সিডনী সোমবার, ২৯শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১

সেল্ফ কোয়ারেন্টিন : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
১৮ জুলাই ২০২০ ২২:৪৮

আপডেট:
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:৩৫

 

বাসা বদল করার সময় চিঠিগুলো প্রথম হাতে পড়েছিল রাইসুলের। উর্দুতে লেখা। রাইসুলের কাছে হিন্দি, উর্দু লেখ্যভাষাটা বিশেষ আলাদা মনে হয় না বলে সে মাথা ঘামায়নি। পিকআপ ভ্যানে মালপত্র উঠাতে গিয়ে পাকিস্তান আমলের ব্রিফকেসটা হাত থেকে ফসকে পড়ে লক ভেঙ্গে ভেতর থেকে চিঠিগুলো পাখির পালকের মতো ছিটকে পড়েছিল মাটিতে। আরও কিছুর সাথে চিঠিগুলোও তার বাবার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভেবে দ্রুত ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে পিকআপরের ব্যাকডালা লক করে দিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আছে। আজ এই চিঠিগুলোই রাইসুলের কাছে প্রধান প্রমাণ। একমাত্র সত্য। এ প্রমাণের কাছে আর কিছু মিথ্যা হতে পারে না। রাইসুলের শরীর ঘামতে থাকে। সমস্ত পৃথিবীটা রাইসুলের কাছে একটা সম্পাপড়ীর মতো মনে হয়। কিন্তু একদিকে চরম সত্য, নির্মম বাস্তবতার পোড়া সাক্ষী অন্য দিকে রক্তের সম্পর্ক। কোন দিকে যাবে রাইসুল? ঘাম তার কপাল বেয়ে গলা হয়ে নাভির নিচ ধরে হাটু ছোঁয়। ডানের টেবিলে একটা আপেল কাটার ছুরি। ছুরিটা তার দিকে চেয়ে হাসছে। রাইসুল একবার হাতের চিঠিগুলোর দিকে তাকায়। একবার ছুরিতার দিকে তাকায়।
করোনার আঁচ এসে লেগেছে বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল ছায়াও। বাঙ্গালির সবকিছুতেই যেন একটু বেশি বেশি। একরাতে দশ টাকার মাস্কের দাম একশো টাকা। পঞ্চাশ টাকার হ্যান্ডওয়াশ আড়াইশো টাকা। মুদির দোকানে হুড়মুড়. . .বিশৃঙ্খল নানান কায়দা-কানুনের মধ্যে রাইসুলের দম বন্ধ হয়ে আসে। সব কিছুতেই দ্বিধাদন্দ্ব। দেশপ্রেম, ন্যায়, নীতি, রীতি আদর্শ ইত্যাদির জায়গায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশটার মানুষের প্রতি তার নানান প্রশ্ন জাগে। ভেতরে একটা ঘোড়া সব সময় দৌড়ায় বিবিধ জিজ্ঞাসা নিয়ে। রাইসুল সব প্রশ্নের, সব জিজ্ঞাসার উত্তর পায় না। মিল খুঁজে পায় না কার্য আর কর্মের। মায়ের ইজ্জত, বোনের সম্ভ্রম, পিতার রক্ত, ভাইয়ের ত্যাগের বিনিময়ে যে দেশ সে দেশের প্রতি কারো যেন সঠিক কোনো দায় নেই, দায়িত্ব নেই, বোধ নেই, বিচার নেই। ছেলের হাতের মোয়ার মতো যার যখন যা ইচ্ছা তা’ই করছে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে। দেখেও না দেখারন ভান কারো কারো চোখে। যদিও রাইসুল মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। বই পড়ে, চলচ্চিত্র দেখে, ইতিহাস থেকে সে জেনেছে এই দেশ ভূমিষ্ঠের সব ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। দেশ বলতে রাইসুল বুঝে মা। মায়ের জন্য সে সব কিছু করতে পারে, দেশের জন্যও পারবে বলে তার মনে হয়। মহামারি রোগটা যেহেতু ছোঁয়াচে সেহেতু প্রবাসীরা কিছু দিন ঘরে