড়ে বসেও কতো মায়াকান্না করতেন! আজ করোনার কারনে সবকিছুই বদলে গেলো। নিয়ম রীতিনীতি সবই বদলে দিয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস করোনা! ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শ্রান্ত সাব্বির কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো টেরও পেলো না। সে স্বপ্ন দেখতে লাগলো। তার খালু আকবর আলীরও করোনার লক্ষন দেখা দিয়েছে। অবস্থা খারাপ হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে তাকে তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া  হয়েছে। কোনো হাসপাতালেই ভর্তি করা যাচ্ছে না। মুগদায় নিয়ে গেলে কুর্মিটোলায় যেতে বলা হলো। ছুটাছুটি দৌঁড়াদৌঁড়ি করে করে অবশেষে ভোর রাতে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আনা হলো আকবর আলীকে। কাউন্টারে যোগাযোগ করার পর সব শুনে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে জানানো হলো। সাথের লোকজন একদিনের এমন ক্লান্তিতেই ভেঙ্গে পড়েছেন। তারা হতাশ। এদিকে আকবর আলীর অবস্থা খারাপ থেকে খারাপের দিকে যেতে শুরু করলো। সকাল ৮ টার দিকে দুজন ডাক্তার জরুরী বিভাগে আকবর আলীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। সাথে থাকা লোকজনের সাথে কথা বলে কেসহিস্ট্রি জানার চেষ্টা করলেন। কিছুদিন আগেও নারায়নগঞ্জের ভুকশিমুইল এলকায় ছিলেন এমন তথ্যে ডাক্তাররাও আঁতকে উঠলেন।সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আকবর আলী যে করোনায় আক্রান্ত এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলেন তারা।তবে তার অবস্থা খারাপ। এতোটাই খারাপ তাকে আইসিইউতে নিয়ে ভেন্টিলেশনে রাখা খুব দরকার।মুশকিল হচ্ছে করোনা রোগীর চাপে এখানে একটা আইসিইউ ও খালি নেই। আইসিইউতে থাকা কোনো রোগী যদি আজ মারা যায় তবেই একটা গতি হতে পারে আকবর আলীর! কিন্তু সেটা তো আগেভাগেই বলা সম্ভব হচ্ছে না।আকবর আলীর ভাগ্য ভাল হলে হয়তো এমনটা হতে পারে। কিন্তু আইসিইউতে নিলেই তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন,ভালো হয়ে যাবেন এটাও জোর দিয়ে বলা যায় না। অনেকেই তো নিজের বাড়ীতে থেকেই কোভিড জয় করেছেন। সবই ভাগ্য।আসলেই ভাগ্য বলে কিছু আছে কি! ভাবতে ভাবতে ডাঃ বাসেতের মনে হলো ভাগ্য বলে কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে। নইলে তিনি কেন বউ বাচ্চা বাসায় রেখে আজ নিয়ে সাতদিন একটানা ডিউটি করতে বাধ্য হচ্ছেন! রোগী বেশী।ডাক্তার কম। আরো অনেক রকমের সমস্যা ও সংকট আছে। সবকিছু বলার মতও নয়। বললেই বিপদ।

নিজেরা  আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে।তারপরও প্রাণপণ চেষ্টা রোগী বাঁচানোর।ডাক্তারদের একটু ত্রুটি কিংবা অবহেলা পেলে মিডিয়াও কোমর বেঁধে লাগে!যাক এখন এসব ভাববার সময় নয়।সামনে থাকা রোগী আকবর আলীকে কি করে বাঁচানো যায় সেই যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে এক্ষুণি।

 

মসজিদ থেকে ফজরের আজানের সুমিষ্ট সুর ভেসে আসছে। পাশে থাকা মোবাইলটা বারবার বাজছে। সাব্বিরের ঘুম ভাঙ্গে। ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন ও বিধ্বস্ত সাব্বির খানিকটা বিরক্ত হয়েই মোবাইলটা হাতে নেয়। কল লিস্ট দেখে। একই নম্বর থেকে অসংখ্যবার কল করা হয়েছে তাকে। আরে এটা যে তার খালাম্মার নাম্বার। অনেক আদরের খালামণি তার। কাল একবার ফোন করে খালাকে তার বাবার মৃত্যুর খবরটা দিয়েছিল সাব্বির। সারাদিন খালা আর ফোনটোন দেয় নি। সাত সকালে খালার ফোন কেন তবে?আবারও বেজে উঠলো ফোনটা। কিছুটা বিরক্তি কিছুটা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সাব্বির ফোনটা ধরলো। ও প্রান্থ থেকে সাব্বিরের খালার ননদের কন্ঠ শুনতে পেলো সাব্বির। খালার এই ননদটাকে সাব্বিরের খুব ভালো লাগে।কেমন মিষ্টি করে কথা বলে। মায়া জাগায়। দুষ্টুমির হাসিও হাসে। দুএকবার যখনই গেছে মোহাবিষ্ঠের মতোই সাব্বির খালার ওই ননদের সাথেই লেগে থেকেছে। এক বয়সী বলেই এমন টান।এমন সম্পর্ক। খালা সব বুঝেছে। কখনোই কিছুই বলে নি। ছিঃ সাব্বির এসব কি ভাবছে এই মুহুর্তে!

-হ্যালো সাব্বির?

-জ্বী সাব্বির বলছি।

-ভাইয়া আর নেই। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

অনেক চেষ্টা করেও কোন হাসপাতালে সিট পাওয়া যায় নি। অবশেষে অ্যম্বুলেন্সেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। একটু আগে আশিক ভাই জানিয়েছেন। ভাবী রাত থেকে অজ্ঞান।এখনও জ্ঞান ফিরেনি। তাকেও কোনো হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো যাচ্ছে না!

--হায় আল্লাহ! এ আমি কি স্বপ্ন দেখলাম রাতে।

এভাবে স্বপ্নটা ফলে গেলো।

বলেই হাউমাউ করে উঠলো। হাউমাউ করতে লাগলো সব্বিরের খালামণির ননদ জামিলাও।

ফোনটা কেটে গেলো।

কল্পনায় সাব্বিরের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আরেকটা সীমিত পরিসরের জানাজার দৃশ্য!

 

জালাল উদ্দিন লস্কর শাহীন
লেখক ও শিক্ষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top