সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

গল্প- আম্মা : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
১৭ জুন ২০২০ ২৩:৩৬

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৫

 

১.
তপু আগেই জানত এবার ফাস্টক্লাস তারই হবে। তাই রেজাল্টের দিন তেমন পেরেশান না হয়ে আস্তে-ধীরে বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ে জগলুর দোকানে এককাপ রং চা পান করে সে হাঁটা দিলো চাঙ্খার-পুলের দিকে। ভাঙ্গাপ্রেস থেকে চাঙ্খার-পুল কাছের পথ না। না হোক। কিছু যায়-আসে না। দুই চার কিলোমিটার পথ- গ্রীষ্ম কি বর্ষায় পাড়ি দেয়া কঠিন কিছু না। এটা তপুর মাঝে মধ্যের অভ্যাস অথবা ভালোলাগা। একবার কুমিল্লার শ্রীনারায়ণ কান্দি থেকে ভরদুপুরে হাঁটা দিয়ে ডেমরার রসুলবাগ পৌঁছেছিল তিন প্রহরে। এসে যদিও চিকনগুনিয়া জ্বরের মতো গিঁটে গিঁটে ব্যাথা আর শর্দি নিয়ে চার দিন বিছানায় পড়ে ছিল, তাতে তার ভোগান্তি মনে হয়নি বরং ন্যাচারাল বলে এ অভ্যাস বজায় রেখেছে। আছে। যখন যেদিন ইচ্ছা হয় সেদিনই তপু এ কাজটা করতে আনন্দ পায়। আজ ভাদ্রের মধ্য তারিখ। পাকা রোদ ফোঁসকা ফেলে দিচ্ছে মনুষ্য চামড়ায়। উপর থেকে যেমন গরম পড়ছে তেমনি নিচ থেকে উঠে আসা তাপ সহ্য করা যায়না। তাতে দ্বিধা নেই। তপু তপুর মতো কখনো ফুটপাতে, কখনো রাস্তার পাশ ধরে হাঁটা শুরু করেছে। রিক্সার টুংটাং, টেম্পুর ঘটঘট, বাসের হর্ণ মানুষের ধাক্কা বিরক্ত করে না তাকে...দেড় ঘন্টায় তপু পৌঁছাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

২.
এখন সন্ধ্যা। ঠিক এক বছর আগে হলে যে বাড়িটিতে আজকের দিনে হৈহুল্লরের কমতি হতো না সে বাড়িটিতে শুনশান নীরবতা। অন্য পাঁচ সাত দিনের মতো আলো জ্বলছে, ফ্যান ঘুরছে, টিভি চলছে। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম নেই। শুধু দক্ষিণের যে কক্ষটিতে একটি মুখে মৃদু চিন্তাগ্রস্থ রেখা, চোখে জিজ্ঞাসা, মনে উদ্বেগ তাঁর পা ছুঁয়ে তপু জানাল, ‘আম্মা আমি ফাস্টক্লাস পাইছি। বলছিলাম না, আমিই পামু. . .সাথে ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড ভাঙছি।’’ তপুর মা আছিয়া বেগমের গাল গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি গলা স্পর্শ করলে তপু আর তথাস্থানে বসে থাকতে না পেরে তার কক্ষে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ একা একা কাঁদল। কতক্ষণ- তা বলা যাচ্ছে না। আছিয়া বেগম বিছানা থেকে উঠত পারলে, কথা বলতে পারলে, স্বাভাবিক থাকলে এতক্ষণ দড়জা বন্ধা রাখা সম্ভব হতো কি-না তা তপুর জানা নেই। আছিয়া বেগম তাঁর বিছানায়ই বসে রইলেন। চুপচাপ। আছিয়া বেগমের স্বামী, তপুর পিতা রহিম বেগ গত হলেন তিনবছর, তার পর থেকে আছিয়া বেগম শয্যাগত। ব্রেনস্ট্রোক করে বাকশক্তি হারিয়ে প্রায় অবস শরীরটা নিয়ে বেঁচে থাকা মাত্র। অথচ একদিন তিনি ‘ডিস্ট্রিক জজ’ পদে থেকে যেমন পুরো জেলা সামলিয়েছেন কঠিন হাতে তেমনি আধুনিক শতাব্দির নাগরিক জীবনে পাঁচ-পাঁচজন ছেলে মেয়ে উচ্চশিক্ষিত করেছেন নিজের মেধা, দক্ষতা আর কঠিন পরিশ্রমে। এখন তারা কেউ নানা প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা আবার কেউ নিজেরাই প্রতিষ্ঠানের মালিক। তাদের প্রত্যেকেরই এই শহরের অভিজাত এলাকায় বসবাস। আছিয়া বেগম তার স্বামীর গড়া এই বাড়িটা ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি বলে- কেউ তাঁর সাথেও থাকতে পারগতা স্বীকার করেননি স্ত্রী আর সন্তানদের সমুহ ভবিষ্যৎ ভেবে! অথচ আছিয়া বেগমের পাঁচ ছেলে মেয়ে এখানেই বড় হয়েছে। এ কথা আছিয়া বেগম বলেন। পাশের ঘর থেকে আসা অনুচ্চারিত শব্দ শুনে তপু নিজের চোখ মুছে মায়ের কাছে গিয়ে দেখলো, মা আছিয়া বেগমও জোরে জোরে কাঁদছেন। তারা দুজনে একসঙ্গে আবার অনেকক্ষণ কাঁদল।

