সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

দাদন : কবির কাঞ্চন


প্রকাশিত:
২৫ জুন ২০২০ ২২:৫৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৪০

রোমানের জন্মের আগে বিল্লাল সওদাগরের সংসারে সবই ছিল। রোমানের  বাবা, বিল্লালের সওদাগরের ভূঁঞার হাটে বিশাল মুদির দোকান ছিল। চাষের কিছু জমিও ছিল।
এলাকার কেউ কোন বিপদে পড়লে অমনি তিনি তাদের উপকার করতে ঝাপিয়ে পড়তেন। হাটের অন্যসব দোকানে যেখানে কাস্টমার থাকতো না, সেখানে তার দোকানে কাস্টমারের ভীড় থাকতো। সবকিছু খুব ভালোভাবেই চলছিল। হঠাৎ কেউ তার মাথায় নদীতে নৌকা নামানোর বুদ্ধি ঢুকিয়ে দিলো। সেই থেকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়েও তার মাথা থেকে নৌকার ভুত নামানো গেল না। নদীতে নৌকা নামানোর বিষয়ে পরিবারের কারো সমর্থন ছিল না। এ নিয়ে বিল্লাল সওদাগরের বাবা তো এক সপ্তাহ পর্যন্ত তার সাথে কথাই বলেননি।
পরিবারের সকল সদস্যের একটাই কথা ছিল। দোকানের ব্যবসা তো ভালোই চলছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে। কিন্তু বিল্লাল সওদাগর ছিলেন নাছোড়বান্দা। মুখে যা বলবেন বাস্তবে তা করেই ছাড়বেন।


নৌকা তৈরির জন্য দোকানের পুঁজিতে হাত দিলেন না তিনি। যেটুকু জমি আছে তাতে ভালোমতো চাষ করা হয় না। শুধু শুধু পড়ে আছে। বিকেল হলে সেখানে গ্রামের ছোট-বড় ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে। শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া ধীরে ধীরে গ্রামগঞ্জেও পৌছে গেছে। এখন আর মাঠের পর মাঠ পড়ে নেই। খেলাধূলার জন্য অনাবাদী জমিগুলোই ওরা বেছে নেয়।
বিল্লাল সওদাগরের জমিতে ছেলেমেয়েরা নির্ভয়ে খেলতে পারে। তিনি কখনও খেলতে বারণ তো করেন না। মাঝে মধ্যে একটু সময় পেলে খেলার দর্শক হতে ভালোবাসেন। কিন্তু কি আর করার! নৌকা তৈরিতে যে অনেক টাকা লাগবে। তাই মনে পাথর চাপা দিয়ে তিনি সেই জমিটুকু বিক্রি করে দিলেন। নৌকা তৈরির সব সারঞ্জাম আনা হলো। কয়েকজন দক্ষ মিস্ত্রিও আসলো। শুরু হলো নৌকা তৈরির কাজ।
মাত্র একমাসের মধ্যে দুটো নৌকা নদীতে নামবার উপযোগী হলো। বিল্লাল সওদাগর পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করে
মহাধুমধামে নদীতে দুটো নৌকা নামালেন।
মাছ ধরার জন্য অগ্রিম দাদন দিয়ে দশজন জেলে নিয়োগ দিলেন। জালে প্রথম প্রথম বেশ মাছ লেগেছিল। এ নিয়ে তার সে কী উল্লাস! দোকানে কর্মচারী রেখে প্রতিদিন তিনি নদীর ঘাটে গিয়ে বসে থাকতেন।
কিন্তু  তার এই উল্লাস বেশিদিন টিকলো না। সবার জালে প্রচুর মাছ লাগে। শুধু তার জালে মাছ লাগে না। যে মাছ লাগে তা দিয়ে জেলেদের খরচ হয় না। শুধু লোকসান হচ্ছে।

আবার দোকানের দিকে মনোযোগ দিতে রোমানের দাদাসহ পরিবারের সবাই তাকে অনেক করে বোঝালো। কিন্তু তার একই কথা। আজ লোকসান হচ্ছে তো কাল লাভ হবে।