থাকলে দোষ কোথায়! কী এমন ক্ষতি হবে এতে! তার রাগ চড়ে যায়। এসব ভাবতে ভাবতে রাইসুল বাসার কাছে চায়ের দোকানে এসে একা বসে। নিজের সাথে আনা মগে এক মগ চা বানিয়ে দিতে বলে নূরুকে। দুজন মুরুব্বিও এসে বেঞ্চিতে বসে। তাদের মুখেও করোনাভাইরাস ও দেশে ফেরৎ প্রবাসীদের নিয়ম না মানার আলাপ। সে চায়ের মগে খেয়াল দেয়। বেঞ্চিতে বসা অপেক্ষাকৃত কম বয়সি বয়স্ক লোকটি কিছুটা রাগের স্বরেই বলে- ‘‘বিদেশ ফেরৎদের আসলে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজাকারদের মতো সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে যাওয়া দরকার। আপন-স্বজন কেউ যেন খোঁজ না পায়। দরজার নিচে দিয়ে, জানালা দিয়ে ভ্যান্টিলেটর দিয়ে তাদেরকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র দেওয়া হবে।’’ অন্য খেয়ালে থাকলেও ‘‘রাজকারদের সেল্ফ কোয়ারেন্টিন’’ বাক্যটিতে রাইসুলের কান আটকে যায়। কোয়ারেন্টিন শব্দটির সাথে রাইসুল পরিচিত। এর মধ্যে গুগোল সার্চ করে এর অর্থ, উৎপত্তি, ব্যবহার, ইতিহাস জানলেও মহান মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকারের সাথে শব্দটি কিভাবে যায় তা তাকে ভাবিয়ে তোলে। রাইসুল বাসায় ফিরে কম্পিউটার অন করে আবার সার্চ করেতে থাকে। পূর্বের তথ্যই ফিরে আসে।
‘‘কিরে এতো দিন পর চাচার কথা মনে হলো?’’ রাইসুলের মেঝো চাচা প্রশ্নটি করলেন। ‘‘মনে পড়ে সব সময়ই। আসা হয় না মাত্র। তুমি কেমন আছো?’’
‘‘ভালো’’
‘‘একটা বিশেষ কাজে এসছি চাচা।’’
‘‘ভালো তো, বল কি কাজ?’’
‘‘বসো এখানে, বলছি- তুমি তো মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষকও, তুমিই তো প্রথম রাজাকারদের নাম প্রকাশ করলে। বইয়ে লিখলে কোন রাজাকার কোথায় লুকিয়ে আছে। আচ্ছা বলো তো চাচা, সেল্ফ-কোয়ারেন্টিন শব্দটির সাথে মুক্তিযুদ্ধ বা রাজাকারদের কী সম্পর্ক!’’
‘‘ ও আচ্ছা: সেল্ফ কোয়ারেন্টিনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে রাজাকারদের। লাখ লাখ লাশ আর রক্তের উপর দিয়ে ঊনিশো একাত্তর সালের ডিসেম্বরে যখন দেশ স্বাধীন হলো, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো, বাংলাদেশের জন্ম হলো তখন ওই পাকিস্তানিদের দোষর, রাজাকার-আলবদর-আলসামস্রা কেউ এলাকা ছাড়ে, কেউ দেশ ছাড়ে, কেউ ভিন্ন শহরে ঘরের ভেতর একঘরে হয়ে যায় অর্থাৎ সেল্ফ-কোয়ারেন্টিনে চলে যায়; কেউ যেন তাদের কোনো খোঁজ না পায়। আলো-বাতাসও যেন জানতে না পারে তারা কোথায় আছে। অনেকে পরবর্তী সময়ে লুকিয়ে পাকিস্তানও চলে যায়, অনেকের পট পরিবর্তন হলেও অনেকে ওইভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দেয়।’’ রাইসুলের মাথাটা টং করে ওঠে। চাচার কথাগুলোর সাথে মিলে যায় তার বাবার চরিত্র। রাইসুল বুঝের হবার পর থেকে তার বাবা হারিস মোল্লাকে সে কখনো দেখেনি তাদের বাড়ির একটি ঘর ছেড়ে কখনো বাহির হতে। নাওয়া-খাওয়া ওই একটা ঘরের ভেতরই। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিয় কোনো কাজে কখনো তাকে হাজির থাকতে দেখা যায় না। মায়ের কাছে জানতে চাইলেও সঠিক উত্তর পাওয়া যায় নি কখনো। অনেক আগে থেকেই বিষয়টি সন্দেহের মনে হয়েছে রাইসুলের । উপযুক্ত কারণ পায়নি সে কখনো।