৩.
রাতের দ্বি-প্রহরে তপুর ভাই বোনদের সেল নম্বর তপুর ছোট্ট ফোনটিতে ভেসে উঠতে লাগলো। তারা সবাই তপুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দিত করলো স্বরভরে কিন্তু কেউ তার সাথে দেখা করতে এলো না। পরের দিন সকালে তপু যখন আবার ক্যাম্পাসে উপস্থিত হলো, রিতা তপুকে তিন’শ তিনটা গোলাপ উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো এবং একটি প্রস্তাব দিয়ে তার কথা শুরু করলো। গোলাপ তপুর প্রিয় ফুল আর রিতা প্রিয় মানুষ হলেও প্রস্তাব মতে রিতার বাবার সাথে দেখা করা ও তাদের ‘‘চট্টগ্রাম ইস্পাত অ্যান্ড স্টিল মিলস্’’ এ জয়েন করার কথাটা প্রিয় লাগলো না। তপু জানিয়ে দিল, ‘‘আম্মাকে ফেলে অতদূর দিয়ে চাকরি করা অসম্ভব।’’ প্রেমিকার কোমল স্বরের প্রস্তাব প্রেমিক ফিরিয়ে দিলে প্রেমিকার মনের অবস্থা কী হয়, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রিতা সেই দিনের মতো তপুর সাথে আর তেমন কথা না বললেও পরের একবছর অনবরত বুঝাবার চেষ্টা করলো, ‘‘এ না হোক অন্য কিছু, বেটার দ্যান প্রাইভেট টিউশন?’’ মেঝ বোনের শ্বশুর তপুকে ¯েœহচোখে দেখেন অনেক আগ থেকেই। কন্যায় ভাবনাপ্রস্থ পিতা বলে কি-না বলা যাচ্ছে না। তিনি জার্মান থেকে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে ওখানেই আরও পড়াশোনার সুযোগ ও চাইলে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ জানিয়ে যে ফোনালাম করলেন তা তপু সরাসরি প্রত্যাক্ষাণ না করে ‘দেখি’ বলে কথা রাখল। তালুই মশায়ের সাথে এ নিয়ে আর কখনোই কথা হয়নি। তুপু সে সুযোগ তৈরি করেনি। বায়োক্যামেস্ট্রি বিভাগের প্রধান রণোজিৎ স্যার তাঁর সেল ফোন থেকে তপুকে কল করলেন কয়েকবার। যথাসময়ে দেখতে পায়নি। শেষবার কলটি রিসিভ করলে ফোনের ওপার থেকে জানালো হলো, ‘‘এ বছর আন্তর্জাকি ব্র্যান্ড সুইডিস কোম্পানি ‘অরবিট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে যে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে তার