সিডনী মঙ্গলবার, ৭ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১

শেফালিকা : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২০ ২৩:০৪

আপডেট:
৭ জুলাই ২০২০ ২৩:০৭

 

প্রকৃতিতে ভরসন্ধ্যা। স্বামীর হাতে মার খেয়ে শেফালি ঘরের ভেতরে গুমরে মরছে। স্বামীকে প্রতিহত করতে গিয়ে সে স্বামীর কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে। এখন তার নিজের ভেতরে অনুশোচনা কাজ করছে। সে তার স্বামীকে মারতে চায়নি। কেমন করে কী যে হয়ে গেল। সারাজীবন মা-চাচিদের কাছে শুনে এসেছে স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত। আর আজ সে কিনা নিজের স্বামীর কপাল ফাঁটিয়ে দিলো? কীভাবে পারল সে? গ্রামের একজন সাধারণ মেয়েকে নিয়ে এই গল্প। যে লেখাপড়া শিখতে চেয়েছিল। মানুষের মতো মানুষ হতে চেয়েছিল। অল্প বয়সে তার বিয়ে হওয়ায় লেখাপড়ায় ইতি টানতে হয়। সে সংসার করতে চেয়েছিল। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু এই সমাজ এই সংসার তার দাবি দাওয়া কিছুই মানে নি। শেফালির জীবনকাহিনি নিয়ে গল্প শেফালিকা।

জামাল শক্ত সামর্থ্য একজন পরিণত পুরুষ। লেখাপড়া শেখেনি। বাবা-মা বেঁচে নেই। আপন বলতে আছেন একমাত্র ফুপু। বাবার রেখে যাওয়া জমি-জিরেত আছে। মাঠে হাল চাষসহ ক্ষেতে খামারের সকল কাজ করার ক্ষমতাও তার আছে। আর আছে বলিষ্ঠ পুরুষত্ব। মানে গায়ে গতরে লম্বাচওড়া একজন পুরুষ মানুষ সে।

শেফালি লেখাপড়া করতে পেরেছে অল্পবিস্তর। প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুলের কয়েক ক্লাস পার করেছে সে। বয়স তেরো পেরিয়ে চৌদ্দর চৌকাটে পা। শরীরটা তার চকচকে এবং বাড়ন্ত। আশপাশের মানুষের সুদৃষ্টি কুদৃষ্টি দুটোই ঠিকরে পড়ে তার কচি শরীরে। শেফালি কিছু বোঝে না। সুদৃষ্টি, কুদৃষ্টিÑ সে আবার কী?

শেফালি দোড়ঝাপ করে। বাড়ির উঠোনে। স্কুলের আঙিনায়। সে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে ওঠে। রেজাল্ট বেশ ভালো। শিক্ষকদের সুদৃষ্টি শেফালিকে ঘিরে।

শেফালি আরও পড়বে। আরও বড় হবে। বুকের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট আশা দানা বাঁধে। স্কুলের বাড়তি বই ও পড়ার সাথে সাথে শরীরটাও এখন বাড়ন্ত। পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের কেউ কেউ শেফালির দিকে সুদৃষ্টিতে তাকায়। বাবা-মাকে পরামর্শ দেয় মেয়ে বড় হয়েছে তাকে বিয়ে দিয়ে দাও। বাবা-মা সম্বিত ফিরে পায়। তাইতো মেয়ে বড় হয়েছে। তাকে বিয়ে দিতে হবে।

শুরু হলো পাত্র খোঁজা। সম্বন্ধ এলো আশপাশের গ্রাম থেকে। কোনো কোনো পাত্রপক্ষ শেফালির বাবা গরিব বলে নাক শিটকালো। কেউ বা পণ দাবি করল। কোনো কোনো ছেলের বাবা-মায়ের আপত্তি মেয়ে লেখাপড়া শিখেছে, সে সংসারী হবে না। সংসারের সুখ নষ্ট করবে।

