সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বঞ্চিত উপেক্ষিত বীর নায়কেরা : শিবব্রত গুহ


প্রকাশিত:
৩০ জুন ২০২০ ২২:৩৭

আপডেট:
২ জুলাই ২০২০ ২২:২১

 

ভারতবর্ষ হল এই বিশ্বের মধ্যে এক মহান দেশ। এই দেশের ঐতিহ্য বরাবরই অসাধারণ। এই দেশের ইতিহাসের এক বড় জায়গা জুড়ে আছে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরগাঁথা। ব্রিটিশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এই দেশের মানুষ পেতে চেয়েছিল স্বাধীনতা। তাই, তারা ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে
পড়েছিল স্বাধীনতা আন্দোলনে। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই, ভারতমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে চিরকালের মতো মুক্তি দেওয়া।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক বীর সেনানী তাঁদের প্রাপ্য সন্মান আজো পাননি। তাঁরা রয়ে গেছেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবদানের কথা আমি এখানে আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

প্রথমেই আসি, ভারতমাতার বীর সন্তান বিরসা মুন্ডার কথায়। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালের
১৫ ই নভেম্বরে। তাঁর সাহস ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন একজন মুন্ডা আদিবাসী। তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও বটে। তৎকালীন বিহার বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচির উলিহাতু হয়েছিল তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা সুগনা মুন্ডা, মা ছিলেন করমি হাতু। ছোটবেলা থেকেই তিনি সমাজের প্রতি ও ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা অত্যাচারিত হওয়া মানুষদেরকে নিয়ে খুব চিন্তা করতেন।
তিনি ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা পুরুষ। তাঁর রক্তে ছিল স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটা আকর্ষণীয় শক্তি ছিল, তিনি খুব সহজেই চারপাশ বুঝে নিতে পারতেন।তিনি লোককে খুব সুন্দর ভাবে বোঝাতে পারতেন। তাঁর যে - কোন বিষয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল প্রশংসাতীত।

ছবিঃ বিরসা মুন্ডা

ব্রিটিশদের অত্যাচারে, অতিষ্ঠ হয়ে, বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে, ১৮৯৯ - ১৯০০ সালে, সংগঠিত হয়েছিল বিখ্যাত " মুন্ডা বিদ্রোহ "। এই বিদ্রোহকে মুন্ডারি ভাষায় বলা হয় ' উলগুলান '। যার অর্থ হল " প্রবল বিক্ষোভ "। এই মুন্ডা বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল। বিদ্রোহের পরে, বিরসা মুন্ডা সহ তাঁর শতাধিক
সাথীকে গ্রেপ্তার করেছিল ব্রিটিশ সরকার। বিচারে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। ফাঁসির আগের দিন, রাঁচির জেলের ভেতরে, খাদ্যে বিষ প্রয়োগের ফলে, বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়েছিল।
তাঁর সাথে ধৃত অন্যান্য দুইজনের ফাঁসি, ১২ জনের দ্বীপান্তর ও ৭৩ জনের কারাবাস হয়েছিল। বিরসা মুন্ডার মৃত্যু হয়েছিল ১৯০০ সালের ৯ ই জুন। তাঁর সাথীদের কাছে বিরসা মুন্ডা পরিচিত ছিলেন " বিরসা ভগবান " নামে।

সিধু ও কানু ছিলেন দুই ভাই। তাঁদের পুরো নাম ছিল সিধু মুরমু ও কানু মুরমু। এরা দুজনেই ছিলেন
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সেনানী। এদের বীরত্বের কোন তুলনাই হয় না। এনারা পারতেন, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। এনারা ভয়কে করেছিলেন জয়।
সিধু ও কানু - এনারা দুইজনেই ছিলেন বিখ্যাত " সাঁওতাল বিদ্রোহ" - এর নেতা। যে বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে করেছিল প্রচন্ড আঘাত। সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৮৫৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ আমলে, স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের ধারাবাহিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিল সাঁওতালেরা।

