বাংলা সাহিত্যে মহামারীকাল : ইয়াকুব মালিক


প্রকাশিত:
২৩ জুলাই ২০২০ ০০:১২

আপডেট:
২৩ জুলাই ২০২০ ০০:১৩

 

করোনার প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষ এখন উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। তবে এমন বিড়ম্বিত  জীবন এবং বিপন্ন সময় মানব ইতিহাসে নতুন নয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে দেশে দেশে এমন ঘাতকব্যাধি মহামারী রুপে মানুষকে আঘাত করেছে বার বার। মারি ও মড়ককালের সেই দুর্বিষহ জীবনচিত্রের চমকপ্রদ বিবরণ রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। এমনকি সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টিন জাতীয় শব্দগুলোও  মোটেও নতুন কিছু নয়। সেকালের দারিদ্র্যপীড়িত এবং পশ্চাৎপদ সমাজের মানুষের আচরণ, সামাজিক প্রতিক্রিয়া এবং মহামারী বিতাড়নে তাদের উদ্যোগ ও সামগ্রিক বৈশিষ্টের সাথে বর্তমান সময়ের মানুষের করোনাকালীন বৈশিষ্টের বিস্ময়কর সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। উল্লেখ্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি, বুদ্ধিবৃত্তিক সচেতনতা, সাংস্কৃতিক বোধ ও মানবিক চেতনা প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হলেও মৌলিক আচার-ব্যবহার বা স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যে দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন আসে নি।

এখন আমরা দেখছি নিজ বাড়ির সিঁড়িতে লাশ পড়ে আছে স্ত্রী সন্তান কেউ ধরছে না। মাকে জঙ্গলে ফেলে সন্তান পালাচ্ছে। এমনকি দাফন বা সৎকার করার লোকও নাই, চিকিৎসককে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বহুবছর মিলেমিশে একসাথে বসবাসরত প্রতিবেশী পরস্পরের অচেনা হয়ে যাচ্ছে। শতবর্ষ আগেও পরিস্থিতি প্রায় এমনই ছিল। বাংলা সাহিত্যে এর চমৎকার উদাহরণ রয়েছে।

জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে পরীর দিঘি কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রামটিতে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটলে গ্রামবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অজানা আতঙ্ক:

গাঁয়ের মুরব্বি মকবুল বুড়ো বেয়াই বাড়ি হতে এসে ভর সন্ধাবেলা নিজ বাড়ির সকলকে সমবেত করে। তারপর গায়ের ফতুয়াটা খুলতে খুলতে বলে, ‘ বাপু তোমরা সক্কলে একটু সাবধানে থাইকো। ও বিন্তির মা, বঁইচির মা শোনো, তোমরা একটু সাবধানে থাইকো। গেরামে ওলা বিবি আইছে।’

‘ ইয়া আল্লা মাপ কইরা দাও। আতঙ্কে সবাই শিউরে উঠলো। কোনহানে আইছে ওলা বিবি? কোন বাড়িতে আইছে?’ জানতে চাইল গনু মোল্লা।‘ মাঝি বাড়ি ’- মকবুল বুড়োর জবাব। ‘মাঝি- বাড়ি?’ একসঙ্গে বলে উঠলো সবাই।

কয়জন পড়ছে? তিনজন। বাড়ির সবাইকে আরেক প্রস্থ সাবধান করে দিলো মকবুল, তোমরা সক্কলে একটু সাবধানে থাইকো বাপু। একটু দোয়া দরুদ পইড়ো। বলে খড়মটা তুলে নিয়ে ঘাটের দিকে চলে গেলো সে।

 

অন্যদিকে, আসন্ন এ মহাবিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য টুনি তার প্রিয়জন মন্তুকে প্রথমে প্রশ্ল করে, ‘মাঝি বাড়ি যাও নাই তো? পরে প্রাণের আকুতি মিশিয়ে বলে, ‘শোন, ওই বাড়ির দিকে গেলে কিন্তুক আমার মাথা খাও। যাইও না কিন্তু।’

আপন প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সামাজিক সম্পর্ক বা কুটুম্বিতা এড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে পলায়নের নির্মম ও কৌতুকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে ঐ উপন্যাসে। দীঘির পাড়ে মন্তু শেখের ভাই ঝি জামাই তোরাবের সঙ্গে দেখা হয় মন্তুর। পরনে লুঙ্গি আর কুর্তা। হাতে লাঠি বগলে একজোড়া পুরনো জুতো। মন্তুকে দেখে প্রসন্ন হাসির সঙ্গে তোরাব প্রশ্ন করলো,‘কী মিয়া খবর সব ভালো তো?’ মন্তু নীরবে ঘাড় নাড়লো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘কই যাও শ্বশুরবাড়ি বুঝি?’ হুঁ, তোরাব শ্বশুর বাড়িতেই যাচ্ছে। কাজকর্মের ফাঁকে অনেকদিন আসতে পারেনি, খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। তাই সুযোগ পেয়ে একবার সকলকে দেখে যেতে এসেছে সে। হাত- পা ধুয়ে জুতোজোড়া পরে আবার উপরে উঠে এলো তোরাব। পকেট থেকে চিরুনি বের করে নিয়ে বললো, ‘মাঝি বাড়ির খবর জানেন নাহি, সক্কলে ভালো আছে তো?’