দেখতে দেখতে তার দোকানেও লোকসান শুরু হয়ে গেল। দুই দিকের লোকসানে আর টিকতে পারছিলেন না তিনি। এরিমধ্যে বিল্লাল সওদাগর অনেক ধারদেনা করে ফেলেছেন। পাওনাদারদের জ্বালাতনে প্রায় পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। মাঝে মধ্যে বাড়ি আসতেন। খবর পেয়ে পাওনাদাররা বাড়ি এসে সবার সামনে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতো। বিল্লাল সওদাগর তা মুখ বুঝে সহ্য করতেন। শেষে পাওনাদারদের চাপে টিকতে না পেরে দুটো নৌকাই বিক্রি করে দিলেন।


এরপর আবার দোকানে বসতে শুরু করলেন। কিন্তু দোকানে তেমন মালামাল না থাকায় কাস্টমার খুব কম আসতো। নিয়তির নির্মম পরিহাসে বিল্লাল সওদাগর রাতের আঁধারে নীরবে কেঁদেছেন। শেষমেশ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে বাড়িতে বেকার বসে থাকতে লাগলেন। তার সাথে সাথে পরিবারের সবার মনও দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।
এভাবে কিছুদিন যেতে না যেতে একরাতে তার মুখে হাসি দেখে পরিবারের সবার মনে আবার স্বস্তি ফিরে আসে। বিল্লাল সওদাগর সবাইকে কাছে ডেকে বললেন,
- আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর অলসভাবে ঘরে বসে থাকবো না। আমি ব্রিকফিল্ডের কাজে যাব। শেকু মাঝির কাছ থেকে আমি দশ হাজার টাকা দাদন নিয়েছি। আগামী সপ্তাহে তাদের সাথে আমি কাজে যাব।
বিল্লাল সওদাগরের বাবা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
- তুই কি এই কাজ করতে পারবি, বাবা?
- আমাকে পারতেই হবে, বাবা।
এই কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন বিল্লাল সওদাগর। ঘরের সবাই তার সাথে অঝরে কাঁদতে থাকে।
বিল্লাল সওদাগর সবার কান্না থামিয়ে বললেন,
- আর কোন  কান্না নয়। আমি যে হাতে সারাজীবন মানুষকে দিয়ে এসেছি, সে হাতে কীভাবে চাইতে পারি! তাছাড়া আমার রোমানও বড় হচ্ছে। ওর ভবিষ্যতের জন্য হলেও আমাকে আবার জীবন সংগ্রামে নামতে হবে।

পরের সপ্তাহে বিল্লাল সওদাগর পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। শুরু হয় তার জীবনের কঠিন অধ্যায়। সারাদিন রোদে পুড়ে বিরামহীনভাবে কাজ  করতে লাগলেন। এতো কষ্টের মাঝেও তিনি  কাজে ফাঁকি দিতে চাইতেন না। তার উপর মাঝিসহ অনেকেই তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতো। একসময় এই লোকটার কাছ থেকে তারা সহায়তা পেয়েছে। আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে এই কাজে আসতে হয়েছে।

একটানা চারমাস ব্রিকফিল্ডের কাজ হলো। কাজ শেষে কাজ বাবদ আরো ত্রিশ হাজার টাকা পেয়েছেন। বাড়ি এসে পাওনাদারদের কিছু টাকা পরিশোধ করে স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করলেন। এখন আর তাকে পাওনাদরের জ্বালাতন সহ্য করতে হয় না। রোমানও নিয়মিতভাবে স্কুলে যাচ্ছে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জগতের সব কষ্ট ভুলে যান তিনি।

একদিন সন্ধ্যায় রোমানকে কোলে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে সুখ-দুঃখের  আলোচনা করছিলেন। এমন সময় বাবার চুলে আঙ্গুলের পরশ দিতে দিতে রোমান বলল,
- বাবা, তোমার মাথায় এগুলো কী?
বিল্লাল সওদাগর ইতস্তত করে বললেন,
- ওসব কিছু না, বাবা। মাথার উঁচুনিচু অংশ।
রোমান নিজের মাথায় হাতড়িয়ে দেখে অবাক হয়ে বলল,
- কৈ আমার মাথায় তো তোমার মতো কোন উঁচুনিচু অংশ নেই!

