সিডনী সোমবার, ২০শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বর্ষায় প্রস্থান মন তবে কেন কাঁদবে? : ইমরুল কায়েস


প্রকাশিত:
২২ জুলাই ২০২০ ২২:১৪

আপডেট:
২২ জুলাই ২০২০ ২২:৩০

 

গল্প দিয়ে কথা ও গল্পের যাদুকর হুমায়ূন আহমেদ কে স্মরণ না করলে একটা কিছু অপূর্ণই থেকে যায়! হাতটা যেন কেমন নিশপিশ করছে। ২০১৫ সালের ৩৫ তম বিসিএসের বাংলা লিখিত পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ছিলো এমন বাংলাদেশে কেন সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ কম হয়? কয়েকটি সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের লোকজ সংস্কৃতির ব্যাখ্যা দিন? প্রশ্নটির উত্তর লিখেছিলাম নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ দিয়ে। এর চেয়ে ভালো লোকজ উপাদান নিয়ে তৈরী আর কোন সিনেমা আমার জানামতে আর একটিও তৈরী হয়নি। নদী, নারী, জল, আর যৌবন যে কতটা নিবিড় উপাদান লোকজ সংস্কৃতির! বিশেষ করে লোক গীতিতে আছে তার শেষ নেই। অনুপম সব চলচ্চিত্রের স্রষ্টা, জীবন সায়াহ্নে দূর পরবাসে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও যিনি আমাদের জন্য কথার মালা গেথেছেন; সেই মানুষটি আজ এই দিনে আমাদের ছেড়ে প্রয়াত। তাঁর জন্য পুরো জগতের একমাত্র আধিকারিকের কাছে প্রার্থনা ছাড়া আমাদের মতো পাঠকের আর কি বা দেবার আছে? রসায়নের মতো কাটখোট্টা শাস্ত্রের ছাত্র ও অধ্যাপকের মাথায় এতো সব বিলাসী চিন্তা কেমনে এসেছে তাঁর সুলুক সন্ধান করে এখনো হুমায়ূন মুলুকের তলা পাইনি। আহমদ শরীফ নন্দিত নরকের ভূমিকায় যেমনটি বলেছিলেন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ভালো ছাত্র। কিন্তু ও যে (হুমায়ূন আহমেদ) এতো ভালো গল্প লিখিয়ে তা বোঝা গেল এ রচনা পাঠের পর।’
পাকিস্তানের বিখ্যাত ডন পত্রিকা যাঁকে বলেছে ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কিংবদন্তী’ তিনি আর কেউ নন। আমাদেরই হুমায়ূন আহমেদ। তিনি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের পপুলার সংস্কৃতির বা লোকরঞ্জক একজন প্রবাদ প্রতীম পুরুষ। স্বাধীনতার পূর্বে ও দেশভাগের আগে এবং পরে বাংলা কথাসাহিত্যে একচেটিয়া আধিপত্য ছিলো পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিকদের। একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ এই ধারাটিকে ভেঙ্গে এপার বাংলার সাহিত্যের একটি আলাদা জগত ও পাঠক তৈরী করে গেছেন। তাইতো ওপার বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্য ব্যক্তি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন ‘আহমেদ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে জনপ্রিয়’।
পশ্চিম ও পূর্ববাংলায় মানিক বাবু, সুনীল ও সমরেশ মজুমদারের বইয়ের ছিলো ছড়াছড়ি। সাহিত্যের কোন মালিকানা না থাকলেও কেন জানি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদেরও একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিকের খুউব দরকার ছিলো। ঠিক যুদ্ধোত্তর বিরহি, ক্ষুধিত ও এতিম পাঠকের জন্য একজন কথাসাহিত্যিকের আবির্ভাব হয় প্রথম নন্দিত নরকে নামক নাতি দীর্ঘ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। তিনিই হুমায়ূন আহমেদ। এজন্যই বলেছি যে আমাদেরই হুমায়ূন আহমেদ।
