সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

তিনি নিজেই ছিলেন একটি পরশপাথর : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
১৫ জুলাই ২০২০ ২১:৪১

আপডেট:
১৫ জুলাই ২০২০ ২২:১৩

ছবিঃ তুলসী চক্রবর্তী

 

সমুদ্র থেকে মহা-সমুদ্র ও দেশ থেকে যেভাবে মহা-দেশ, সেভাবেই মহা-নায়ক হিসেবে যে মানুষটি আপামর বিশেষত বাঙালী হৃদয়ের কেন্দ্রস্থলে আজও সমানভাবে জীবিত ও জনপ্রিয়, তিনি উত্তমকুমার। সেই উত্তমকুমার স্বয়ং মন্তব্য করেছিলেন, 'তুলসীদার মতন অভিনয় কোনোদিনই পারব না! ওনার মতন জীবন্ত হয়ে ওঠা সম্ভব নয়! ওনার ঋণ শোধ করার পথ একটাই। যখনই কাজ পাই, পরিচালক ও প্রযোজককে বলে ওনাকে ডেকে নিই।'

নিরহংকারী, সাদা-মাটা ও নিপাট ভদ্রলোক অথচ অসম্ভব অভিনয় দক্ষতার অধিকারী এই মানুষটির অর্থকষ্টও কিন্তু এক ইঞ্চি টলাতে পারেনি তাঁর ন্যায়-নীতি ও সততাকে। 

একজন দাপুটে অভিনেতা ও মহানায়ক উত্তমকুমারের ভাই তরুণ কুমার একবার তাই তো স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছিলেন, '১৯৫৯ সালে 'অবাক পৃথিবী'তে একজন মুদির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। তাঁকে ডাকতে গিয়ে বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল ট্যাক্সি, কিন্তু তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বরং হাওড়া থেকে তিনি টলিপাড়ায় এসেছিলেন ট্রামে।

পারিশ্রমিক হিসেবে উত্তর কুমার তাঁর জন্য   ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ৩০০ টাকা, কিন্তু একবেলা কাজের বিনিময়ে ৩০০ টাকা পারিশ্রমিক নিতেও অস্বীকার করেন তুলসীদা, তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাঁর প্রাপ্য ১২৫ টাকাই।' 

সুদর্শনও বলা যাবে না এমনকি দেখতে তথাকথিত নায়কের মতও নন,  বড় বড় চোখ এবং মাথায় বিস্তর অসম্পূর্ণ চুল, আলু-থালু জামা-কাপড় তায় আবার অবিন্যস্ত দাঁত ও ভুঁড়িসর্বস্ব কিন্তু, প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর অসাধারণ অভিনয় প্রতিভাকে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন  সত্যজিৎ রায়।

একেই বোধ হয় বলে, 'রতনে রতন বা জহুরি জহর চেনে!'

'প্যাহলে দর্শনধারী বাদ মে গুণবিচারী!' জনপ্রিয় এই প্রবাদ বাক্যকে যেন তিনি পরিণত করেছিলেন একটি নিস্ক্রিয় বাক্যে। যে কোনও চরিত্রকে একেবারে জীবন্ত করে তোলার অনবদ্য নৈপুণ্য যেন ছিল তাঁর সহজাত একটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য। সত্যজিৎ রায় তাঁর শেষ জীবনে পর্যন্ত বলে গেছেন যে, তুলসী চক্রবর্তীকে না পেলে তিনি বানাতেই পারতেন না 'পরশ পাথর’ ! এমনকি ভারতরত্ন সত্যজিৎ রায় তাঁর এক সাক্ষাৎকারে তুলসী চক্রবর্তীর নাম করতে গিয়ে আবেগ-বিহ্বল হয়ে বলেছেন 'তুলসী চক্রবর্তীর মতন অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না, কিন্তু তিনি যদি আমেরিকাতে জন্মাতেন, নির্ঘাত অস্কার পেতেন!'

সত্যজিৎ রায়ের কাছে তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন 'ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র।' ১৮৯৯ সালের ৩-রা মার্চ, কৃষ্ণনগরের গোয়ারি নামক এক ছোটো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, ভারতীয় রেল-এর কর্মী পিতা আশুতোষ চক্রবর্তীর শিশু পুত্রসন্তান তুলসী চক্রবর্তী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বাবার অকালমৃত্যুতে মা নিস্তারিণী দেবী সদ্য তরুণ তুলসীকে নিয়ে নিয়ে চলে আসেন কলকাতায়।

পরবর্তীকালে প্রখ্যাত স্টার থিয়েটার-এর একজন বিশিষ্ট তবলা ও হারমোনিয়াম বাদক, কাকা প্রসাদ চক্রবর্তী'র সুবাদে নিজ প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের দেখার সুযোগের পাশাপাশি তিনি অভিনয় জগতে আত্মপ্রকাশ করার অণুপ্রেরণা পান। পরবর্তীতে তিনি পরিচিতি অর্জন করেন একজন বাস্তবসম্মত অভিনেতা হিসেবে। 

নিজের কাজ সম্বন্ধে এই মানুষটি ছিলেন অত্যধিক বিনয়ী। প্রশংসা শুনলে বলতেন, 'এটা করতে অভিনয় দরকার হয় না। চারপাশেই তো কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাউকে কাঁধে বসিয়ে নিলেই হয়ে যায়!'

অনেক ফিল্ম সমালোচক এমনকি বিশ্বখ্যাত কমেডি কিং চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে তুলনা পর্যন্ত টেনেছেন তুলসিবাবুর। কিন্তু সে অর্থে তাঁর অভিনয় ছিলো নিতান্তই দেশজ। শুধু কি তাই? 