মন্তু বললো, ভালো তো আছিলো, কিন্তুক একটু আগে শুনছি, ওলা লাগছে।

‘ওলা?’ তোরাব যেন আঁতকে উঠলো। হঠাৎ থেমে গেলো তোরাব। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো, তারপর পায়ের জুতোজোড়া খুলে আবার বগলে নিতে নিতে বললো ‘এই দু:খের দিনে ওনাগোরে কষ্ট দেয়নের কোনো মানি অয়না মিয়া, ফিইরা যাই।’ এই বলে যে পথে এসেছিলো সে পথে দ্রুতপায়ে আবার ফিরে চললো তোরাব।

এদিকে মাঝিবাড়িতে লাশের পর লাশ পড়ছে। অস্ফুট কান্না-গোঙানির মধ্য দিয়ে মাঝি বাড়িতে লাশের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দাওয়ার ওপর ঠায় দাঁড়ানো মন্তুকে দেখে ঐ বাড়ির ছমির শেখ দুহাতে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো।‘ এই কী মুছিবত আইলো মিয়া, আমরা বুঝি এইবার শেষ অইয়া যামু।’ এর আগে ছমির শেখ, পরিবারের ছেলেমেয়ে সবাইকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বুড়োরা মরে গেলেও ছেলে মেয়েগুলো যাতে বাঁচে। নইলে বাপ-দাদার ভিটার ওপর বাতি দিবার কেউ থাকবে না।

বর্তমানের করোনা অনুজীবের মতো ঐ সময়ও শত্রু ছিল অদৃশ্য। ভেদবমি শুরু হয়ে দুই-এক দিনের মধ্যেই মৃত্যু। মানুষ তখন জানতো না-কলেরা প্রধানত পানিবাহিত রোগ। এই ঘাতক অনুজীবের নাম দিয়েছিল তারা ‘ওলাবিবি’।

এখন করোনা আক্রান্ত মানুষ আছে জানলে সে বাড়ির বাসিন্দাদের প্রতি অন্যদের আচরণ যেমন সেকালেও অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল।

জহির রায়হানের উপন্যাসে দেখি-

ওলাবিবি তথা কলেরাক্রান্ত মাঝিবাড়ি থেকে ফিরে আসলে নিজবাড়ির মুরুব্বি মকবুল বুড়োসহ অন্যরা ছেকে ধরে মন্তুকে। মকবুল বলে, ‘কিরে নবাবের বেটা, তোরে একশবার কই নাই, মাঝি বাড়ি যাইস না, গেলি ক্যান অ্যাঁ?’ বাড়ির সবচেয়ে নিরীহ মানুষ গনুমোল্লাও উত্তেজিত হয়ে বলে- ‘আককেল পছন্দ নাই তোর,’ আর সুরত আলী বলে,-‘বাড়ির কারো যদি এহন কিছু অয় তাইলে কুড়াইল মাইরা কল্লা ফালাইয়া দিমু তোর।’

রবীন্দ্রনাথের শেষের রাত্রি গল্পে অসুস্থ যতীনকে ছেড়ে তার স্ত্রী ছোট বোনকে দেখার নাম করে বাপের বাড়ি চলে যায়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসসহ আরও কিছু লেখায় মহামারী বা প্লেগ রোগের প্রসঙ্গ এসেছে।

তবে মহামারীর সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা আছে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসে। শ্রীকান্তরূপী শরৎচন্দ্র তখন সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে সাধুদের দলে যুক্ত হয়ে ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে বিচরণ করছেন, তো- ‘একদিন সন্ধার প্রাক্কালে যে জায়গায় আমাদের আড্ডা পড়িল তাহার নাম ছোট বাঘিয়া। আরা স্টেশন হইতে ক্রোশ-আষ্টেক দূরে।’ সকালবেলা শোনা গেল, এই ছোট-বড় বাঘিয়া ত বটেই, আরও পাঁচ-সাতখানি গ্রামের মধ্যে তখন বসন্ত মহামারীরুপে দেখা দিয়াছে। দেখা গিয়াছে যে, গ্রামের এই সকল দু:সময়ের মধ্যেই সাধু-সন্ন্যাসীর সেবা বেশ সন্তোষজনক হয়। সুতরাং সাধুবাবা অবিচলিতচিত্তে তথায় অবস্থান করিবার সন্কল্প করিলেন।’