‘‘আচ্ছা চাচা, একটা সত্য কথা বলবে; তুমি তো মুক্তিযুদ্ধা, তুমি তো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, তুমি তো সত্যের জন্য লড়াই করেছো, বাবা কি রাজাকার?’’
‘‘আমি জানি না।’’
‘‘তবে বাবাও তো আজীবন সেল্ফ-কোয়ারেন্টিনে! কেন? রাজাকার না হলে ঘর থেকে বের হন না কেনো? মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে, বাবা কোথায় ছিলো?’’
‘‘আমি জানি না।’’ . . .রাইসুল একঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘‘মা, বাবা কি রাজাকার ছিলো?’’
‘‘আমি জানি না।’’
“কে জানে?’’
‘‘জানি না।’’
মিলে যায় উত্তর। রাইসুল এবার দাঁড়ায় তার বাবা হারিস মোল্লার মুখোমুখী। ‘‘বাবা, তুমি কি রাজাকার ছিলা?’’ হারিস মোল্লার বয়স্ক মুখটা মাঘের বিকালে ঝরা কাঁঠাল পাতার মতো মুহূর্তে রেখাময় হয়ে ওঠে। পাকা ডালিমের মতো টকটকে লাল হয়ে ওঠে চোখজোড়া তার। ঠোঁটজোড়া কাঁপতে থাকে। যে প্রশ্ন এত এত বছর কেউ করেনি। সে প্রশ্ন নিজ সন্তানের মুখে! হারিস মোল্লা নিশ্চুপ, কাঁপতে থাকে ভেতরে। রাইসুল ক্রোধে আবার প্রশ্ন করে, ‘‘সত্যি তুমি রাজাকার ছিলা।’’
‘‘জানি না।’’
‘‘জানো না?’’
‘‘না।’’
রাইসুল এক ভান্ডিল চিঠি হারিস মোল্লার মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। চিঠির ভাষা উর্দু। সেই সাথে একজন মাদ্রাসার শিক্ষক দিয়ে অনুবাদ করে আনা বঙ্গানুবাদও। সবগুলো চিঠির নিচে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ক্যাম্পের মেজরের নাম, দস্তখত! কোনো কোনোটার নিচে সিল। চিঠির ভাষায় লেখা- কখন কোন গ্রাম পুড়িয়ে দিতে হবে। কখন কাকে ক্যাম্পে তুলে আনতে হবে। কোন রাতে কতজন তরুণী মেজরদের বিলিয়ে দিতে হবে। খুনের, ধর্ষণের, বর্বরতার সুনীল বর্ণনাও আছে কোনো চিঠিতে। হরিস মোল্লা থ’খেয়ে যায়। কোথায় পেলো রাইসুল এ চিঠিগুলো! তবে কি মনের ভুলেই সত্য রয়ে গেলো সত্যের কাছাকাছি?
রাইসুল এবার একবার চিঠিগুলোর দিকে তাকায়। একবার তার বাবার দিকে তাকায়। একবার টেবিলে রাখা ছুরিটার দিকে তাকায়। রাইসুলের চোখে ভাসতে থাকে সিনেমার দৃশ্যের মতো ইতিহাসের কথাগুলো। খুনের, ধর্ষণের, লুটের, বীভৎসতার কুৎসিত ছবিগুলো। রাইসুলের পেট’টা গুরগুর করে ডাকতে থাকে। নাড়িভূড়ি এক হয়ে আসার মতো তার বমি আসে। রাইসুল বমিটা আটকে রাখতে চায়। বমিটা বুক পর্যন্ত উঠে আসে। রাইসুল আরও চেপে রাখতে চায়। বমিটা গলা ছাড়িয়ে জিহ্ব পর্যন্ত চলে আসে। রাইসুল ওয়াৎ করে তার বাবার উপর বমি করে দেয়। হারিস মোল্লা মা’গো করে কয়েক পা পিছিয়ে হেলে পড়ে আলমিরার উপর। রাইসুল বিকট শব্দে ‘ওয়াক থু’ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মেঝেতে পড়ে থাকে ছুরিটা। শাদা ছুরিটার রঙ এখন লাল।


জোবায়ের মিলন
বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি, ঢাকা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top