প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাথমিক রিসার্চার’ হিসেবে তপুকে মনোনিত করেছে এবং তারা চান তপু যেন যতসম্ভব দ্রুত মতামত জানিয়ে মেইল করে। তপু করেনি। বড় ভাই, তপু যাকে বড় দাদা বলে ডাকে, তিনি এসব শুনে অনেকটা রাগ করে তপুকে তার অফিসে ডাকলেন। বিকাল হবার আগেই তপু দাদার অফিসে উপস্থিত হয়ে জানতে পারলো, দাদা জরুরী মিটিং এ। অপেক্ষার ধৈর্য ক্ষীণ হয়ে এলে অবশেষে দাদা বের হয়ে তপুর হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। ‘এটা কী বড় দাদা?’ ‘পড়ে দেখ’। ‘আপনাকে পরবর্তী মাসের প্রথম দিন থেকে আমাদের সাথে পেলে আমরা আন্তরিক খুশি হবো। আপাতত আপনাকে আমাদের খুলনাস্থ রাবার-বন প্রজেক্টে নিযুক্ত করা হলো।’ কম্পোজ করা পত্রটি খামের ভিতর ফের ঢুকিয়ে ফিরিয়ে দিলো তপু।। বলল, ‘মনে হয় পারছি না।’ ‘কেন? বিশেষ কোন কারণ?’ ‘আম্মা।’ শব্দটি শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে তপুর দাদা উচ্চকন্ঠেই বলল, ‘আম্মা বুঝি তোর একার? আমাদের না? নিজেকে খুব দায়িত্ববান মনে করিস না?’. . .তপু মাথা নিচু করে সোফায় বসে রইল। ইটের ভাটার চিমুনি দিয়ে বমির মতো যেমন ধোঁয়া বের হয় তেমনি গরম ধোঁয়া বমির মতো বের হতে থাকলো তপুর কান দিয়ে। মাথার তালুটা রডমিলের অগ্নিচুল্লির মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু তপু শব্দহীন রইল সঙ্গত কারণে। মনে মনে কেবল গত পাঁচটি বছরকে স্মরণ করলো। চোখে ভাসল তার চার ভাই-বোনের মুখ-চোখ। আর ভেসে উঠল মায়ের মুখটা। শুধু আস্তে করে বলল, ‘হ্যাঁ ‘আম্মা আমাদের সবার!’. . .অফিস থেকে বের হয়ে বনাননী থেকে পায়ে হেঁটে বাসার দিকে রওয়ানা হলো তপু। পথে ছোট বোনের সাথে দেখা। প্রিমিও জিপের সামনের সিটে ভগ্নিপতি, পেছনে বোন, ফুটফুটে দুই শিশু, রাজার দুলাল। গাড়িটা পাশ দিয়ে সাই করে চলে গেল। কথা হলো না। তপু বাড়ি ফিরে এলো। তার কাছে আজ নতুন কয়েজন স্টুুডেন্ট আসার কথা বলে অন্য দিনের মতো পথে আর দেরি করলো না।

