সারকাদিয়ান ছন্দের নোবেল জয় : নাসীমুল বারী
প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২০ ২১:২৬
আপডেট:
৬ জুলাই ২০২০ ২১:৩২

সারকাদিয়ান ছন্দ- মানুষের শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের অংশ। মানুষের শরীর বিজ্ঞানের মহাবিষ্ময়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনেও মানুষের শারীরিক অনেক বৈজ্ঞানিক নির্দেশনাও রয়েছে। সূরা নাবার নয়, দশ ও এগার নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের ঘুমকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। রাতকে করেছি আবরণ। দিনকে করেছি জীবিকা অর্জনের সময়।” এখানেও দিনের কাজ আর সেই কাজের ক্লান্তি দূর করার জন্য রাতের নীরবতায় ঘুম দিয়েছে আমাদের শরীরবৃত্তীয় ধারাবাহিকতায়। ঠিক চিকিৎসাবিজ্ঞানও বলে ঘুম আর জাগরণচক্র শরীরের একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। এই জৈবিক প্রক্রিয়ার সাথেই সারকাদিয়ান ছন্দের যোগ।
‘সারকাদিয়ান ছন্দ’ (Circadian Rhythm) মানব শরীররে একটি প্রাকৃতিক, অভ্যন্তরীণ জৈবিক প্রক্রিয়া। সারকাদিয়ান শব্দটি লাতিন ‘সার্কায়’ (Circa) থেকে এসেছে যার অর্থ ‘কাছাকাছি’ বা ‘প্রায়’ এবং ‘ডায়ম’ (Diēm) অর্থ ‘দিন’। তাই ‘সারকাদিয়ান’ অর্থ ‘প্রায় পুরোদিন’। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মৌসুমী এবং বার্ষিক ছন্দের মতো জৈবিক অস্থায়ী ছন্দগুলির প্রথাগত অবস্থানকে ক্রনবায়োলজি বলা হয়। এর মধ্যে ২৪ ঘন্টা দোলনযুক্ত প্রক্রিয়াগুলিকে সাধারণত দৈনিক ছন্দ বলা হয়। এমন দৈনিক ছন্দে ঘুম ও জাগরণের চক্র থাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই দৈনিক ছন্দই ‘সারকাদিয়ান ছন্দ’ হিসেবে পরিচিত। একে আবার বায়োলজিক্যাল ঘড়িও বলে। দিনের ২৪ ঘণ্টা সময়ে ঘুম ও জাগরণ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে সারকাদিয়ান ছন্দ। সারকাদিয়ান ছন্দের বিপর্যস্থতায় ঘুম ও জাগরণের সমস্যা হয়। ঘুমের ব্যাধির সৃষ্টি হয়। ঘুমের ব্যাধিগুলোর একটি সারকাদিয়ান ছন্দের বিপর্যস্থতা বা জেট ল্যাগ।
‘জেট ল্যাগ’ (Jet lag) হলো আর এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় অবস্থা। জেট ল্যাগ দীর্ঘ-দূরত্বের দ্রুত পরিবহণজনিত ভ্রমণ দ্বারা সৃষ্ট দেহের সারকাদিয়ান ছন্দগুলিতে পরিবর্তন ঘটায়। মনে করি কেউ ঢাকা থেকে রিয়াদ, অর্থাৎ পূর্ব থেকে পশ্চিমে ভ্রমণে যাত্রা করছেন। মনে হবে স্থানীয় সময় থেকে তিন ঘন্টা পরে ছিল। আবার রিয়াদ থেকে ঢাকা, অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাত্রা করছেন, এমন সময়কে মনে করছেন যেন সময়টি স্থানীয় সময়ের চেয়ে তিন ঘন্টা আগে। প্রতিটি সময় অঞ্চলকে একদিনের সময়সীমা ধরে নিয়ে যাত্রীর পুরোপুরি নতুন টাইম জোনের সাথে সামঞ্জস্য হতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। মানবদেহের কোষ কীভাবে সময় হিসাব