ততক্ষণে বিল্লাল সওদাগরের মা দৌড়ে এসে ছেলের মাথায় হাতড়িয়ে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন। মাথার বিভিন্ন স্থানে বড় বড় ফোঁস্কা পড়ে গেছে। মাথার কোন কোন অংশের চুলও অসম্ভব হারে কমে গেছে।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
পাশ থেকে বিল্লাল সওদাগরের বাবা বললেন,
- এভাবে কাঁদছো কেন? আমার বিল্লালের কী হয়েছে?
- আমার কলিজার টুকরার মাথাটা ধরে দেখো। পুরো মাথায় ফোস্কা পড়ে গেছে। মাথার অনেক জায়গায় চুলও উঠে গেছে।
এমন কাজ আর করতে হবে না, বাবা। প্রয়োজনে  না খেয়ে থাকবো। তবু তোকে এই কষ্টের কাজে আমি যেতে দেবো না।

বিল্লাল সওদাগর মাথানিচু করে নিশ্চুপ বসে রইলেন।
পাশ থেকে তার বাবা আবার বললেন,
- এত কষ্টের কথা কখনও তো বলিসনি, বাবা।
- না বাবা, প্রথম প্রথম কষ্ট লাগলেও পরে তা সয়ে গেছে। তোমরা বেশি চিন্তা করছো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

এভাবে মাসখানেক সময় কেটে গেল। হাতের টাকাও ফুরিয়ে গেছে। আবার ধারদেনা করে চলতে হচ্ছে। এরিমধ্যে ইলিশ মাছের মৌসুম চলে এসেছে। জব্বার মাঝির অধীনে অনেকে নাম দিয়ে দাদন নিচ্ছে। খবর পেয়ে বিল্লাল সওদাগরও দাদন নেবার চিন্তা করছেন।
জব্বার মাঝি সুবিধার লোক নন। ইলিশ মাছের মৌসুম এলে তার তৎপরতা বেড়ে যায়। দেখে দেখে সমাজের অসহায় মানুষদের নূন্যতম মজুরি ধরে দাদন দিয়ে থাকেন। এরপর সময়মতো বিভিন্ন নৌকায় তুলে দেন। পুরো মৌসুমে তাদের নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বেড়িবাঁধ এলাকায় জাল বুননের মধ্য দিয়ে তাদের অবসরে সময় কাটে। এরিমধ্যে কেউ কেউ কাজ থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু জব্বার মাঝির কাছ থেকে নিস্তার পায় না। তাদের থেকে হয় দ্বিগুণ ক্ষতিপূরণ নিয়ে নেবে। নয়তো জোর করে ধরে বেঁধে কাজে নিয়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে বিল্লাল সওদাগর একাকী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। আর কোন উপায় না দেখে বিল্লাল সওদাগরও দাদনের জন্য তার কাছে গেলেন। জব্বার মাঝি প্রথমে তাকে কাজে নিতে চাননি। এত কষ্টের কাজ পারবে না ভেবে নিতে চাইছিলেন না। শেষমেশ বিল্লাল সওদাগরের অনুরোধে রাজি হয়ে দাদন হিসেবে তাকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিলেন।

শনিবার পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নৌকায় উঠলেন। চট্টগ্রামে এসেই প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে প্রতিদিন মাছ ধরার কাজে মোহনায় যেতে হয়। নদীতে প্রচুর মাছ পায় তারা। সারাদিন কঠোর খাটুনি করে মাছ ধরে তীরে এসে মহাজনের কাছে জমা দিতে হয়। নিজেদের খাওয়ার জন্য এক/দুইটা মাছ চেয়ে নিতে হয়। মহাজনের কাছে জমা দেয়ার আগে অন্যান্য খালাসিরা দু/চারটি মাছ লুকিয়ে রাখলেও বিল্লাল সওদাগর তা করেন না। তার নৌকার মাঝি তা লক্ষ্য করেন।