ছাত্র অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে এমন একটি অনিন্দ্য কথা সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর এই প্রথম উপন্যাসটির প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন আর একজন প্রবাদ পুরুষ আহমদ ছফা, বইটির প্রচ্ছদ একেঁছিলেন তারই আপন অনুজ আর একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাহিত্যিক জাফর ইকবাল আর বইটির ভূমিকা লিখেছেন আহমদ শরীফ। জীবনে আর কি লাগে? প্রকাশিত প্রথম উপন্যাসে বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গণের তিনজন আজন্ম গুণীর ছোঁয়া কয়জনই বা পায়!।
পৃথিবীর একটি মাত্র দেশ যার পতাকার বুকের মাঝে লাল সূর্য আছে ঠিক তেমনি এদেশের সাহিত্যের সবুজ জমিনে একমাত্র এবং প্রথমে অদ্বিতীয় উজ্জ্বল ও স্বলেখনীর জোড়ে জ¦ল জ¦ল করছেন নিরত। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সব রকমের পাঠকের কাছে এতোটা পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র হুমায়ূন সাহিত্যের কপালে জুটেছে।
নরক শব্দটি একটি বিভৎস শব্দ! তার আগে একটি সুন্দর শব্দ নন্দিত যে বসতে পারে খুব সহজে আর এটিকে বসানোর শৈলী যার আয়ত্ত্বে ছিলো সেই কথার যাদুকর আমাদের ছেড়ে প্রয়াত হয়েছেন ১৯ জুলাই ২০১২ সালে শারীরিকভাবে কিন্তু বেঁচে আছেন শাশ্বত কথামালায় প্রতিদিনের শতদল হয়ে অগুনতি পাঠকের হৃদ সিংহাসনে।
বৃষ্টি বিলাস, জোছনা বিলাস এমনকি সমুদ্র বিলাসের জন্য সেন্টমার্টিনে তাঁর নিজস্ব রিসোর্ট-সমুদ্র বিলাস আরো আছে জোছনা বিলাস। চাঁদনী পসরে কে আমায় স্মরণ করে; কে আইসা দাড়াইছে গো আমার দুয়ারে? এমন গানের কথা আর দ্বিতীয়টা কোন চলচ্চিত্রে নেই। তাঁর দক্ষিণা হাওয়ার বাড়িতে এখনো কি জোছনার আলোয় বৃষ্টি বিলাস চলে? চলে তো অবশ্যই। শুধু আমরা সাদা চোখে দেখতে পাই না এই আর কি। এ কথার উত্তর তাঁর গানেই আছে আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা চালা ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে/অবাক জোছনা ঢুইকা পরে; হাত বাড়াইয়া ডাকে।
‘বিলাস’ শব্দটা হুমায়ূন আহমেদের খুব আপন ও একান্ত আপনার। কেননা তাঁর ভাষার বিলাসে যে এতো চমৎকার সব সাহিত্য কর্ম রচনা হয়েছে। স্বপ্ন, কল্পনা আর শব্দ নিয়ে বিলাসী না হলে আদৌও কেউ সাহিত্যের চৌকাঠ মাড়াতে পারবে না এ শতভাগ নিশ্চিত। এদিকটায় হুমায়ূন আহমেদ ষোলো কলায় পরিপূর্ণ। কেননা সৃজনশীল, মননশীল আর পারফরম্যান্স আর্ট এ তিনি পরিযায়ী না হয়ে পরিশীলিত আধার হয়ে আছেন। চলচ্চিত্র, নাটক আর গল্প-উপন্যাসে জনতুষ্টি বা সর্বজনীন উদাহরণ তাঁর সৃষ্টি কর্ম সমূহ।
নরককেও নন্দিত করার এই কারিগর গান রচনা করেও তুমুল জনপ্রিয়। তাঁর পরিচালিত শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এই চলচ্চিত্রের সর্বাধিক শ্রোতা প্রিয় গান একটা ছিলো সোনার কন্যা মেঘ বরণ কেশ/ ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ। লোকজ সংস্কৃতির আশ্রয় নিয়ে এমন গীত রচনা বিস্তৃত বাংলার মাটির সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে।
