সিডনী বুধবার, ৮ই মে ২০২৪, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১

এই রাত তোমার আমার : শিবব্রত গুহ


প্রকাশিত:
২১ জুন ২০২০ ২০:৫৭

আপডেট:
২১ জুন ২০২০ ২০:৫৮

ছবিঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

 

" এই রাত তোমার আমার/ ঐ চাঁদ তোমার আমার/ শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের / এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের /কুহু কূজনে
এই রাত তোমার আমার "

- এটি অতীত দিনের বাংলা সিনেমার একটি বিখ্যাত গান। গানটি কে গেয়েছিলেন মনে পড়ে? তার নাম?

হ্যাঁ অবশ্যই, তিনি যে সবার প্রিয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর গান আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়কে ভরিয়ে তোলে। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ১৬ই জুন, পবিত্র বারাণসী শহরে। তাঁর মাতামহ ছিলেন একজন চিকিৎসক। তাঁদের আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরে। তাঁর পরিবার কোলকাতা শহরে আসে বিশ শতকের প্রথমার্ধের দিকে।
তিনি ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে, পড়াশোনা করেছিলেন। সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। এই সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে, একজন নামী কবি হয়েছিলেন। ওই সময়কালে, সন্তোষ কুমার ঘোষ মহাশয়ের সাথে তাঁর বিশেষ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট লেখক।
ওই সময়ে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় লিখতেন ছোট গল্প, সন্তোষ কুমার লিখতেন কবিতা আর গান গাইতেন
সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়তে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু, তিনি, সংগীতের জন্য, আপন শিক্ষা ত্যাগ করেছিলেন।
তাঁর সাহিত্যিক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিছুদিন তিনি লেখালিখি করেছিলেন দেশ পত্রিকার জন্যে।
১৯৩৭ সাল থেকে তিনি সম্পূর্ণভাবে, প্রবেশ করেছিলেন সংগীত জগতে। ১৯৩৫ সালে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর বন্ধু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রভাবে, আকাশবাণীতে, তাঁর গান রেকর্ডিং করেন। গানের প্রথম লাইন ছিল, " আমার গানেতে এলে নবরূপী চিরন্তনী "।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁর প্রারম্ভিক সংগীত জীবনে, পরামর্শদাতা হিসাবে পেয়েছিলেন শৈলেশ দত্তগুপ্তকে। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ। প্রথম জীবনে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সংগীত জীবনে বাংলার প্রখ্যাত গায়ক পঙ্কজ মল্লিকের বিশেষ প্রভাব ছিল। এজন্য, তাঁকে ডাকা হত, " ছোটো পঙ্কজ " নামে। ১৯৩৭ সালে, তিনি, কলাম্বিয়ার লেবেলে, তাঁর প্রথম গ্রামাফোন রেকর্ড প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৪১ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র " নিমাই সন্ন্যাস " - এ, প্রথম গান গেয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে, তিনি চলচ্চিত্রের বাইরে, বাংলা গানে নিজে প্রথম দিয়েছিলেন সুর। ১৯৪৪ সালেই, পন্ডিত অমরনাথের সংগীত পরিচালনায়, তিনি ' ইরাদা ' নামে এক চলচ্চিত্রে প্রথম হিন্দি গান গেয়েছিলেন। তাঁকে শীর্ষস্থানীয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসাবে মানা হয় এখনো।
১৯৪৪ সালেই, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কলম্বিয়া লেবেলের অধীনে, চলচ্চিত্রের বাইরে, প্রথম রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলো ছিল, " আমার আর হবে না দেরি" এবং " কেন পান্থ এ চঞ্চলতা "। ১৯৪৭ সালে, তিনি সংগীত পরিচালক হিসাবে প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। সেই বাংলা চলচ্চিত্রের
নাম ছিল " অভিযাত্রী "। ওই সময় তাঁর সমসাময়িক পুরুষ সংগীত শিল্পী ছিলেন অনেক। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি এখানে। জগন্ময় মিত্র, রবীন মজুমদার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, বেচু দত্ত, তালাৎ মাহমুদ প্রভৃতি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়েরা ছিলেন তিন ভাই ও এক বোন। তাঁর বড় ভাইয়ের নাম ছিল তারাজ্যোতি। তিনি লিখতেন ছোট গল্প। তাঁর ছোট ভাই ছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়। তিনি ছিলেন একজন সুরকার ও গায়ক। তিনি কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত গান হল, "এই পৃথিবীতেই সারাটা জীবন "। তাঁর সুর দেওয়া নামকরা দুটি বাংলা চলচ্চিত্র হল হসপিটাল এবং অবাক পৃথিবী। আমার বাবা অমল গুহ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন অমল মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকেই।
বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমারের সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কেমিস্ট্রি ছিল অসাধারণ। এদের জুটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রে সুপার- ডুপার হিট। উত্তম কুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া কত যে হিট গান আছে তার ইয়ত্তা নেই।
সেইসব গান আজো লোকের মুখে মুখে ফেরে। ১৯৫০ সালের শেষ দিকে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অসংখ্য বাংলা, হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য গান গেয়েছিলেন, সুর দিয়েছিলেন, অসংখ্য রবীন্দ্র সংগীত তিনি গেয়েছেন ও চলচ্চিত্রের বাইরের গান করেছিলেন রেকর্ড।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া কয়েকটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ এখানে করলামঃ

১. আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা। ২. খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার। ৩. এ ব্যথা কি যে ব্যথা! ৪. নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী। ৫. মুছে যাওয়া দিংগুলি। ৬. ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস। ৭.কে জানে ক- ঘন্টা! ৮. আয় খুকু আয়। ৯. এই পথ যদি না শেষ হয়। ১০. তারে বলে দিও।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে সব বাংলা চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছিলেন, তার মোট সংখ্যা হল ১৩৮ টি।
তাদের মধ্যে কিছু নাম এখানে তুলে ধরছি-

১। অভিযাত্রী। ২। পূর্বরাগ। ৩। শাপমোচন। ৪। হারানো সুর। ৫। লুকোচুরি। ৬। সূর্যতোরণ। ৭। নীল আকাশের নীচে। ৮। দীপ জ্বেলে যাই। ৯। সপ্তপদী। ১০। সাথীহারা।

সুরকার হিসাবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যেসব হিন্দি চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলেন, তাদের মধ্যে, নাগিন, আনন্দ মঠ, অনজান, দুর্গেশনন্দিনী, এক হি রাস্তা, দেবী চৌধুরানী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরকার হিসাবে যে ইংরেজি চলচ্চিত্রে সুর দিয়েছিলেন তার নাম হল " Siddhartha ", সালটা ছিল ১৯৭২।
তাঁর গাওয়া হিন্দি গানগুলির মধ্যে, হ্যায় আপনা দিল, বেকরারি করকে হামে প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
তিনি অনেক রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছিলেন সারা জীবন ধরে। তার মধ্যে কিছু এখানে তুলে ধরছিঃ
১- চরণ ধরিতে দিও। ২- এই করেছো ভালো। ৩- আমার হৃদয়। ৪- পুরানো সেই দিনের কথা।

১৯৮৭ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।
কিন্তু, তিনি বিনীতভাবে তা করেছিলেন প্রত্যাখ্যান। এর আগে, ১৯৭০ সালে, তিনি একই ভাবে পদ্মশ্রী পুরস্কার নিতে করেছিলেন অস্বীকার। ১৯৮৮ সালে, লালন ফকির সিনেমাতে, গান গেয়ে, তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়কের সন্মান পেয়েছিলেন।
১৯৯০ সালের প্রথমদিকে রেকর্ড করা, বাচিক শিল্পী গৌরী ঘোষের সাথে এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায় পুনরুল্লেখ করেন, যে, তিনি জানতেন না যে, জীবিত অবস্থায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যে কত মানুষ ও পরিবারকে আর্থিক ও অন্যান্য ভাবে সাহায্য করেছেন, শুধুমাত্র তাঁর মৃত্যুর পরেই সেইসব ক্রমশ প্রকাশিত হয়েছিল।

এমনই মহান মানুষ ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁর মন ছিল অনেক অনেক বড়। তাঁর হৃদয় ছিল বৃহৎ। তাঁর কন্ঠসুধায় আজো মুগ্ধ কত মানুষ! তিনি একাধারে ছিলেন সংগীত শিল্পী, সংগীত পরিচালক ও প্রযোজক। তিনি গান গেয়েছেন বাংলা, হিন্দি ও অন্যান্য ভাষায়। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। তিনি শ্রেষ্ঠ পুরুষ নেপথ্য গায়ক হিসাবে, দুইবার পেয়েছিলেন জাতীয় পুরষ্কার।

এই ২০২০ সাল হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মশতবর্ষ। দেখতে দেখতে একশো বছর পার হয়ে গেল। ১৯৮৯ সালের, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, তিনি পরলোকগমন করেছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আজ নশ্বর দেহে আমাদের মধ্যে না থাকলেও, তাঁর অমর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, তিনি চিরকাল সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বিরাজ করবেন।

"দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা - পরা ওই ছায়া/ ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ।
ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন মায়া/ গেয়ে গেল কাজ - ভাঙানো গান।
নামিয়ে মুখ চুকিয়ে সুখ যাবার মুখে যায় যারা/ ফেরার পথে ফিরেও নাহি চায়,
তাদের পানে ভাঁটার টানে যাব রে আজ ঘরছাড়া - -
সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়।
ওরে আয়/ আমায় নিয়ে যাবি কে রে/ দিনশেষের শেষ খেয়ায়।"

( তথ্যসূত্র সংগৃহীত)


শিবব্রত গুহ
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top