সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষা বিমোহিত কবিতার পংক্তি : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২০ ২২:২২

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০১:২৮

 

ঋতুময় এই দেশে ‘বর্ষাঋতু’ প্রকৃতির মাঠে যেভাবে কিশোরীয় লাবণ্য নিয়ে জেগে ওঠে সেভাবে ষড়ঋতুর আর কোনটিকেই এমনরূপে দেখা যায় না। বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের লেখকরা যত রূপে লিখেছেন তা আর কোন্ ঋতু নিয়ে লিখেছেন বলা মুশকিল। বর্ষাঋতু বাংলার কবি মন-মননকে অন্দোলিত করেছে অনন্য এক আলোড়নে। যদিও বাংলা ভাষার কবিরা ’গ্রীষ্ম, বর্ষা শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত’এর সব ঋতুর বিভা নিয়েই কবিতা সাহিত্য তৈরি করেছেন দুর্দম গতিতে তবু বর্ষার আবেদন নিবেদন অন্য যে কোন ঋতুর চেয়ে বিন্ন। বর্ষায় কবি যেন নেচে ওঠেন ময়ূরীর মতো। কবি যেন পেখম মেলে লিখতে বসেন বর্ষার মেঘ, বৃষ্টি, আলো, অন্ধকার, জল, কাদা, মেঠো পথ, নদীর ঢেউ, নৌকোর ঘাঁট, বাড়ন্ত জল, মৃদু কলতান।
বাংলার কবি যেন বর্ষার আবেশ পেলে যুগের ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেন অদম্য এক যৌবনে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে প্রতিটি অণুক্ষণ ধারণ করেন মনের কোণে কোণে; দৃষ্টির কোটরে। তারপর অমৃতের মতো শব্দে-বাক্যে-পয়ারে, নানান ছন্দ-তাল-রূপ-রস গন্ধ মিলিয়ে ব্যক্ত করেন দৃষ্টি-অবগত রূপের বৈচিত্র। ঋতুর এ বর্ষারূপ কবিকে মাতিয়ে তোলে শব্দের এক অনন্য শিল্পকলায়।
বর্ষা তার রিনিঝিনি শব্দ প্রকৃতিকে কখনো আনন্দে সিক্ত করে, কখনো বেদনা রিক্ত করে আবার কখনো বিরহকাতরতায় মূক করে তোলে। প্রকৃতির সে ভাব কবি অবলোকন করেন একচোখে, তারপর সে ভাব ভর করে কবির সরল মানসে। সেখান থেকে কবি তা আলতো করে তুলে আনেন কলমের কালিতে। প্রকৃতি কবিকে যেভাবে প্রেরণ করে তার সুগন্ধ, কবি সেভাবেই তা ছড়িয়ে দেন কলমের অক্ষরে। আনন্দ যেন আর ধরে না! কবি এবেলা বৃষ্টির ফুল কুড়ান তো ওবেলা মেঘের মালা গাঁথেন। ওবেলা মেঘের মালা তো, পরের বেলা ঝড়ের তোড়ে ছিন্ন মালার বেদনায় নীল হয়ে কুঁকড়ে হাঁটেন। সামান্য পরেই আবার উঁকি দেয়া সূর্য কবিকে নিয়ে চলে যায় ঝিলের কাছে, বিলের কাছে, ঘাঁটের কাছে, গ্রাম্য বধুয়ার কলসীর কাছে, কবি যেন সে রূপে বিমোহীত হয়ে ফেটে পড়েন অট্ট হাস্যে, ভুলে যান ঘারদোর, বিগত বেদনার লেন-দেন। আর তাকেই উপমা করে কবি রচনা করেন মধুসুধা।
বর্ষা ঘিরে এ সুধা রচনার আনন্দ থেকে ফিরে থাকতে পারেননি আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে উত্তরাধুনিকতার কোন কবিই। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে প্রেমিক কাব্যিক মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের দেবী- বর্ষার ছুরিতে খুন হতে চেয়েছেন বারে বারে, নিজেরই ইচ্ছায়।
কালিদাস ’মেঘদূত’ কবিতায় পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকী জীবনে ‘মেঘ’কে দূত করে পাঠিয়েছেন প্রিয়ার কাছে। চন্ডিদাস বর্ষাকে হিসাব করেছেন প্রেমোবহ্নিতে ঘৃত হৃদয়ের পোড়া ছাইয়ের অনুসঙ্গ করে। বিরহ কাতরতা প্রকাশ করেছেন মেঘের ঘনকালো রূপের সঙ্গে তুল্য করে। তিনি লিখেছেন-
‘এঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
চন্ডিদাসের এ বিরহবিধূরতা বর্ষার ঘনমেঘের মতো বেজে উঠেছে তার হৃদয়মমে। প্রেমিকার জন্য হাহাকার করা অন্তর কেঁদে কেঁদে অস্থির যখন তখন কবি আর কিছুর সাথে তুলনা করে তা প্রকাশের অবকাশ খুঁজে পাননি। প্রখর দৃষ্টি দিয়ে দেখা বর্ষার কৃষ্ণ মেঘকেই তার মনে হয়েছে উপযুক্ত ভাবসঙ্গ। বর্ষায় যখন আকাশে মেঘ জমে, মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় দিক-দিগন্ত, অন্ধকার হয়ে নেমে আসে আঙিনায়, তখন ঠিক যেন বেদনার মতো বিমূঢ় হয়ে থাকে প্রকৃতি। আর তার মতোই প্রেয়সীর জন্য ভারক্রান্ত মনও বিমূঢ় হয়ে থাকে বেলা, অবেলা। বর্ষার রূপ আর মানবের মন যেন পরিপূরক। বিদ্যাপতিও যেন বর্ষার মেঘের মাঝেই পেয়েছেন মনের খোরাক। পেয়েছেন বেদনাকে উজার করার মতো সঙ্গ। বুকের ভিতরে আগলে রাখা যাতনাকে তাই প্রকাশ করেছেন ভরা ভাদরের বেদনার্ত রূপের সাথে মিল করে-
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর- এ ভরা ভাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দিরও মোর।’
মাইকেল মধুসুদন দত্তের কবিতায় বর্ষা আবার ধরা দিয়েছে প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার সাথে দেবতাগণও ঘোষণা করেছে একাত্বতা। ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত বর্ষার রূপকে ভাবনার তুলিতে বর্ণানা করেছেন এভাবে-
‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর
রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অনন্তরে।’
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকে একবাঁকে দেখেননি। বহুবাঁকে বহুপাকে বর্ষা দেখেছেন তিনি। উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথই যেন কবিতার মাধ্যমে বর্ষাকে পূর্ণতা দিলেন। তাই তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রঙ প্রকাশ পায় বন্দনা রূপে। আকাশ ঘনকালো করে গুরুগুরু গর্জনে বৃষ্টির অবিরাম ধারা নেমে এলে কবি ফিরে যান তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলিতে। তখনই তাঁর কবিতায় ঝরে পড়ে স্মৃতিকাতরতার বৃষ্টি-
‘দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে-ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ওপারেতে বৃষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশ মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলে বেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদে এল বান।’ (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর)
আবার তিনি এ বর্ষাকেই বেছে নিয়েছেন প্রেমিকাকে প্রেম সম্ভোধনের উত্তম সময় হিসেবে। বর্ষার বারিধারায় অধিক ব্যাকুল হয়ে আবেগতাড়িত কবি-মন বলেছেন-
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারিধার।
দুজনে মুখোমুখো গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার-
জগতে কেহ যেন নাহি আর।

সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব-
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।’ (বর্ষার দিনে)
বিদ্রোহী খ্যাত কবি- কাজী নজরুল ইসলাম আগুনের কবিতাই লিখেননি তাঁকেও প্রভাবিত করেছে বর্ষাঋতু। তাঁর কবিতাযও বর্ষা ধরা দিয়েছে নানান প্রতিকী ব্যঞ্জনায়। ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় নজরুল গেয়েছেন-
‘‘যেখা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকি ওঠ-না, কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তপসিনী অচপল
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ‘ফটিক জল’!’’
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এড়িয়ে যাননি। বাংলাভাষার শুদ্ধতম এ কবির কবিতায় বর্ষা এসেছে আরও কাছ ঘেঁষে। ‘এ জল ভালো লাগে’ কবিতায় কবি বলেছেন-
‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে
তার শান-¯িœগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে;-নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে- বনের ভিতর
বার বার উড়ে যায়,- তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে. . .’
পল্লী কবি জসিমউদ্দীনের কবিতায় বর্ষার এসেছে আরেক রকম ব্যঞ্জনা হয়ে। তিনি উদাস হয়ে দেখেছেন বর্ষার রূপ। সে রূপে এমনই ব্যাকুল হয়েছেন, যে তিনি কোন পথ আর খুঁজে পান না, সব পথই আনন্দে ভরপুর। ‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় কবি বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণ মুখর গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে যে আড্ডার আসর বসে, ফাঁকে ফাঁকে পল্লী বাংলার শ্রমজীবী মানুষের অসমাপ্ত কাজগুলোও যে আড্ডার ছলে সারা হয়ে যায় সেই কিচ্ছা-কাহিনী শোনার লোকায়ত চিত্র তুলে ধরেছেন চকৎকার-
‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়রের দলিজায়
গল্প গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি;
কেহবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কসি কসি।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে
আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু মেঘ ডাকে,
এসবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপ আঁকে।’


‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদ অধ:পতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতায়ও বর্ষার দোল লেগেছে। বৃষ্টির ছন্দ তাঁকে নাচিয়েছে। মনে আনন্দের ঢেউ খেলিয়েছে। তিনি আনন্দে তবলার ছন্দের মতো ‘বৃষ্টির গান’এ গেঁথেছেন-
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।’
এদিকে স্বাধীনতার কবি শামসুর রহমান যুদ্ধের কবিতা, স¦াধীনতার কবিতা, বিজয়ের কবিতা- সাথে প্রেমের কবিতা নিয়েই ডুবে থাকেননি। তাঁর মানসপটে রাইফেল, বেয়োনেট, জলপাই রঙ’এর ট্যাংকই খেলা করেনি কেবল। তাঁকেও প্রেমে বুঁদ করেছে বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য তিনি অপেক্ষায় থেকেছেন- যেমন মানব হৃদয় অপেক্ষায় থাকে প্রেমিকার জন্য। বর্ষাকে দেখতে চেয়েছেন সবকিছু ছেড়ে ভালোলাগার স্পর্শকাছে। তাই তো চাষীর মতো তিনিও বর্ষাকে প্রার্থনা করেছেন-
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।’ (কবিতা: অনাবৃষ্টি)
কবি আল মাহমুদের চোখ, সে এক অন্য চোখ। সে চোখে কবি বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার কথা বলেছে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন-
‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওয়লা পিছল
আমাদের গরীয়ান গ্রহটির গায়।’’
নির্মলেন্দু গুণ বর্ষার মেঘ আর বৃষ্টি দুই’কেই ধারণ করে আছেন বোধের ভিতর। চাকুর এপিঠ ওপিঠের মতো ব্যবহার করেছেন জাগ্রত প্রতিবাদে, অন্যানেয় শাঁই শাঁই চাবুক রূপে। বর্ষাকে উপমা করেছেন রক্তকন্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে-
‘‘আমি কতো ভালোবাসা দু’পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,
কল্পনা মেঘোলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে।
আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে।’’ (কবিতা: বউ)
সৈয়দ শামসুল হক বর্ষার বৃষ্টিকে পবিত্র এক জলফোয়ারা রূপে সাজিয়েছেন। বৃষ্টিতে ধৌত হলে পৃথিবীর আর কোন জলে ধৌত হবার প্রয়োজন নেই বলেই বর্ষার এ বৃষ্টিতে ভেজা ঘরে- প্রাণের স্বদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন।
‘‘তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন’’ (তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ)
বাউল মনা কথাকবি হুমায়ূন আহমেদের বর্ষা লোভের কথা কে না জানে। সমুদ্রের কাছে গেলে এই গীতকবি যেমন হুলুস্থুল মার্কা পাগল হয়ে যেতেন তেমন মাতাল হয়ে যেতেন বর্ষার বৃষ্টি দেখে। আকাশ ডাক দিয়ে বৃষ্টি নামতে দেরি হতো- বাড়ির উঠোনে নামতে দেরি হতো না বিন্দু মাত্র তাঁর। যে প্রিয়াকে ভালোবাসতেন প্রানোধিক সে প্রিয়তমাকে তাই তিনি অন্য কোন ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন, যদি তাঁকে মনে পরে-
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসা, চলে এসো
এক বরষায়।

এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।

যদিও তখন আকাশ রবে বৈরি
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো।

তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।’ (গীতকবিতা: যদি মন কাঁদে)
ঘনমেঘ যখন দলবেঁধে আকাশে উড়ে বেড়ায় সে মেঘের সাথে কবির ভাবপ্রবণ মনও কল্পনার জগতে উড়তে থাকে। তখন সরল মানুষের মতো কবির মনের সুখ, দু:খ, আনন্দ, বেদনাগুলো যেনো মনের জলছবি হয়ে ওঠে মেঘের শরীরে। হাসান হাফিজ তাঁর ‘বর্ষাভেজা পদাবলীতে’ বর্ষাকে আনন্দ বেদনার উভয় রূপেই চিত্রাঙক করেছেন। বর্ণনা করেছেন-
‘শ্রাবণে বিরহ শুধু নয়, আগুনও রয়েছে
সেই তাপে শুদ্ধ হবে অসবর্ণ মিল পিপাষা।’
কান্নার কবি মহাদেব সাহা। বর্ষা যেমন আষাঢ় শ্রাবণ শুধু কাঁদে আর কাঁদে। পাঁচটি ঋতুর সমস্ত বেদনা নিয়ে যেমন বর্ষা এসে হাজির হয় প্রকৃতির উঠোনে। তেমনি কবি মহাদেব সাহা বর্ষার বৃষ্টি কান্নাকে সারা জীবন যেন ধরে রাখলেন তাঁর ভাবের মলাটে। বার্ষা না থাকলে কবি কী করে তাঁর কান্নাকে উপমা করতেন তাই বড় প্রশ্ন হয়ে বাজে। একটা জীবন কবির কাছে পুরোটাই যেন বর্ষার মেঘের মতো-
‘এই যে জীবন উজাড় করে বর্ষার মেঘের মতো
তোমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছি
তুমি কখনোই তার কিছু অনুভব করলে না;

তুমি বুঝলে না এই স¯্র সহ¯্র চুম্বনের ব্যাকুলতা নিয়ে
আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,
তোমাকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য হাজার বছর ধরে
আমি মেঘ হয়েছি সমুদ্রে,
লক্ষ লক্ষ শীতরাত্রি ভেদ করে তোমার জন্য ফুটেছি গোলাপ;

তুমি বুঝলে না আমি কতকাল এই বর্ষা হয়ে আছি,
মেঘে মেঘে মল্লার হয়ে আছি তোমার জন্য
একবিন্দু অশ্রু হয়ে আছি সমস্ত প্রেমিকের চোখে।’ (আমার এতো বর্ষা’কে উপমা করে)
বৃষ্টিকে আনন্দ বা বেদনার রূপে না দেখে কবি অসীম সাহা দেখেছেন করুণ রূপে। ভয়ের চোখে তাকিয়েছেন বর্ষার এই ধারার দিকে। প্রিয় নারী মাধবীকে তাই বারণ করা- যেন ঝরঝর দিনে বাহিরে না বেরুয়। মাধবীর জন্য কবির মনে কান্না- বর্ষার রূপ, বৃষ্টি কান্নার মতোই-
‘ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না। মাধবী তুষারপাতে
বাইরে যেও না।’ (শহরে, এই বৃষ্টিতে)
সুফিয়া কামাল , রফিক আজাদ, আহম্মদ রফিক, অমিয়সহ ওপার বাংলার বাঙ্গালি কবি কেউ’ই বর্ষার বন্দনা থেকে বিরত থাকেতে পারেননি। পাওয়া যাবে না এমন একজন কবি যে তাঁর কবিদশায় বর্ষা নিয়ে একটি পয়ার লেখেননি, বর্ষাকে উপমা করে লেখেননি একটি ছত্র। এ কালের নবীনতম যে কবি তিনিও উপমা করেছেন বর্ষাকে, গেঁথেছেন কাব্যমাল্য। লিখেছেন-
‘‘এই গ্রীষ্মেও
মুষলধারে কাঁদছে আকাশ;
কান্না প্রনালী কোন ঋতু মানে না।
দিগন্তপাতালে
রন্ধনশালার বিস্তার তার।
এর মাঝে আমি এক
ঋজুরেখ নক্ষত্রবাদি,
এই ক্রন্দনসিম্ফনির
কারুকাঠামো ভেদ করে
শুক-স্বাতী-অরুন্ধতীর
হৃদমহলে যাই;
দেখে আসি
এক একটি নক্ষত্রের
নির্মাণশেষে
তোমার চোখের জল
কত যুগের
বর্ষা হয়ে
ঝুলে থাকে
অনন্ত’ (স্বপ্নমৃত্যুপ্রসারণ, পিয়াস মজিদ.)
সব যুগের সব কবিই নির্মান করেছেন বর্ষা বিষয়ক কবিতা। বর্ষাকে বিষয় করে, বর্ষাকে উপমা করে কবিতায় একেঁছেন বাক্সময় কাব্যকল্পনা । সব কালের সব কবির কাছে বাংলার বর্ষাঋতু- যেন রবীন্দ্রনাথের মতের মতনই এক ‘চিরকালের জিনিস’ হয়ে আছে।

 

জোবায়ের মিলন
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top