সিডনী শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১

বিজ্ঞানীর বেশে এ কোন বিপ্লবী? : তন্ময় সিংহ রায় 


প্রকাশিত:
৫ জুলাই ২০২০ ২১:১৬

আপডেট:
১১ জুলাই ২০২০ ২১:৩৮

ছবিঃ প্রফুল্লচন্দ্র রায়

 

১৮৬১ সালের ২ আগষ্ট, অবিভক্ত বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন পিতা হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবীর আদরের তৃতীয় শিশুপুত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায় ওরফে ফুলু।

ছয় সন্তানের মধ্যে অন্যতম ফুলু ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিলেন বিশেষ অনুরক্ত!

পিতা হরিশচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত স্কুল থেকে অধ্যয়ন জীবন শুরু করে ১৮৭২ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেও, দুর্ভাগ্যবশতঃ বিশেষ শারীরিক অসুস্থতা প্রফুল্লের সে পথে এসে দাঁড়ায় সাময়িক বাধা হয়ে।

এমতাবস্থায়, অগত্যা গ্রামের বাড়িতে এসে  দুবছর পিতার গ্রন্থাগারের নানান বইপত্র যথাসাধ্য পড়া সম্পূর্ণ করার পর ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় কলকাতায় ফিরে ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। 

পড়াশোনার প্রতি গভীর আগ্রহ, নিষ্ঠা, মনযোগীতা ও সু-অধ্যাবসায়ের ফলস্বরূপ চার বছর পর অর্থাৎ ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সেই স্কুল থেকেই তিনি 'স্কুল ফাইনাল তথা প্রবেশিকা পরীক্ষা'য় উত্তীর্ণ হন প্রথম বিভাগে।

এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত 'মেট্রোপলিটন' (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) কলেজ থেকে ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে 'কলেজ ফাইনাল'(এফ.এ)পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হয়ে 'প্রেসিডেন্সী কলেজ' ও সেখান থেকে 'গিলক্রিস্ট স্কলারশিপ' নিয়ে স্কটল্যান্ডের 'এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়' থেকে তিনি পাশ করেন বি.এসসি।

পরবর্তীকালে, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই 'ডি. এসসি' ডিগ্রী লাভের উচ্চাশায় প্রফুল্লচন্দ্র রায়, 'কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ' বিষয়ের উপর দুবছরের অক্লান্ত ও নিরলস সাধনার মাধ্যমে সফল গবেষণায় লাভ করেন শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রসহ 'পি.এইচ.ডি ডিগ্রী' ও হোপ পুরষ্কার সম্মান! 

বলাবাহুল্য, এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'ডক্টর অব সায়েন্স' উপাধি অর্জন করেন একজন দ্বিতীয় বাঙালী ব্যক্তি হিসাবে।

এর আগে আর একজন বাঙালিই অর্জন করতে পেরেছিলেন এই উপাধি, যিনি ছিলেন সরোজিনী নাইড়ুর বাবা ডঃ অঘোর নাথ চট্টোপাধ্যায়।

সামান্য কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সহজেই মারকিউরাস নাইট্রাইট নামক অপেক্ষাকৃত স্থায়ী এই রাসায়নিক যৌগ তৈরির এমন এক উপায় তিনি উদ্ভাবন করেছিলেন যেটি ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত বিস্ময় ও ঈর্ষার একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  

ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ তাঁকে ভূষিত করেন 'মাস্টার অব নাইট্রাইটস্' আখ্যায়। তাঁর প্রথম গবেষণার ফলটি বের হয় 'জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল'-এ। প্রখর প্রতিভাধর এই মহান বিজ্ঞানীর কাজের স্মরণে খ্যাতনামা বাঙালী কবি, ছড়াকার ও ছন্দের যাদুকর 'সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত' উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তাইতো প্রশংসা করে বলে উঠেছিলেন যে, 'বিসম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়াছে বিয়া, বাঙালির নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া!' এরপর, ইউরোপের উচ্চাকাঙ্ক্ষীত শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ও দীর্ঘ ২৪ বছর অধ্যাপনা করেন প্রেসিডেন্সী কলেজে। অধ্যাপনা চলাকালীনও তিনি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে চালিয়ে যান নিত্যনতুন গবেষণা কর্ম।

ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে তা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন স্যর আচার্য পি.সি রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট ছাড়া আর কিছুই নয়, সে হাড় যে কিসের তা আর বোঝার ও জানার কোন উপায় থাকতোনা। এমনই চলতো তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী ও দূরদর্শীসম্পন্ন অধ্যাপনা।  

অসাধারণ বাচনভঙ্গি দ্বারা ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই ও সকল ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন উদারপন্থী।

ছিপছিপে গড়নের এই শিক্ষকের হাত ধরেই এদেশে হয়েছে প্রায়োগিক বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত।

জমিদার ও তথাকথিত উচ্চ হিন্দু বংশের সন্তান হওয়া সত্বেও কখনও কোনপ্রকার গোঁড়ামি তাকে পারেনি স্পর্শ করতে।

বাবার কাছ থেকে শেখা স্বাভাবিক শিক্ষাগত ঔদার্যই তাঁকে পরবর্তীতে পরিণত করেছিল একজন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক ও প্রণিধানযোগ্য ব্যক্তিত্বে! দেশীয় ভেষজকে কেন্দ্র করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন তাঁর নিজ বাসভবন থেকেই। তাঁর এই গবেষণাস্থল ও মহৎ অবদানেই ভারতবর্ষের বুকে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী শিল্পায়নের মাধ্যমে বাঙালি জাতি এগিয়ে যেতে শুরু করে তাঁর-ই প্রতিষ্ঠিত 'বেঙ্গল কেমিক্যালস এণ্ড ফার্মাসিউটিক্যালস'-এর হাত ধরে। নিজেকে ও বাঙালি জাতিকে সমগ্র বিশ্বে তিনি সুপরিচিত করেছেন 'মারকিউরাস নাইট্রাইট' নামক সম্পূর্ণ নতুন এক রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কারের বিপ্লবের মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই কিন্তু খুঁজে বের করে এনেছেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস!

তাঁর মূল পরিচয় বিজ্ঞানী হিসাবে হলেও এই পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি এক সময় হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবী। স্বদেশী আন্দোলনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রথিতযশা এই ব্যক্তি। পরনে ধুতি ও কালো কোট, অবিন্যস্ত চুলের উদাসীন বেশভূষায় আবৃত অথচ দূরদর্শী, কর্মচঞ্চল ও গহীন দেশপ্রেমে আবদ্ধ এই মানুষটি এমনকি একসময় অস্ত্র কেনার জন্যেও গোপনে অর্থ সাহায্য করতেন বিপ্লবীদের। 

তাঁর এ হেন বিপ্লবী সত্ত্বাকে দেখে ব্রিটিশ সরকারের এক গোয়েন্দা, একটি প্রতিবেদনে তাঁকে উল্লেখ করেছিলেন 'বিজ্ঞানীর বেশে বিপ্লবী' বলে। 

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন বর্তমান ভারতের কলকাতায়, প্রখ্যাত বাঙালী এই মহান বিজ্ঞানসাধক অবশেষে ৮২ বছর বয়েসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

রসায়নবিদ্যার জনক ও বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসুর সহকর্মী ডঃ আচার্য প্রফুল্ল রায় আপামর মানব হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে সমগ্র মানব সভ্যতা নিশ্চিহ্নের আগ পর্যন্ত।

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top