সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

দূরের মানুষ : শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২০ ২১:৪৬

আপডেট:
২৫ জুন ২০২০ ২১:৫৬

 

জহির কেমন যেন হঠাৎ বদলে গেল। প্রথম দিকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতো না তনিকা। ভাবতো, জহিরের নতুন ব্যবসা, হয়তো একারণে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় সারাক্ষণ।
মাঝ রাত পর্যন্ত তনিকা জহিরের অপেক্ষায় থেকে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতের দিকে তনিকার ঘুম ভাঙে জহিরের ডাকে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে দরজা খুলতে খুলতে তনিকা বিরক্ত হয়ে বলে,
এত রাতে কোনো ভদ্রলোক বাসায় ফিরে ? তোমার এই রাতে বাড়ি ফেরা আমার খুব অসহ্য ঠেকে।
জহির খুব শান্ত গলায় তনিকার কথার জবাব দেয়,
কি করবো বলো ? নতুন ব্যবসা। সব কাজ আমাকে একাই সামলাতে হয়।
-কেনো, তোমার পার্টনার মাখন মৃধা ; উনার কাজটা কি, শুনি ?
একটু ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বলে তনিকা। জহির কোনো মন্তব্য করে না।
তনিকা বিছানায় মড়ার মতো পড়ে থাকে। কোনো রকমে বাকি রাতটুকু পার হয়। জহিরের ঘুম ভাঙলে সকালের খাবার সেরে দ্রুত আবার বেরিয়ে যায়।

জহিরের এই হঠাৎ বদলে যাওয়া মেনে নিতে পারে না তনিকা। তাছাড়া জহির কি ব্যবসা করে, সেটাও তনিকা জানেনা। জহিরের কাছে যখনই ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চায়, জহির এড়িয়ে যায়। জহিরের পার্টনার মাখন মৃধা ; ওই টেকো কালো লোকটিকেও সুবিধের মনে হয় না। কেমন যেন খুনে, পাকা বদমাশের মতন চেহারা লোকটির ! জহির এরকম লোককে ব্যবসার পার্টনার কেনো বানিয়েছে, তনিকা ভেবে পায় না।

জহিরের গ্রামের বাড়ি জীবননগর থানার রায়পুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। খুব অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়েছে জহির। বিয়ের পর তনিকা জানতে পেরেছে, জহিরের বাবা নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো এক দলের নেতা ছিলো। প্রতিপক্ষের হামলায় জহিরের মা-বাবা দ’ুজনেই মারা যায়। সেসময় জহির জীবননগর থানা সদরে নানা বাড়িতে থেকে স্কুলে পড়াশোনা করতো।
তনিকার সাথে জহিরের যখন পরিচয়, জহির তখন ঢাকার পরীবাগে থাকতো। বহুজাতিক একটি কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করতো। আর তনিকা সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্রথম পরিচয়ে বেশ নাটকীয়তা ছিল। জহিরকে তনিকার ভালোলাগে। কোনো রকম বাছবিচার না করেই ভালোবেসে ফেলে জহিরকে। নরম স্বভাব আর ভালো চাকরির কারণে তনিকার বাবারও খুব পছন্ত হয় জহিরকে। জহিরের আপন বলতে সংসারে তেমন কেউ ছিল না। জহিরের
দূর সম্পর্কের এক মামার অভিভাবকত্বে জহিরের সাথে তনিকার বাবা তনিকাকে বিয়ে দেয়।
মাখন মৃধা ও জহির একই কোম্পানিতে চাকরি করতো। মাখন মৃধার বাড়ি জহিরের গ্রামের পাশের গ্রামেই। দিনে দিনে মাখন মৃধার সাথে জহিরের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একসময় দু’জনেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে জীবননগর চলে আসে। জহির তনিকাকে নিয়ে ওর নানা বাড়িতে উঠে। জহিরের নানা-নানির মৃত্যুর পর তাদের কোন সন্তান না থাকায় বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। জহির বাড়িটি সংস্কার করে তনিকাকে নিয়ে সুখের নীড় রচনা করে। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই মাখন মৃধাকে নিয়ে শুরু করে নতুন কারবার।