করে, তা দেহতত্ত্বের একটি অন্যতম মৌলিক বিষয়। ফলে জীবজগৎ পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়। দিন ও রাতের পরিবর্তনে আমাদের আচরণ ও শারীরিক স্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নতুন টাইম জোনের সাথে ঘুম ও জাগরণের চক্রটি পুরোপুরি সামঞ্জস্য হওয়ার বা খাপ খাওয়ার আগের শারীরবৃত্তীয় অবস্থাটাই ‘জেট ল্যাগ’ অবস্থা। জেট ল্যাগ অবস্থার সময়ে সারকাদিয়ান ছন্দের বিপর্যয় ঘটে। ঘুম ও জাগরণের সমস্যা হয়। জেট লেগ বিশেষত বিমান সংস্থাগুলি, বিমানের ক্রু এবং ঘন ঘন বিমান ভ্রমণকারীদের একটি সমস্যা।
আগেই বলা হয়েছে রাতের সাথে আমাদের শরীরের সরাসরি সম্পর্ক আছে। আলোর ফোটন কণা আমাদের চোখের রেটিনায় গিয়ে পড়ে। তা সিগন্যাল আকারে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে পৌঁছায়। ওই বিশেষ নিউরনগুচ্ছ মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের অন্যতম প্রভাবক। এই গ্ল্যান্ড থেকে মেলাটনিন হরমোন তৈরি হয়। এই মেলাটোনিন স্বাভাবিকভাবে সূর্যাস্তের সময় তৈরি শুরু হয়ে মাঝরাত নাগাদ তুঙ্গে পৌঁছায়। এই মেলাটোনিন হরমোনের কাজ হচ্ছে আমাদের ঘুম-জাগরণের বৃত্ত, শরীরের অধিক তাপ কমানো, বিপাক প্রক্রিয়া বা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ— এই সব ঠিক রাখা। সারকাদিয়ান ছন্দের বিপর্যয় অর্থাৎ ‘জেট ল্যাগ’ অবস্থায় মেলাটনিন হরমোন তৈরিতে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি হয়।
জেট বিমানের আগমনের আগে মানুষের জন্য একটানা খুব বেশি দূরত্ব ও দ্রুত ভ্রমণ করা অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু জেট বিমানে দীর্ঘ-দূরত্বের ভ্রমণ দ্রুত হয় বলে এ সমস্যায় ‘জেট ল্যাগ’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘বিজ্ঞানের একদম মৌলিক বিষয় হলো দুটি স্থানের মধ্যে সময়ের পার্থক্য যত বেশি হবে এবং পশ্চিমের বদলে যত পূর্ব দিকে যাওয়া যাবে, মানুষ তত বেশি জেট ল্যাগ অনুভব করবে।’ জেট ল্যাগ অবস্থায় বিমান যাত্রীদের ঘুমের ধরন, মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা ও খাবার গ্রহণের ধরন ইত্যাদি নানা প্রভাব পড়ে। তবে একেক জনের জেট ল্যাগসংক্রান্ত অনুভূতি একেক রকম।
মানবদেহের এই অন্তর্নিহিত বায়োলজিক্যাল ঘড়ি ‘সারকাদিয়ান ছন্দ’ নিয়ন্ত্রণের নেপথ্যে অণুগুলো কীভাবে কাজ করে। মানবদেহের কোষ কীভাবে সময় হিসাব করে- এই বিষয়গুলো আবিষ্কারের কৃতিত্ব তিন বিজ্ঞানীর। তারা হলেন- ইউনিভার্সিটি অব মাইনের শিক্ষক ‘জেফরি সি হল’, ব্রান্ডেইস ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদ্বয় ‘মাইকেল রোসবাশ এবং মাইকেল ডব্লু ইয়ং’। তাদের মৌলিক ও অনন্য এই আকিষ্কার ২০১৭ সালে জীববিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয় করে।
বিষয়: নাসীমুল বারী
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: