সিডনী শুক্রবার, ২৯শে মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

নেগেটিভ পজিটিভ (রম্য রচনা) : তন্ময় চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০২০ ২১:৩২

আপডেট:
১৩ জুলাই ২০২০ ২১:৩৭

 

প্রায় বছর চল্লিশ আগের কথা। বয়স তখন বেশ অল্প। দেশের বাড়ীতে সবে ইলেকট্রিফিকেশান হয়েছে। ইলেকট্রিক যে একটা ভয়ানক জিনিস - সে ব্যাপারটা আমরা বড়দের কাছে শুনে শুনে সবে শিখছি। তার ভয়ানক রূপ তখনো দেখিনি। এমন একটা সময়ে বাড়ীতে এক ঘটনা ঘটে গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল ছোটদাদুর সদর ঘরে আলো জ্বালানোকে কেন্দ্র করে। ছোটদাদু মানে আমার দাদুর সহোদর ভাই। সদর ঘরটি তার প্রিয় জায়গা। আমাদের বাড়ী থেকে সেই ঘর আনুমানিক মিটার পঞ্চাশেক দূরে। কোন এক প্রয়োজনে সে ঘরে আলো জ্বালাতে হবে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ল বেশ অনেকটা লম্বা তারের। কিন্তু না, পঞ্চাশ মিটার লম্বা গোটা একটা তার হাতের কাছে কোথাও পাওয়া গেল না। এ বাড়ী সে বাড়ী খুঁজে টুকরো তার যা পাওয়া গেল তা যোগ করলে অবশ্য পঞ্চাশ মিটারের বেশিই হবে। তাই দাদুর উৎসাহে সেই সব টুকরো জোড়াজুড়ি পর্ব শুরু হল।

কাকারা তার জুড়ছে। দাদু জুড়ছে। জোড়া জায়গায় সেলোটেপ পড়ছে। আমরা ছোটরা দর্শক। তার জোড়া পর্ব শেষ হতে ছোটদের নিরাপদ দূরত্বে রেখে প্লাগের সুইচ অন করা হল। সদর ঘরে আলো জ্বলবে বলে আমরা আগ্রহী। কিন্তু প্রত্যাশায় ছাই দিয়ে দুম করে এক আওয়াজ ভেসে এল কোথা থেকে। ব্যাস, তারপর সব অন্ধকার। দেখা গেল ইলেকট্রিক মিটার থেকে ধোঁয়া উড়ছে। কারণ অনুসন্ধান করে জানা গেল যে নেগেটিভ পজিটিভ নাকি এক হয়ে গেছে। পরে জেনেছিলাম, দাদু যে সব জায়গা জুড়েছিলেন শেখানে লাল-সবুজ একসাথে জুড়ে তার ওপর বেশ মোটা করে সেলোটেপ মেরেছিলেন। সদ্য সদ্য যে গ্রামে ইলেক্ট্রিক এসেছে সেখানে এই আলোচনা হটকেকের মত হয়ে উঠল। চলল বেশ কিছুদিন ধরে। কেউ বলল, দুর্ঘটনা, কেউ বলল বিস্ফোরণ। অনেকে বলল, ভাগ্য ভালো, নয়ত গোটা বাড়ীটাই নাকি উড়ে যেত। নেগেটিভ পজিটিভ এক জায়গায় এলে কি দুর্দশা ঘটতে পারে সেই প্রথম জানলাম।

আরও কিছুদিন পরে ইস্কুলে শিখলাম "পজিটিভ" হল ইতিবাচক আর "নেগেটিভ" হল নেতিবাচক। মাস্টারমশাইরা ইতিবাচক হওয়ার স্বপক্ষে বললেন। মহাপুরুষদের জীবনে নাকি সবটাই ইতিবাচক পদক্ষেপ। বাড়িতে ততদিনে ইলেকট্রিকের পজিটিভ নেগেটিভ আমরা চিনে গেছি। এখন এল আর এক সমস্যা। তখন আমাদের পাড়ার পরিমণ্ডলে দু ধরনের রাজনীতি। কেউ বাম ঘেঁষা। কেউ দক্ষিণ। পাড়ার সুবিখ্যাত আমগাছটির নীচে বাম আর দক্ষিণ পন্থীরা একসাথে এলেই তৈরি হত বেশ গরম একটা পরিবেশ। সে বয়সে রাজনীতির 'র' বুঝি না। তবে বয়স্কদের আলোচনায় "ট্রাই টু বি পজিটিভ", "ডোন্ট বি নেগেটিভ" শুনতে শুনতে চিন্তায় পড়ে যেতাম। ভাবতাম, এইরে, নেগেটিভ পজিটিভ আবার একসাথে এসে গেছে। আমার চেতনায় নেগেটিভ পজিটিভ মানেই সেই ধোঁয়া আর অন্ধকার। তা ধোঁয়া উড়ত বৈকি! আর সমস্ত আলোচনা শুনেও আমরা অন্ধকারে থেকে যেতাম - কে পজিটিভ, কে নেগেটিভ?