এভাবে মাস দুয়েক কেটে গেল। একদিন নদীতে যাবার প্রস্তুতি চলছে। বিল্লাল সওদাগর একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের এককোণে বসে কাতরাতে লাগলেন। মাঝি খবর পেয়ে এসে তাকে কিছু ওষুধপাতি কিনে দিয়ে রুমে রেখে নদীতে চলে যান।  এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। দিনেদিনে তার অসুস্থতা আরো বাড়ছে। ওদিকে নিয়মিত নদীতে যাচ্ছে না বলে মহাজন
মাঝির ওপর চড়াও হচ্ছে। শেষমেশ অসুস্থ শরীরে তাকে মাছ ধরতে আসতে হয়।
পরদিন তার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ দেখে মাঝি কিছু টাকা ও কয়েকটি মাছ দিয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
বাবার হাতে মাছ দেখে রোমান খুব খুশি হয়। সে প্রাণ ভরে হাসে। ছেলের নিটোল হাসিতে  বিল্লাল সওদাগরের রুগ্নদেহের সকল কষ্ট মন থেকে মুহূর্তে সরে যায়।
পরিবারের সাথে কয়েকদিন কাটানোর পর একটু সুস্থ্যতার দিকে  এলে জব্বার মাঝি তাকে আবার কাজে ফিরে যাবার তাগাদা দেয়।
বিল্লাল সওদাগর কিছু টাকা চাইলে জব্বার মাঝি উচ্চবাক্যে বললেন,
- কাজ করেছো কয়দিন? আবার টাকা চাও। ওখানে গিয়ে কাজের সময় অসুস্থ হয়ে রুমে শুয়েছিলে। আমার কাছে সব খবর আছে। মহাজন বলেছেন, তোমরা নাকি ঠিকমতো মাছও জমা দিতে না। মাছ লুকিয়ে চুরি করে বিক্রি করতে। সবাই চোরের গোষ্ঠী। তাছাড়া তোমার খাওয়া খরচ আর চিকিৎসা মিলে যা খরচ হয়েছে তাতে তুমি আরো দেনা আছো।
বিল্লাল সওদাগর কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
- আপনি এসব কি কথা বলছেন! আমি তো কোনদিন কাজে ফাঁকি দিইনি। অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। একটা একটা করে মাছ মহাজনের লোকজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আপনি আমাকে চোর বলছেন!
- ঠিক আছে, আর ন্যাকামো করতে হবে না। আগামীকাল রেড়ি থাকবে। কালই কাজে যেতে হবে, বুঝলে?
- জ্বি, কিন্তু আমি তো এখনও------।
জব্বার মাঝি ধমকের সুরে বললেন,
- তোমার আর কোন কথা শুনতে চাই না। কালকে যেন বেঁধে নিতে না হয়।
এই কথা বলে জব্বার মাঝি চলে যায়।

পরদিন সকালে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিল্লাল সওদাগর  ঘর থেকে বের হন। কিছুপথ যেয়ে আবার ঘরে ফিরে আসেন। রোমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে দু'চোখের জল ছেড়ে দেন। রোমানের মা কাছে এসে আঁচল দিয়ে স্বামীর চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন,
- তোমার কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?
- আজ আমার কেমন যেন লাগছে, সাথী। মনটা খুব ভার ভার লাগছে।
- তাহলে আজ কাজে না গেলে হয় না?
- না, ও কথা বলো না। এখন জালে ভালো মাছ ধরা পড়ছে। না গেলে মহাজনের লোকরা বাড়ি এসে ধরে নিয়ে যাবে। তাতে মান-সম্মান যা আছে তাও হারাতে হবে। আমি চলে যাচ্ছি। রোমানকে দেখে রেখো।
- আচ্ছা।
এরপর বিল্লাল সওদাগর চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
চট্টগ্রামে এসে আবার নদীতে মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে আরো কিছুদিন কেটে যায়।