৪.
কখনো পুকুরের ছোট ছোট ঢেউ, কখনো নদীর মাঝারি ডাক, কখনো সৈকতে আছড়ে পড়া সাগর ঢেউয়ের মতো সময় চলতে থাকলো। এখন পথে নামতে তপুর ভয় হয়। যার সাথেই দেখা হয় সে’ই কিছু না কিছু পরামর্শ দেয়। শিশু বা অবুঝ ভেবে গায়ে হাত দিয়ে অনেক কিছু বুঝায়। কেন চাকরি হচ্ছে না, কেন চারকি করছে না; বিয়ে-সাদি করতে হবে, বয়স বেড়ে গেলে সমস্যা, নানাবিধ শু-কথা। তপু শোনে, উত্তর দেয়না। মাথা নাড়ে, সায় দেয়। আমার ভয় পায়। চাকার ভিতর ঢুকলে যদি সেও যান্ত্রিক চাকা হয়ে যায়! যেমন তার ভাই-বোনেরা! লোভের গহ্বরে প্রবেশ করলে সেও যদি ভদ্রলোক হয়ে যায়! তার প্রিয়তমাও যদি তাকে নিয়ে একাকিত্ব চায়! সেও যদি হয়ে ওঠে ভাই-বোনদের মতো! অকৃতজ্ঞ সন্তান। তপুর ভয় হয়! সে, ভয়টা কাউকে বলে না। নিজের ভেতর চেপে রেখে দিন কাটায়। প্রিয় মানুষ, রিতার সাথেও বলা হয়ে ওঠেনা, তার ভয় কোথায়, সংশয় কোথায় . . . দুই বছর পর। ক্লান্ত রিতা জানিয়ে দিলো, ‘সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা বা এর চেয়ে ঊর্ধ্বে আসিন করা তার দ্বারা সম্ভব নয়। সামনের অগ্রহায়ণ শেষে বিয়ে। পাত্র বিদেশে বিত্তবান।’ তপু নিশ্চুপ। তেমন কোনো কথা বলে না। শোনে। শোনতে শোনতে নিজের সাথেই বলে, ‘জানি, ‘অরবিট’এ যাাওয়া আমার দ্বারা যেমন সম্ভব হয়নি, রাবার প্রজেক্ট যেমন গ্রহণ করি-নি, তোমার সম্ভবের মধ্যে প্রবেশ করাও আমার দ্বারা হয়তো সম্ভব না।’ ‘কিছু বলছো না যে?’ ‘বলার মতো কিছু নেই যে?’ ‘কিছুই বলার নেই?’ ‘ আছে, তবে তা তোমাকে খুশি করতে পারবেনা, যেহেতু তোমাকে তা আমার প্রতি আরও বিদ্বেষী করে তুলতে সেহেতু না বলাই থাক।’ ‘কিছুতেই কি সম্ভব না?’ ‘অসম্ভবের পথ আমি জেনে-শুনেই ঠিক করেছি। মনে হয় সম্ভব না’। রিতার চোখে জল। তপুর চোখে জল। রিতা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ‘আসি’ বলে পা বাড়ায় সামনে। তপু, রিতার পিছনে। রিতা সামনে যায়। তাদের দূরত্ব বাড়ে। বিএমডব্লিউ গাড়িটা ফুলার রোড থেকে নীলক্ষেতের দিকে টার্ন নিলে তপু তাকিয়ে থাকে তবুও- যতক্ষণ গাড়িটা দেখা যায়। রিতার মুখটা শেষ বারের মতো চোখে ভাসাতে চেষ্টা করে তপু কিন্তু তপুর চোখে তিমি মাছের মতো বারবার ভেসে উঠে বিছানায় পড়ে থাকা প্যারালাইজ্ড, সাবেক ডিস্ট্রিক জজ, পাঁচ-পাঁচজন উচ্চশিক্ষিত জনের অসহায় জননী আছিয়া বেগমের মুখটা। তপু আবার চেষ্টা করে- আবার তপুর চোখের ভিতর ভেসে উঠে তার মায়ের মুখটা মুখটা। . . .তপু দেখছিল তাকেও। তপুর ভিতরে আরেক তপু। সে প্রচন্ড ঘামছে। লবন জল তাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে, সে দাঁতে দাঁত চেপে একটি অঙ্গ ব্যবচ্ছেদ সইছে। কিন্তু সে কাঁদছে না। শুধু সে টের পাচ্ছে তার চোখের জল থেকে নাশিকা রন্দ্রে প্রবেশ করছে তার আম্মার গায়ের গন্ধ. . .


জোবায়ের মিলন
বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি, ঢাকা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top