শীঘ্রই ‘একটুখানি ধুনির ছাই এবং দু ফোঁটা কমন্ডুলুর জলের পরিবর্তে যে সকল বস্তু হুহু করিয়া ঘরে আসিতে লাগিল তাহা সন্ন্যাসী-গৃহী-কাহারও বিরক্তিকর হইতে পারে না।’

তবে অল্পদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি বিশেষ সুখপ্রদ রইলনা, কারণ- ‘মারী এইবার প্রকৃতই মহামারীরুপে দেখা দিলেন। এ যে কি ব্যাপার, তাহা যে না চোখে দেখিয়াছে, তাহার দ্বারা লেখা পড়িয়া, গল্প শুনিয়া বা কল্পনা করিয়া হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভব। লোক পলাইতে আরম্ভ করিল- ইহার আর কোন বাচবিচার রহিল না। যে বাড়িতে মানুষের চিহ্ন দেখা গেল, সেখানে উঁকি মারিয়া দেখিলেই চোখে পড়িতে পারিত শুধু মা তার পীড়িত সন্তানকে আগলাইয়া বসিয়া আছেন।’

‘মারী সত্যই মহামারীরুপে দেখা দিলে সন্ন্যাসী দল স্থান ত্যাগ করে ভিন্ন গন্তব্যে যাত্রা করে। কিন্তু সেখানকার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি রামবাবু এবং তার স্ত্রীর সনির্বন্ধ অনুরোধে, তাদের সন্তানদের দোহাই দিয়ে (ইতোপূর্বে তাদের সন্তান দুটি শ্রীকান্তের শুশ্রূষায় মারি থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছিল) পায়ে পড়ে ধর্ণা দেয়ার প্রেক্ষিতে লেখক সাধুবাবার সাথে না গিয়ে রাম বাবুদের সেবায় তাদের বাড়িতেই থেকে যান।

কদিন পর শ্রীকান্ত নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েকদিন পরে - ‘অনেক রাত্রে রামবাবুর স্ত্রী বাহিরের ঘরে ঢুকিয়া বলিলেন, সন্ন্যাসী দাদা, তুমি কেন আমাদের সঙ্গেই আরা পর্যন্ত চল না?’ ......আমি কহিলাম, ‘আমার হাটবার যে ক্ষমতা নেই দিদি! সকাল থেকেই বেশ জ্বর এসেচে।’

‘জ্বর! বল কি গো?’ বলিয়া উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই আমার নূতন ভগিনী মূখ কালি করিয়া প্রস্থান করিলেন। কত্ক্ষণ পরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম বলিতে পারি না। জাগিয়া উঠিয়া দেখিলাম, বেলা হইয়াছে, বাড়ির ভিতর ঘরে ঘরে তালা বন্ধ- জন প্রাণী নাই।’

মহামারী কালে লাশের কি অযত্ন হয় তার পরিচয় আছে শ্রীকান্ত প্রথম পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে:

ইন্দ্রসহ শ্রীকান্ত রাতের বেলা মৎস্য শিকারে বেরিয়েছে। কিছু সময় পর ‘কেমন একটা দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে হাওয়ার সঙ্গে নাকে আসিয়া লাগিতেছিল। এখন হঠাৎ একটা দমকা বাতাসের সঙ্গে সেই দুর্গন্ধটা এমন বিকট হইয়া নাকে লাগিল যে, অসহ্যবোধ হইল। নাকে কাপড় চাপা দিয়া বলিলাম, নিশ্চয় কিছু পচেছে ইন্দ্র! ইন্দ্র বলিল, মড়া। আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই ত পোড়াতে পারে না- মুখে একটুখানি আগুন ছুইয়ে ফেলে দিয়ে যায়। শিয়াল-কুকুরে খায় আর পচে। তারই অত গন্ধ।’ এসময় তাদের নৌকার সাথেই লাগে একটি শিশুর লাশ। লেখকের বর্ণনায়- ‘অকাল মৃত্যু বোধ করি আর কখনো তেমন করুণভাবে আমার চোখে পড়ে নাই। .......... একটি গৌরবর্ণ ছয়-সাত বছরের হৃষ্টপুষ্ট বালক- তাহার সর্বাঙ্গ জলে ভাসিতেছে, শুধু মাথাটি ঘাটের উপর। শৃগালেরা বোধ করি জল হইতে তাহাকে এইমাত্র তুলিতেছিল, শুধু আমাদের আকস্মিক আগমনে নিকটে কোথাও গিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে।’