জীবনের অনেকটা সময় নানা বাড়িতে কেটেছে জহিরের। শান্ত আর বিনয়ী বলে নানা বাড়িতে জহিরকে সবাই ভালোবাসত খুব। প্রতিবেশী বর্ণ ভাবিতো প্রায়ই বলতো,
হীরের টুকরো বর পেয়েছো ! এমন বর সবার ভাগ্যে জোটে না।
শুনে বেশ গর্ব হতো তনিকার, কিন্তু জহিরের অনেক রাতে বাড়ি ফেরা ভাবিয়ে তোলে তনিকাকে। তনিকা জহিরকে চাপ দেয় তার ব্যবসা সম্পর্কে জানতে, কিন্তু কোনো ভাবেই জহির মুখ খোলে না। ভীষণ ক্ষেপে যায় তনিকার উপর।
তনিকার বুক ভেঙে কান্না আসে। কষ্টটা ভাগ করার তেমন কাউকে না পেয়ে বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে কাঁদতে থাকে।

দিন গড়িয়ে যায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। জহিরের রহস্যময়তাও বাড়তে থাকে সমানতালে। রাতে জহিরের সঙ্গে দেখা করতে ইদানিং অনেক অপরিচিত লোকজন আসে বাড়িতে। তনিকা শঙ্কিত হয়। জহির তনিকাকে অভয় দেয়,
ব্যবসা করতে গেলে বিভিন্ন লোকের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। এতে ভয় পাওয়ার কি আছে ?
তনিকা জহিরকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদের সুরে বলে,
বর্ণ ভাবির কাছে শুনলাম, মিয়াভাই নামে নিষিদ্ধ দলের নতুন একজন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর আবির্ভাব ঘটেছে জীবননগরে।
তার ভয়ে নাকি অনেকেই জীবননগর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমার খুব দুশ্চিন্তা হয় তোমাকে নিয়ে। ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চলো না, আমরা ঢাকায় ফিরে যাই। ঢাকায় গিয়ে তোমার কোম্পানির বস্কে বললে নিশ্চয়ই তিনি তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। জহির তনিকার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

রাত গভীর হয়। জহির বাড়ি ফেরে না। জহিরের উপর অভিমান করে তনিকা ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে পথচারীদের কোলাহলে তনিকার ঘুম ভাঙে। দলে দলে লোকজন যাচ্ছে মালসাদহ বিলের দিকে। মিয়াভাইকে কে বা কা’রা জবাই করে ফেলে রেখে গেছে মালসাদহ বিলের ধারে। বর্ণ ভাবি এসে খবর দিলো,
শুনেছো, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী মিয়াভাই খুন হয়েছে ?
মিয়াভাইয়ের অপমৃত্যুতে অজানা আতঙ্কে তনিকার বুকটা কেঁপে উঠে।

দুপুরের মধ্যেই ডোম মালসাদহ বিল থেকে ভ্যানরিক্সায় মিয়াভাইয়ের লাশ নিয়ে জীবননগর থানার পৌঁছায়। জহিরের নানা বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষেই থানা। বর্ণ ভাবিকে নিয়ে অন্যদের সাথে তনিকাও লাশ দেখতে থানায় যায়। হোগলার চাটাইয়ে শুইয়ে রাখা মিয়াভাইয়ের লাশ। লাশ দেখে তনিকা বিস্ময়ে ও গভীর বেদনায় বাগ্রুদ্ধ হয়। ভয়ে সে বর্ণ ভাবিকে জড়িয়ে ধরে। এ কাকে দেখছে সে ? এ যে জহির ! জহিরকে এমন দেখাচ্ছে কেন ? জহিরকে মনে হচ্ছে অনেক দূরের মানুষ।

তনিকার নিমীলিত চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। অব্যক্ত বিষাদে বুকটা ভারী হয়ে আসে। তনিকা জহিরের খুব কাছে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তনিকার মনে হয়, তার দু’পায়ে কে যেন বেঁধে দিয়েছে পাথরের বেড়ি।

বেড়ি ঠেলে এতটুকু পথ পেরিয়ে জহিরের খুব কাছে যাওয়ার সামর্থ্য যে তার নেই !

 

শেখ মোহাম্মদ হাসানূর কবীর

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top