অবশেষে চুয়াডাঙ্গার খয়েরহুদা গ্রামের এক কৃষক পরিবারের ছেলে জামাল হোসেনের সাথে বিয়ে ঠিক হলো। বন্ধ হলো শেফালির স্কুলে যাওয়া। পড়ে রইল বইখাতা। পড়ে রইল বাড়ির উঠোন, স্কুলের আঙিনা। লেখাপড়ার স্বপ্ন গুমরে মরল। ছোট্ট বুকে দম আটকানো কষ্ট। ছোট্ট মাথায় ঘুরপাক খেলো শিক্ষকদের আশা ও আশীর্বাদ। শেফালি ভালো ছাত্রী, সে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হবে। স্কুলের ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। বাবা-মা ও শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ব করবে। কোথায় কী? সব কিছুই মুখ থুবড়ে পড়ল।

শেফালি বড়ো হলো। হ্যাঁ বড়ো তো হলোই। বিয়ের উপযুক্ত শরীর ও মন তার হয়েছে কিনা সে জানে না। কিন্তু বাবা-মা, পাড়াপ্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের চোখে সে এখন পরিপূর্ণ। সাবালিকা। শেফালির গায়ে হলুদের পানি পড়ল। শেফালির চেহারায় একরাশ লজ্জা। শেফালি শিহরিত। রোমাঞ্চিত। বিয়ে হবে তার। ছোট্ট বুকে অজানা শঙ্কা। আতঙ্ক। রোমাঞ্চ। শিহরণ।

বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েই গেল তার। সে এখন পরঘরী। স্বামী অশিক্ষিত। গায়েগতরে হোমরাচোমড়া। জামাল হোসেন নামক একটি নিরেট বস্তু। অসহ্য। যন্ত্রণার।

শেফালির ছোট্ট শরীর পিষ্ট হলো যন্ত্রণায়। প্রথম প্রথম কান্না পেতো। দিন রাত খালি কান্না আর কান্না। কখনো সরব, কখনো নিরব। কিন্তু তাতেও আরেক জ্বালা। পাড়ার বউঝিরা বলা শুরু করল বউয়ের জিন লেগেছে। জিন ঝাড়াতে হবে। ওঝা আনা হলো। শুরু হলো আরেক যন্ত্রণা।

শেফালি এখন আর কাঁদে না। কান্নাগুলো বুকের ভেতর গুমরে মরে। নিরব কান্না জমতে জমতে বুকের ভেতরের হৃদয়নামক ছোট্ট ফিল্টারটুকু ভরে উপচে পড়ে। সে কান্না কেউ দেখে না। কেউ বোঝে না।

দিন যায়। মাস যায়। শেফালির শরীরটা দিনে দিনে পরিণত হয়েছে, মন-মগজেও এখন আর অপরিণত নয় সে। সংসার সংসার খেলাটা এখন সে বুঝতে শিখেছে। এখন কষ্ট পেলেও তার আর কাঁদতে ইচ্ছে করে না। পাড়ার বউঝিরা বলে, শেফালির জিনের আছর কেটে গেছে।

একদিন শেফালি পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে মাটির পুতুল বানিয়ে বউ বউ খেলা করত। রান্নাবাটি খেলত। সেই শেফালি আজ কয়েক বছরের ব্যাপ্তিতেই পুতুল খেলা ভুলে গিয়ে আসল স্বামী-স্ত্রীর খেলায়, রান্নাবাটির খেলায় পুরোপুরি মত্ত। সংসারের ভালো-মন্দের খেলায় সে এখন পুরোপুরি একজন ডিফেন্ডার। সংসারের ভালো, মন্দ নিজ হাতে সামলায়। সব অশুভ, খারাপ একা মোকাবিলা করে। পাড়ার বউঝিদের খুব একটা পাত্তা দেয় না।

শেফালি সংসারের সকল কাজ সেরে পরিপাটি করে শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ায়। শরীরে সাবান মাকে, সুগন্ধি মাখে। সহ্য হয়না পাড়ার বউঝিদের। তারা স্বামীর কান ভারী করে। বলে, তোর বউ লেখাপড়া জানা, কদিন পরে তোকে আর মানবে না। তোর সংসার ভাঙলো বলে।

নিরেট মাংসসম্বলিত জামালের মোটা মাথায় এসব কথার কিছু ঢোকে, কিছু ঢোকে না।

সংসারের কাজকর্মে পান থেকে চুন খসলে জামাল এখন বউকে ছাড়ে না। নানা কটু কথা শোনায়। গালমন্দ করে। শেফালির কথার যুক্তিতে পেরে ওঠে না স্বামী। জামাল আরও ক্ষিপ্ত হয়। এভাবেই কখনো সুখে, কখনো দুঃখে সংসার সাগরের ভেলা এগিয়ে যায়। সব উপেক্ষা করে শেফালি স্বামীর মনোরঞ্জনে যা যা তার পক্ষে করা সম্ভব সবই সে করে। ছোটবেলা থেকে মা-চাচীদের কাছ থেকে সংসারের কাজকর্ম ও সংসারে কিসে সুখ হয় সেটা সে শিখেছে। শেফালি একে একে বোধহীন পশুর মতো সন্তান বিয়োতে থাকে। স্বামীর কাছে তার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো দাম নেই। সে বাড়ির গোয়ালের ঠুসিপরা বদলদুটোর মতো সংসারের ঘানি টেনে যায়। কখনো কখনো চোখবাঁধা কলুর বলদও সে।

একদিন জামাল মাঠ থেকে বাড়িতে এসে দেখে, তার বউ ঘরের দাওয়ায় বসে এক অচেনা যুবকের সাথে গল্প করছে। ছেলেমেয়ে দুটো বাড়ির উঠোনে খেলা করছে। জামালকে দেখে শেফালি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। জামাল বউকে জিজ্ঞেস করে, Ôছেলেটি কিডা, এ গাঁয়ের ছেলে বলে তো ঠাহর হয় না।

শেফালি বলে, ও আমাদের গাঁয়ের ছেলে। ওর নাম শওকত। আমার সাথে পড়তো। পাশের গ্রামে ওর আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। যাওয়ার পথে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। মা বলেছে আমার খোঁজ খবর নিয়ে যেতে।

ছেলেটিও কিছুটা অপ্রস্তুত। সে তাড়াতাড়ি উঠে বলে,  শেফালি আমি যায়। আমার বাড়ি পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।

কারও কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ছেলেটি পা বাড়াল। শেফালি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে নির্বাক তাকিয়ে রইল। চোখদুটো তার ছলছল করে উঠল। কত স্বপ্ন ছিল তার। লেখাপড়া শিখবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল!

শেফালি মুহূর্তেই নিজেকে সামলে সংসারের কাজে মনোযোগী হলো।

উনিশে পা শেফালির। আবারও তার পেট ভারী হয়ে উঠেছে। সংসারে কাজের কোনো লোক নেই। সংসারটাও আগের মতো ছোট নেই। আগের দুটো সন্তান বিয়োনোর সময় সে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল। এখন তা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে বাপের বাড়ি খবর পাঠিয়েছে। মা যেন এ সময় তার শ্বশুরবাড়ি আসে।

এ খবর তার স্বামী জানে না।

পাড়ারপ্রতিবেশী জামালকে বলে, বউকে তুই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দে। ছেলেপুলে বিয়োয়ে আসুক।

শেফালি আপত্তি করে। বলে, না আমি এবার বাপের বাড়ি যাব না। আমার সংসার কে সামলাবে। আমার ছেলেমেয়েদের কে দেখবে। আমি বাপের বাড়ি খবর পাঠিয়েছি। মা এসে থাকবেন।Õ

এরই মাঝে জামালের ফুপু এলেন বেড়াতে। প্রথম দুদিন ভালোমতো থাকলেও তৃতীয় দিন থেকে শুরু হলো বউয়ের খুত ধরা। কথায় কথায় বউকে শিক্ষা দেওয়া। বউ এটা পারে না, ওটা জানে না। এ কাজটা এভাবে করতে হবে, ওটা এভাবে করতে হবে।

শেফালির এই অনাকাক্সিক্ষত উটকো ঝামেলা পছন্দ হলো না। দিনে দিনে ফুপুশাশুড়ির সাথে তার খিটিমিটি লেগেই চলল। শেফালি এখন আর কোনোকিছু মুখ বুজে সহ্য করে না। প্রতিবাদ করে। ফুপুশাশুড়ি দুকথা শোনালে সেও পাঁচকথা শুনিয়ে দেয়।

ফুপু জামালের কানে সারাদিন গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে কান ভারী করতে থাকে। জামাল ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বউকে বকাঝকা করে। কখনো কখনো গায়েও হাত তোলে। শেফালি প্রতিবাদ করে। সে স্বামীকে বলে, Ôআমার গায়ে হাত তুলবে না। আমি পাঁচ বছর সংসার করছি, এখন কোথাকার কোন ফুপু এসে আমার সংসারে নাক গলাতে এসেছে। এতোদিন কোথায় ছিলেন তিনি?

জামালের এসব কথা শুনতে ভালো লাগে না। সে সারাদিন বাড়ির বাইরে চাষের ক্ষেতে আর সন্ধ্যার পর চায়ের দোকানে থাকে। অনেক রাত হলে বাড়ি ফেরে। আর বাড়িতে চলে সারাদিন বউ আর তার ফুপুর ঝগড়াঝাটি।

জামাল প্রখর রোদে মাঠে কাজ করে। বোশেখের কাঠফাটা রোদ্দুর। সে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয় গাছের ছায়ায়। আবার কাজ করে। সূর্য যেন মাথার উপর নেমে এসেছে। তার মাথাটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অন্যদিন সে দুপুর গড়িয়ে বিকেল অবধি নিজের ক্ষেতে কাজ করে। আজ রোদের তাপ এতো বেশি যে সে আর কাজ করতে পারছে না। গরু দুটো হাঁফাচ্ছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে।

জামাল লাঙল জোয়াল ঘাড়ে হালের বলদদুটো নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। বিলের কাছে আসতেই তার শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। গরু দুটোও বিলের পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যতক্ষণ পারল পানি খেয়ে বিলের পানিতে গা এলিয়ে দিলো। জামালও পানিতে নেমে প্রথমে গরু দুটোর গা ধুইয়ে তারপর ভালোমতো নিজের গাগতর বিলের পানিতে ধুয়ে শীতল করল।

অন্যদিন জামাল গরুদুটো গোয়ালে বাঁধে, তার বউ ডাবায় পানি দেয়। গরু দুটো তৃপ্তিসহকারে পানি খায়। আর জামাল কলের পানিতে কিংবা বিলে গিয়ে স্নান করে। আজ সে একেবারে স্নান সেরে এসেছে।

অপ্রত্যাশিতভাবে একটু আগে জামালের বাড়ি ফেরায় শেফালি কিছুটা অপ্রস্তুত। সংসারের সকল কাজ সেরে তারপর সে হেঁসেলে ঢোকে। রান্নাবান্না শেষ করে ছেলেমেয়েদের স্নান করিয়ে দুপুরের খাবার খাইয়ে তারপর নিজে গোসল করে। পরিপাটি করে শাড়ি পরে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। আজ তা হলো না। তার স্বামী আজ তাড়াতাড়িই মাঠ থেকে ফিরে এসেছে। আজ রান্না হয়নি। হেঁসেলে কেবল ঢুকেছে সে। মাটির হাড়িতে করে চাল ধুয়ে উনুনে চড়িয়েছে সবে।

জামাল ভিজে কাপড় ছেড়ে শুকনো লুঙ্গি পরে, সারা শরীরে তেল মেখে ঘরের দাওয়ায় বসেছে। ছেলেমেয়ে দুটো উঠোনে খেলে বেড়াচ্ছে। বাবা বাড়িতে আসলেও তাদের ভেতর কোনো পরিবর্তন নেই।

শেফালি হেঁসেল থেকে বেরিয়ে স্বামীর উদ্দেশে বলে, Ôআজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে?

জামাল কথা বলে না। মুখ দমধরা।

শেফালি আবার হেঁসেলে ঢোকে। উনুনের খড়িগুলো ভালো করে নাড়িয়ে দেয়। তারপর বটি নিয়ে তরকারি কাটতে বসে।

জামাল আড়চোখে তা দেখে। বুঝতে পারে রান্না এখনও হয়নি। তার পেটটা খিদেয় চো চো করছে। শেফালি কী করবে বুঝতে পারে না। তরকারি কোটা শেষ হলে সে কলপাড়ে গিয়ে মাটির কলসি ভরে পানি এনে ঘরের দাওয়ায় রাখে। কাঁসার গ্লাস ভরে এক গ্লাস পানি স্বামীর সামনে রাখে। জামালের মুখটা তখনো দমধরা। সে পানিসহ গ্লাসটা শেফালির মুখের উপড় ছুঁড়ে মারে। বলে, Ôমাগী তোর কাছে পানি চেয়েছি, আমি ভাতের জন্য বসে আছি। সারাদিন কী করিস তুই, পরিপাটি করে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াস। রান্নার সময় কই তোর?

শেফালি কিছু বলে না। মুখ বুজে সহ্য করে। যদিও তার ভেতরে প্রতিবাদটা ফুঁসতে থাকে। শেফালি হেঁসেলে গিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়।

এদিকে ফুপু জামালের কান ভারী করতে ব্যস্ত। সাথে যোগ হয়েছে পাড়ার বউঝিরা। বউয়ের রান্না করার সময় কই। ওই ছেলেটা যে আজও এসেছিল। সকাল দুপুর পর্যন্ত তো তার সাথেই গল্প করে কাটিয়েছে। গল্প আর গল্প। কী এতো গল্প কী জানি বাপু। বিয়ে তো আমাদেরও হয়েছে। আমরাও তো পরের ঘর করছি।

এসব কথা শুনে জামালের মোটা মাথা আরও অস্থির হয়ে ওঠে।

পাশের বাড়ির কলিমের বউ এসে বলে, কী জানি বউয়ের ভাবসাব আমার ভালো লাগে না। তোকে আগেই বলেছিলাম, লেখাপড়া জানা মেয়ে বিয়ে করিস না, তোর সংসার টেকবে না।

জামাল ভেতরে ভেতরে জাতসাপের মতো গজরাতে থাকে।

কপিলের মা এসে বলে, বউয়ের চরিত্রির দোষ আছে।

জামাল সহ্য করতে পারে না।

শেফালি এসব কথায় তোয়াক্কা না করে যত দ্রুত সম্ভব রান্না শেষ করে। তারপর কাঁসার থালায় ভাত তরকারি ভরে কাঁপাহাতে স্বামীর সামনে রাখে।

ছেলেমেয়েদুটোকে কলপাড়ে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসতে বলে। শেফালি তাদের জন্যও থালায় ভরে ভাত তরকারি নিয়ে আসে। শেফালি ছোট মেয়েটাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে।

জামাল ভাত মুখে তুলছে না। পেটে খিদে থাকলেও মনের ভেতর ঝড় শুরু হয়েছে। ফুপু বলেন, Ôভাত খেয়ে নে। ভাতের উপর রাগ করে কী করবি। তোর কপালডায় মন্দ। নাহলে এতো অল্প বয়সে তোর মা-বাপ মারা যায়।

বউ বলে, আমার উপর রাগ করে কী করবে। সেই আমার হাতের রান্নায় তোমাকে খেতে হবে।

ফুপু বলে, আমার জামাল কি ফেলনা যে শুধু তোর হাতের রান্নায় খেতে হবে। আমি জামালকে আবার বিয়ে দোবো।

শেফালি বলে, কে বিয়ে করবে ওই মাথামোটা গোয়ারকে। আমার মতো বউ পেয়েছিল বলে আজও সংসারটা টিকে আছে। আপনারা সবাই মিলে যেভাবে আমার সংসারটা ভাঙার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে সংসারটা আর টিকে থাকবে না।

পাড়ার বউঝিরা একসাথে ঐক্যতান তুলে বলে, Ôআমরা তোর সংসার ভাঙছি। ও জামাল তোর ভালো মন্দে আমাদের আর কোনো দরকার নেই। তোর সংসার তুই সামলা। আর ওই যে বউয়ের গাঁয়ের যে ছেলেটা রোজই আসে তাকেও সামলে চলিস।

জামালের রাগ সপ্তমে ওঠে।

ফুপু বলে, আমাকে কীনা বলে, আমি নাকি ওর সংসার ভাঙতে এসেছি। জামাল তুই এর বিচার কর। আমার ভাই বেঁচে থাকলে এ অপমান তিনি কখনো মুখ বুজে সহ্য করত না।

শেফালি ভাতের থালাটা আবারও জামালের সামনে সরিয়ে দেয়। বলে ওসব কথায় কান দিয়ো না, ভাত খেয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে আড্ডা মার। তাতে তোমার মনটা ভালো থাকবে। জামাল ভাত মুখে তুলতে গিয়েও পারল না, মনে ভেতর জমতে থাকা ক্রোধে ফেটে পড়ল। সে ভাতের থালাটা হাতে নিয়ে বউয়ের মুখের উপড় ছুড়ে মারে। গরম ভাত তরকারি পড়ে শেফালির মুখটা ঝলসে যায়। সে কিছুক্ষণ আগে যে মাটির কলসিতে করে পানি এনেছিল স্বামী সন্তানদের খাওয়ার জন্য সেটাই মাথার উপর ঢেলে দেয়। ছোট মেয়েটির খাওয়া শেষ হয় না।

শেফালি প্রতিবাদ করে ওঠে। বলে, তোমার এই ফুপু আমার মুরুব্বি। তাকে আমি সম্মান করি। উনাকে তার বাড়িতে চলে যেতে বলো। তার সংসার সামলাতে বলো। আমার সংসারে নাক গলাতে হবে না। আমার সংসার আমি ঠিকই সামলে নেব। আর পাড়ার বউঝিদের আমি পরোয়া করি না। তুমি লোকের কথায় বউয়ের গায়ে হাত তোলো। তোমার তো শুধু ওই গতরটাই আছে। ভালো-মন্দ বোঝার কোনো ক্ষমতা তোমার নেই।

জামাল আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে এবার বউয়ের চুল মুঠিতে ভরে কিল ঘুসি মারতে থাকে। শেফালি স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। পারে না। ততক্ষণে বাড়িতে মহাসোরগোল শুরু হয়ে গেছে। আশপাশের মহিলারা যারা একটু আগে চলে গিয়েছিল তারা আবার ভিড় করেছে। কেউ শেফালিকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসছে না। সবাই দৃশ্য দেখে বেশ মজা পাচ্ছে।

শেফালির পেটে সাত মাসের সন্তান। স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে সে এখন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তবুও জামাল তাকে ছাড়ছে না। আজ তার পুরুষত্ব প্রদর্শন করার পালা। বাড়ি ভরতি দর্শকদের সামনে সে তার বলিষ্ঠ শক্তপোক্ত শরীরের কসরত দেখাচ্ছে তার নিষ্পাপ বউয়ের উপর। শেফালি সর্বশক্তি দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দুহাতে সে নিজের পেটটাকে সামলে রাখছে। জামাল কিলঘুষি মেরে ক্ষান্ত হলো না। সে এবার লাঠির খোঁজে গেল। লাঠি না পেয়ে হেঁসেলে গিয়ে একটা পিঁড়ি নিয়ে এলো। বউকে মারবে সে। বউ তখন উঠোন থেকে উঠে ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়েছে। জামাল এলো ছুটে। বউয়ের দিকে ছুঁড়ে মারল পিঁড়ি। বউয়ের গায়ে লাগল না। শেফালির পায়ের উপর এসে পড়ল। শেফালির মেজাজটাও সপ্তমে উঠে গেল। সে পিঁড়িটা তুলে নিয়ে উল্টো জামালের দিকে ছুড়ে মারল আর সেটা গিয়ে লাগল জামালের কপালে। সঙ্গে সঙ্গে তার কপাল কেটে রক্ত পড়তে শুরু করল।

এতোক্ষণ যারা নিরব দর্শক ছিলেন, এখন তারা সরব হলেন। একে একে আওয়াজ ভেসে এলো, ওমা কী কথা, বউ মারল স্বামীকে। কালে কালে আর কত কী দেখব।

কেউ বলল, ও জামাল, তোর আর বেঁচে থেকে কী লাভ। বউয়ের হাতে তুই মার খেলি। ও জামাল তুই আত্মহত্যা কর। তুই মর। এ মুখ তুই মানুষের মাঝে দেখাবি কী করে!