শরৎচন্দ্রের যাযাবর জীবন বহুলাংশে ধরা আছে তাঁর শ্রীকান্ত উপন্যাসের পর্বগেুলোতে। তাঁর ব্রহ্ম দেশে( অধুনা মিয়ানমার) গমনের বিবরণে দ্বিতীয় পর্বের তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা পেয়ে যাই বর্তমান করোনা পরিস্থিতির সেকালের চিত্র। তখনকার রোগটির নামছিল প্লেগ। এখন যেমন বিমানবন্দর, স্থলবন্দর বা অন্যান্য পারাপারের স্থানসমূহে করোনার প্রাথমিক উপসর্গ পরীক্ষা করে স্থান বা দেশ ত্যাগের ছাড়পত্র দেয়া হয় তেমনি লেখক বার্মা গমনের উদ্দ্যেশ্যে কলকাতার জাহাজ ঘাটে আসার পর জানতে পারলেন সকল যাত্রীকেই ডাক্তারি পরীক্ষায় পাস করতে হবে। এ পরীক্ষার নাম‘ পিলেগ্ কা ডগ্ দরি’। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবেই জাহাজে চড়া যাবে। কথাটা হলো বার্মা মুলুকে তখনো প্লেগ যায় নাই, পাছে ভারতীয় যাত্রীদের মাধ্যমে এ রোগ বার্মায় চলে যায়- তাই এ সতর্কতা।

এ গেল দেশ ত্যাগের পূর্বের পর্যায়। ‘পিলেগ কা ডগ্ দরি’ পাস করে চড়লেন জাহাজে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে দীর্ঘ জলপথ পাড়ি দিয়ে বার্মা উপকূলে পৌছালো জাহাজ। ‘কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, ‘কেরন্টিন!’ খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা Quarantine'. বাংলাসাহিত্যের পাঠক সম্ভবত কোয়ারেন্টাইন শব্দটির সাথে পরিচিত হলেন প্রথমবারের মতো।

বর্তমান কোয়ারেন্টাইনের সাথে সেকালের কোয়ারেন্টাইনেরও বেশ মিল লক্ষ্ করা যায়। মূল শহর থেকে আট/দশ মাইল দূরে কাঁটাতারের বেড়াঘেরা একটি স্থানে অনেকগুলো কূঁড়েঘর তৈরী করা আছে, সেসবের মধ্যে দশদিন বাস করার পর ছাড়পত্র পেলে তবে শহরে প্রবেশাধিকার পায়। তবে শতপ্রচেষ্টা সত্তেও মহামারীর বিস্তার রোধ করা সম্ভব হয়নি। লেখকের রেঙ্গুন প্রবাসের কিছু কাল পরের ঘটনা।

‘এমনি সময়ে হঠাৎ একদিন শহরের মাঝখানে প্লেগ আসিয়া তাহার ঘোমটা খুলিয়া কালো মুখখানি বাহির করিয়া দেখা দিল। হায় রে! তাহাকে সমুদ্রপারে ঠেকাইয়া রাখিবার লক্ষকোটি যন্ত্র-তন্ত্র, কতৃপক্ষের নিষ্ঠুরতম সতর্কতা- সমস্তই একমুহূর্তে একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গেল। মানুষের আতঙ্কের আর সীমা-পরিসীমা রহিলনা।’

করোনার প্রকোপ যেমন সকল ব্যক্তির মধ্যে একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখায় না তেমনি প্লেগ সম্পর্কেও সেকালে শরৎচন্দ্রের বিবরণ অনেকটা তেমন। শ্রীকা্ন্ত উপন্যাসে আছে, ‘একবাড়ির মধ্যে যে রোগের বীজ একজনকে মেরে ফেলে, আর একজনকে তা স্পর্শ

 করে না- কেন বলতে পারো?’ কহিলাম, ‘ স্পর্শ হয়ত করে, কিন্তু যে সবল সে কাটিয়া উঠে , যে দুর্বল সেই মারা যায়।’

তবে শুধু স্বার্থপরতা নয়, মহামারী কালে ভালোবাসার কথাও আছে। শরৎবাবুর সাথে সুর মিলিয়ে বলা যায়, মহামারী জীবনকে শুধু ‘ দূরেই ঠেলিয়া দেয় না, কাছেও টানিয়া আনে।’ ওলাবিবি তথা কলেরা বা প্লেগ যেমন মানুষের নিয়ন্ত্রণে এসেছে তেমনি করোনাও একদিন পরাজিত হবে মানুষের অদম্য মনোবল আর উদ্ভাবনী শক্তির কাছে। রচিত হবে করোনা কালের সাহিত্য। ভাবী কালের পাঠক করোনাপীড়িত এই দুষ্কালের দিবানিশি পাঠে উদ্বেলিত হবেন শোক তাপ আর আনন্দ বেদনায়। একাত্ম হবেন বর্তমানের করোনা কালের মানুষ ও তাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top