চিন্ময় রায়, অনুপ কুমার, রবি ঘোষ এ সমস্ত  বলিষ্ঠ বাঙালী অভিনেতারা সকলেই গুরুদেব হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন তুলসী চক্রবর্তীকে।  এ বিষয়ে চিন্ময় রায় নিজে মন্তব্য করেছিলেন যে, 'চার্লি চ্যাপলিন যদি বেঁচে থাকতেন তবে এ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় দেখে তিনি হয়তো বলতেন, এমন অভিনয় আমি যদি করতে পারি তবে আরও বেশি পাবো জনপ্রিয়তা!' 

মনে কি পড়ে 'পরশপাথর'-এর সেই কালজয়ী দৃশ্যটা? 

পাথরখানা খেলনা সেপাইয়ের গায়ে ঠেকাতেই সোনা! বিস্ফারিত চোখ নিয়ে দেখছেন পরেশচন্দ্র দত্ত। তারপর, প্রায় অর্ধ উন্মাদরূপে ফেটে পড়ছেন হাসিতে। সেই টানাপোড়েনের সংসারে আনন্দ-উত্তেজনা ও লোভের সংমিশ্রণে 'যা চাই, তা সবই পেয়েছি'র কি অত্যন্ত স্বাভাবিক উচ্ছ্বসিত হাসি! ঠিক মুহূর্তেই আবার সম্পূর্ণ ইমেজকে পরিবর্তন করে অজানা এক আতঙ্ক যেন গ্রাস করে বসলো... কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়লেন গোবেচারা কেরানি পরেশ দত্ত। 

এ হেন অদ্ভুত ধরণের ট্রানজিশন হয়তো টালিগঞ্জে পারতেন একজন অভিনেতাই আর তিনি স্বয়ং তুলসী চক্রবর্তী।  একেবারে উদোম গায়ে কত চরিত্রই না অভিনয় করেছেন তিনি, কিন্তু কোনও দৃশ্যেই শরীর প্রদর্শনটা মূল হয়ে ওঠেনি তাঁর কাছে প্রধান বিষয়।

১৯২০ সালে 'দুর্গেশনন্দিনী' নাটকে প্রথম স্টেজে অভিনয় যাত্রা থেকে শুরু করে 'পথের পাঁচালী' ও 'সাড়ে চুয়াত্তর' সবেতেই ছিল তাঁর সহজ-সরল অথচ নিঁখুত ও অসামান্য অভিনয় দক্ষতা!

বাংলা সিনেমা জগতে ছবি বিশ্বাসের মতন অভিনেতাকে চেনেন না এমন মানুষ হয়তো নেই বললেই ঠিক হয়। সেই ছবি বিশ্বাস যিনি কিনা শুটিং চলাকালীন সংলাপ মুখস্থ করতেন না কোনোদিনও, শুধু একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই ব্যাস, এরপর সরাসরি অভিনয়ের দাপট!  সেই বিশ্বাসবাবুর সাথে সহ-অভিনেতা হিসেবে যেদিন তুলসী চক্রবর্তী থাকতেন, সেদিন তাঁকে  নামতে হতো রীতিমতন কোমর বেঁধে! তিনি বলতেন, 'কী জানি, কী প্যাঁচ আবার কষে বসবে তুলসী'টা’ ! কারণ হিসেবে উল্লেখ্য, ছবি বিশ্বাস নিজেই খুব ভালোভাবে জানতেন যে সহ-অভিনেতা যখন তুলসী চক্রবর্তী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে চ্যালেঞ্জ রেখে, এক্কেবারে টক্কর দেওয়ার মতই।

চলচ্চিত্রের কোনো প্রকারের ডিগ্রী, রূপ,অর্থ বা বংশগত কোনো সুপারিশ ছাড়াই শুধুমাত্র অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে দর্শক হৃদয়ে কিভাবে উচ্চ আসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, তা যেন কৌতুক অভিনেতার জলের মতন মুখস্থ ছিলো। 

'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবির পোস্টারের কথাটা কি মনে পড়ে? 

সেই পোস্টারের কিন্তু মূল আকর্ষণ ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী, যেখানে উত্তমকুমার পর্যন্ত হয়ে পড়েছিলেন ব্রাত্য।

মহানায়ক তাঁর কেরিয়ার শুরুর প্রথম দিকের গল্প বলতে গিয়ে নিজেই লিখে গেছেন যে, 'সাড়ে চুয়াত্তর ছবির বিজ্ঞাপনের একদম প্রথমেই যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল, তা ছিল এমন - প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি। (সেই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রথম শ্রেণীর একটি চিত্রগৃহে বাংলা ছবি মুক্তি পাওয়াটা ছিলো যেন এক বিরাট উচ্চমানের ব্যাপার!) আর দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল, তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত একটি ছবি, সেখানে নায়ক হয়েও আমার কোন হদিসই রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। আমি নগণ্য, আমি সামান্য’।

সু'দর্শন ও সু'দেহ গঠনের অধিকারী ছাড়াই তিনি হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে ঠিক কত দৈর্ঘ্যের অভিনেতা ছিলেন তিনি।

একজন স্বনামধন্য অভিনেতা হওয়া সত্বেও সারাটা জীবনসহ শেষ সময়টিও তিনি কাটিয়েছেন চরম দারিদ্রতার আবহেই। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ঘটে যায় এ হেন উজ্বল নক্ষত্রের পতন ।

 

তন্ময় সিংহ রায়
নতুনপল্লী পূর্ব, কোলকাতা, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top