জামালের ফুপু বলল, ওগো তোমরা কে কোথায় আছ, আমার জামালকে বাঁচাও। বাপ-মরা ছেলেটা আমার মরতে বসেছে।

কয়েকজন যুবক ছেলে জামালকে পাশের বাড়ি নিয়ে গেল। দুর্বাঘাস চিবিয়ে তার কপালে লাগিয়ে দিলো। আর গামছা দিয়ে বেঁধে দিলো। এখন আর কপাল থেকে রক্ত পড়ছে না।

শেফালিকে কেউ সান্ত্বনাও দিলো না, সহানভূতিও জানালো না। কিছুক্ষণ ঘরের সামনে পা ছড়িয়ে বসে থাকার পর সে নিজের ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে খিল লাগিয়ে দিলো।

পাড়াপ্রতিবেশীরা তখনো বলে চলেছে, ছি ছি ছি। বউ মারল স্বামীকে। ওকে এখনই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তা না হলে এই গাঁয়ের মানসম্মান আর কিছু থাকবে না।

ফুফুশাশুড়ি বললেন, আমার জামালের গায়ে হাত তোলার আগে তোর মরণ হলো না ক্যানে।

সময় দুপুর গড়িয়ে বিকেলটাও পেরিয়ে গেছে। আশপাশের বউঝিরা তখন সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেছে। এরই মাঝে গ্রামে চাউর হয়ে গেছে যে জামাল তার বউয়ের হাতে মার খেয়েছে। এই খবরে একে একে জামালের বাড়িতে এপাড়া ওপাড়ার বউঝি ও উৎসুক মানুষের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কেউ যাচ্ছে। কেউ আসছে।

প্রকৃতিতে ভরসন্ধ্যা। শেফালি ঘরের ভেতরে গুমরে মরছে। তার নিজের ভেতরেও এখন অনুশোচনা কাজ করছে। সে তো তার স্বামীকে মারতে চায়নি। কেমন করে কী যে হয়ে গেল। সারাজীবন মা-চাচিদের কাছে শুনে এসেছে স্বামীর পায়ের নিচে বেহেশত। আর আজ সে কিনা নিজের স্বামীর কপাল ফাঁটিয়ে দিয়েছে।

রাত গভীর হয়েছে। শেফালির ক্লান্ত শরীর। ঘুম আসছে না। একে তো পেটে খিদে তার উপর অনুশোচনা। সমস্ত শরীর ব্যথায় টনটন করছে। তবুও সে সিদ্ধান্ত নিলো এ জীবন আর সে রাখবে না। এভাবে বেঁচে থেকে কী লাভ? প্রতিদিন মার খাওয়ার চেয়ে একটু একটু করে মরার চেয়ে একেবারে মরাই ভালো। সে তো আর পাড়ার বউঝিদের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। প্রতিদিন তাদের তীর্যক দৃষ্টি আর সুঁচের আগার চেয়ে তীক্ষ্ণ কথাগুলো শুনতে হবে। প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত। তার চেয়ে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ায় ভালো। শেফালি কাদামাখা শাড়িটা নিজের গলায় ও ঘরের বাঁশের আড়ায় ঝুলিয়ে নিলো। এখন সে মরার জন্য প্রস্তুত। মরার আগে নিজের ছেলেমেয়ে দুটোকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল তার। মায়ের মুখটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। খু-উ-ব। মা তুমি কোথায়? আমার ছেলেমেয়েদুটোকে একটু আমার কাছে নিয়ে আসবে? আমি শেষবারের জন্য তোমাদেরকে একটিবার দেখতে চাই।

 

লেখক : মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী
পরিচালক (প্রচার), বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top