বয়েস বাড়ল একটু একটু করে। নেগেটিভ পজিটিভ ব্যাপারটা নিয়ে ধোঁয়াশা কিন্তু কাটল না। ইংরেজী স্যার ক্লাসে একদিন বললেন, কিছু কিছু বাক্য "নেগেটিভ" করলে তবেই "পজিটিভ" ডিগ্রীতে আনা যায়। আমার সমস্যা আরও বেড়ে গেল। তবে কি প্রয়োজনে এই দুই বৈমাত্রেয় ভাই আঁতাত করে নাকি? আলগা ভাবনাটা দৃঢ় হল কদিনের মধ্যেই যখন পাড়ায় ঘটল আর এক ঘটনা। পাচনম্বর সন্তানটিও কন্যা হওয়াতে গ্রামের হারুকাকু প্রচেষ্টায় রাশ টানলেন। ঘোষণা করলেন, "নাঃ আর না!"।প্রতিবেশীরা অনেকেই বললেন - "সাধু সাধু, এই জনবিস্ফোরনের দেশে এ এক "পজিটিভ" স্টেপ।" কনিষ্ঠার নাম রাখা হল "ইতি"। আমার সাদা বুদ্ধিতে আমি কিন্তু "ইতি"র মধ্যে "নেতি"র গন্ধ গেলাম। পজিটিভ-নেগেটিভ যে প্রয়োজনে হাতও ধরে  - তা আবার টের পেলাম।

এরপর গ্রাম থেকে পড়াশোনার প্রয়োজনে এসে উঠলাম শহরে। শহরে এসে যে পাড়ায় উঠলাম, সে অঞ্চলকে সবাই একডাকে চেনে। চেনে এক ডনের কারনে। খুন, জখম, ওয়াগেন ব্রেকিং - সব নেগেটিভ লাইনেই নাকি তার স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। একদিন সেই মহাপুরুষের সাক্ষাৎ পেলাম। যেমন লম্বা, তেমনি পেল্লায় বুকের ছাতি। বুক চিতিয়ে হাঁটেন বলে ছাতি আরও চওড়া লাগে। চোখে কালো গগলস। ডান বাঁ মিলিয়ে জনা দশেক চামচা বেলচা। সে এক এলাহি ব্যাপার। শুনলাম পাইপ গান, পেটো নাকি তার কাছে নস্যির মত। কথায় কথায় পাড়ার পরিবেশে  অন্ধকার নামিয়ে দেন তিনি। আর তাই পাড়ার সকলে ভয়ে জড়সড়। বছর খানেক পরে অবশ্য বদলে গেল ছবিটা। একদিন দেখি সেই ডন নিজেই কেমন জড়সড়। শরীর শুকিয়ে আমসি, মুখে কালো ছাপ। কি ব্যাপার? না এইচ আই ভি পজিটিভ। ছ মাসের মধ্যে ওপারে চলে গেলেন। লোকে বললে, যাক শেষ দশায় একটা অন্ততঃ পজিটিভ কাজ করে গেল।

ইদানীং করোনা আবহে নেগেটিভ পজিটিভ সমস্যা যেন আরও পেকে উঠেছে। এ বেলার হাসিখুশি "নেগেটিভ" রাত পোহালে নাম লেখাচ্ছেন "পজিটিভ" ক্যাম্পে। কেউ কেউ ভাগ্যদোষে। তবে অনেকেই যে সাধ করে ক্যাম্প বদল করছেন - তা না বললেও চলে। মুখোশ এর এক গল্প না বললেই নয়। এ পাড়ার বঙ্কুবাবুর কথাই বলি। তিনি বাইরে এলেই তার নাক-ঢাকা মাস্ক গলায় নেমে মাদুলি হয়ে দোল খায়। প্রশ্ন করলে উত্তর দেন, "ভীষণ কুটকুট করে দাদা, না খুললে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে।" প্রয়োজনে মুখোশ-মুখে কালেভদ্রে বের হই আমি। আর বের হলেই তার সাথে চোখাচোখি হয়। দেখি মুখোশ খুলে তিনি দিব্যি চা খান, বিড়ি খান, ধনেপাতার গন্ধ নেন, প্রাণভরে ঘ্রান নিয়ে গন্ধরাজ লেবু কেনেন, প্রতিবেশির কুশল জানেন। এমনি করেই চলছিল। হঠাৎ সেদিন শুনি ক্যাম্প বদল হয়ে গেছে। রিপোর্ট এসেছে বঙ্কুবাবু পজিটিভ। পাড়ার মোড়ের মাথায় বঙ্কুবাবুর বাড়ি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তার বাড়ির সামনে শুরু হয়ে গেল নেগেটিভ-পজিটিভ খণ্ডযুদ্ধ।। বঙ্কুবাবু কিছুতেই বাড়ী ছাড়বেন না। মুখোশ খুলে লড়াই চালাচ্ছেন। একশো হাত দূরে দাঁড়িয়ে নেগেটিভরাও নাছোড়বান্দা। চলছে গরম গরম বাকযুদ্ধ। দূর থেকে দাঁড়িয়ে টের পেলাম আমার শৈশবের সেই দুই জিনিস। সেই ধোঁয়া আজও উড়ছে, আর এই অজ্ঞতার পরিনতি যে অন্ধকার - তা আর না বললেও চলে।

                                               

তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top