কথাসাহিত্যে জনপ্রিয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার, দেবী, আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও দুই দুয়ারি চলচ্চিত্রায়ণও ব্যাপক দর্শকপ্রিয় হয় এবং পুরস্কার পেয়েছে। শব্দের খেলায় নন্দিত হয়ে নাটকে দেখিয়েছেন আরেক নৈপূণ্য। হুমায়ূন আহমেদের নাটক মানে শুধু নাটক নয় যেন মধ্যবিত্ত জীবনের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। অয়োময়, আজ রবিবার, এই সব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি ও জননী এখনো সমান তালে যুগপ্রিয়। নাট্যকার, নির্দেশক, পরিচালক ও গীত রচনা কারীর জন্য তিনি অনুকরণীয়। দারুচিনি দ্বীপ, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল, কৃষ্ণপক্ষ এবং সর্বশেষ ঘেটুপুত্র কমলা এক একটি মাস্টার পিস কি নির্মাণে, কি গীত রচনায়, কি অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচনে তিনি সবার থেকেই এগিয়ে। কথা সাহিত্য থেকে নাট্যকার আবার বৃহৎ পরিসরে পর্দায় সেই চরিত্র গুলোকে নিখুঁত ভাবে গতি দিয়ে তিনি শেষ চলচ্চিত্রেও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার বিভাগে দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন এবং ১৫ তম মেরিল-প্রথম আলো সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকের পুরস্কার পায়।
কথার কথক থেকে নাটকে তারপর সিনেমায় তিনিই সব তাঁর গল্প, তাঁর গান, তাঁর চিত্রনাট্য, তাঁর প্রযোজনা ও তাঁরই পরিচালনায় তুমুল দর্শক প্রিয় এই সব আর্টে মনে হয় এক হুমায়ূনের বহুরুপ! যেমনটি নানা রবীন্দ্রনাথের একখানি মালা। নান্দনিক এই শব্দ শৈলীর কারিগরকে আমরা আজো পাই তাঁর জননী নাটকে। বছরে, মাসে কিংবা দিনে মোবাইলে ইউটিউবে এখনো শুনি যদি মন কাঁদে/ তুমি চলে এক বরষায়.../এই বরষা বিলাসী মানুষটি চলেও গেছেন বর্ষাকালে। বর্ষায় যায় ইহলোক থেকে পরলোকে প্রস্থান তাঁর মন কেন কাঁদবে? বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রোধ করার মতো আন্দোলনে আবারো শরিক হবে তাঁরই অজস্র হিমু।
ছোট, সহজ ও খন্ড বাক্যে ছোট তিন-চার ফর্মার উপন্যাস লিখে পেছনের সব ভারি ভারি রচনাকে টপকে বিশের দশকে একক স্থান করে নেয়া এই কথার মালি যেন সত্যি তাঁর গীতের মতো জীবনে এক আচানক কলম খুঁজে পেয়েছিলো সোহাগ পুর গ্রামে একটা মায়া দিঘী ছিলো/ সেই দিঘীতে হায়; আচানক একটা পুষ্প ফুটে ছিলো। প্রকৃতির রুপ বিলাসী এই কথা-কথক সত্যিই একজন কলম কারিগর ও ক্যামেরার নিউরণ তাঁর সবার থেকে আলাদা ছিলো। এক হুমায়ূন বহু হলুদ হিমু হয়ে আমাদের মাঝে থাকবে চির অমলিন। হুমায়ূনের গানেই আমাদের শেষ চাওয়া ও কারিগর; দয়ার সাগর/ ও গো দয়াময়/ চাঁদনী পসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়...।


ইমরুল কায়েস
গল্পকার ও সরকারি কর্মকর্তা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top