ছবিঃ সিধু মুরমু ও কানু মুরমু


তারা এই অত্যাচারে প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। সাঁওতালেরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। তাঁদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল সিধু ও কানু।১৮৫৫ সালের ৩০ শে জুন শুরু হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। এই বিদ্রোহ শেষ হয়েছিল ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে। সাঁওতালেরা তীর - ধনুক নিয়ে বীরত্বের সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে করেছিল লড়াই। এই বিদ্রোহে ব্রিটিশ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সিধু ও কানুর বীরত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিল তখন ভারতবাসী। সিধু ও কানুকে হত্যা করার পরে, সাঁওতাল বিদ্রোহ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যায়। সিধু ও কানুর বোন ফুলমণির লাশ উদ্ধার হয়েছিল রেললাইনের ধার থেকে। সিধু ও কানু নিজের জীবন দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। তাঁরা ভারতমাতাকে ভালোবেসেছিলেন। ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের তাঁরা দিয়েছিল উচিত জবাব। সিধু ও কানুর বীরত্বের কাহিনী আজো অমর হয়ে আছে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আর একজন নায়কের নাম হল তিতুমীর। এনার আসল নাম ছিল সৈয়দ মীর নিসার আলী। ইনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭৮২ সালের ১৭ ই জানুয়ারি। তিনি যুক্ত ছিলেন ওয়াহাবী আন্দোলনের সাথে। তাঁর বাবার নাম ছিল সৈয়দ মীর হাসান আলি আর মায়ের নাম ছিল আবিদা রোকেয়া খাতুন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর গ্রামের বিদ্যালয়ে।

ছবিঃ তিতুমীর
তিনি বাংলা, আরবি ও ফার্সী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিতুমীর তাঁর গ্রামের চাষীদের সাথে নিয়ে, জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন স্বাধীন চেতা পুরুষ। স্বাধীনতা উদগ্র বাসনা ছিল তাঁর মনে। তিতুমীরের অনুগামীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। বাড়তে বাড়তে তা একসময় পাঁচ হাজারে গিয়ে ঠেকে। ১৮৩১ সালের ২৩ শে অক্টোবর, বারাসাতের কাছে, বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে, তাঁরা তৈরি করেছিলেন বাঁশের কেল্লা তিতুমীরের নেতৃত্বে। বাঁশ ও কাদা দিয়ে এই কেল্লা
নির্মাণ করা হয়েছিল। তিতুমীরের তৈরি এই বাঁশের কেল্লা ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। তিতুমীর কিছুতেই ভয় পেতেন না।
তিতুমীর বর্তমান ২৪ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার অধিকার নিয়ে, সেখানে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী, ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার বরণ করেছিলেন পরাজয়। উইলিয়াম হান্টার বলেন, ওই বিদ্রোহে, প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক সেনা তিতুমীরের হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন।
অবশেষে, ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর, ব্রিটিশ সৈন্যরা, তিতুমীরকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে।এই অবস্থায়, তিতুমীর ঘোষণা করেছিলেন স্বাধীনতা। তিনি বলেছিলেন, " ভাইসব, একটু পরেই, ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার- জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না।
দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এদেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।"
কর্নেল হার্ডিং- এর নেতৃত্বে, ব্রিটিশ সেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের আক্রমণ করেছিল।তাতে, তিতুমীরের পরাজয় ঘটেছিল। তিতুমীর ও তাঁর ৪০ জন সহচর হয়েছিলেন শহীদ দেশের জন্য।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বঞ্চিত উপেক্ষিত বীর নায়কদের মধ্যে বিরসা মুন্ডা, সিধু কানু ও তিতুমীর ছিলেন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এরকম আরো আরো অনেকে রয়েছেন। তাঁদের সবাইকে জানাই আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।

( তথ্য সংগৃহীত)


শিবব্রত গুহ
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top