আজ সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিল্লাল সওদাগরের নৌকার মাঝি তার দলবল নিয়ে মাছ ধরতে নদীর দিকে ছুটছেন। পছন্দমতো স্থানে জাল ফেলে নৌকায় বসে আছে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার নামছে। সেই সাথে আকাশেও বেশ মেঘ জমেছে। সময় যতোই গড়াচ্ছে ততোই আকাশে মেঘের গর্জন বাড়ছে। আকাশে হঠাৎ হঠাৎ বিজলী চমকাচ্ছে। উত্তাল ঢেউয়ে তাদের নৌকা বাতাসের সাথে এদিকওদিক দুলছে। তারা তাড়াতাড়ি জাল গোছাতে লাগলো। অন্যদিনের তুলনায় আজ জালে প্রচুর মাছ লেগেছে। মাঝি সবাইকে সাহস দিতে গিয়ে বললেন,
- একটুপর বাতাস কমে যাবে। তোমরা নৌকায় ভালোভাবে মাছ তোল।
মাঝির নির্দেশে সবাই আবার মাছ তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তখনও নৌকার ইঞ্জিন রুমে বসে বসে চিৎকার করে কাঁদছে কালুর বাপ। খুব ভীতু স্বভাবের লোক। একটু ঢেউ দেখলে ভয় পেয়ে যায়। বিল্লাল সওদাগর মাঝির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার কাছে এসে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। বিল্লাল সওদাগরের কথা শোনে কালুর বাপ তার কান্না থামিয়ে স্বাভাবিক হন। ওদিকে জাল সম্পূর্ণরূপে নৌকায় তোলা হলো। মাছে নৌকা ভরে গেছে। বিল্লাল সওদাগর ইঞ্জিন রুম থেকে বের হয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছেন।
চারদিকে ঘোর অন্ধকার। আশপাশের ডিঙি নৌকাগুলোও দেখা যাচ্ছে না। ধেয়ে আসা ঢেউয়ের জলরাশিতে ভিজে একাকার হয়ে অন্যান্য খালাসিদের কাছে চলে আসেন।

এবার তীরে ফেরার পালা। মাঝ দরিয়ায় হঠাৎ দমকা হাওয়া বইতে লাগলো। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে সামনের পথ দেখা যাচ্ছে না। একবার নৌকা বেশ উপরে উঠে যাচ্ছে। আবার খুব নিচে নেমে যাচ্ছে। একেকবার মনে হচ্ছে নৌকা তলিয়ে যাচ্ছে। সবাই ভয়ে আল্লাহ, রাসূলকে স্মরণ করে জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলো। হঠাৎ জোরে একটা শব্দ হলো। মাঝি টর্চলাইট মেরে সবাইকে লক্ষ্য করলেন। সবকিছু ঠিকমতো আছে। এবার ইঞ্জিন রুমের দিকে টর্চলাইট মারলেন। সেখানে কেউ নেই। এরপর পুরো নৌকা খোঁজে কালুর বাপকে আর পাওয়া গেল না। সবাই ভয় পেয়ে গেল।
আবার যাত্রা শুরু করলো। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা সময় কেটে গেলো। বাতাসের তান্ডব যেন সময়ে সময়ে বাড়ছে। আবছা আলোয় দূর থেকে ঘাটের আলো চোখে পড়ছে। আশায় বুক বেঁধে সবাই জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলো। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তাদের নৌকাটি উল্টে যায়। সবাই যার যার প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে। উত্তাল ঢেউ আর বাতাসের 'শো শো' শব্দে তাদের বাঁচার আর্তচিৎকার কারোর কানে পৌঁছছে না। বাঁচার আকুতিতে যে যার মতো সাঁতরাতে লাগলো।
রাতের আঁধার কেটে যেতে না যেতে মেঘনা নদীকূলের বাতাস স্বজন হারানো মানুষের গগন বিদারী আর্তনাদে ক্রমশ ভারী হয়ে উঠেছে।


কবির কাঞ্চন 
গল্পকার, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top