সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ: পুঁথি পাগল এক মহান সাহিত্য গবেষক : আরিফুল ইসলাম সাহাজি


প্রকাশিত:
২৬ জুলাই ২০২০ ২১:০৫

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৭:২৯

ছবিঃ আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ

 

জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন - ' বাতাসের মধ্যে বাস করে যেমন আমরা ভুলে যাই যে বায়ু সাগরে আমরা ডুবে আছি , তেমনি পাড়াগাঁয়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে এখানে কত বড়ো সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে । ' দুঃখের বিষয় ,বাংলার  মাঠ ঘাট  জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা  অজস্র সাহিত্য আকরের একটা বিরাট অংশের ভাগ্যে জোটেনি পাঠক সমাদর  । অনাদরে অন্ধকারেই থেকে গেছে সেই সকল বিলুপ্তপ্রায় কাব্য , কবিগণ এবং তাঁদের কাব্যিক প্রবাহ সমূহ ।  পরবর্তীতে কৌতূহলী গবেষকের অনুসন্ধানীমূলক গবেষণার ফলেই যুগের পর যুগ অবহেলিত  সেই সকল কাব্যের নব মুদ্রণ ভাগ্য জুটেছে  । যেকোন আবিষ্কারের পিছনে  গবেষকের নিষ্ঠা এবং অমানুষিক পরিশ্রম থাকে । বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন ' চর্যাপদ'  এবং পরবর্তীকালে ' শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' কাব্য নিবিড় গবেষণার  ফলেই পাঠক সমাজে  উন্মুক্ত হয়েছে । তাছাড়াও , মধ্যযুগীয় নানাবিধ মূল্যবান সাহিত্য আকর আবিষ্কারের পিছনে গবেষকগণের এক সামুদ্রিক সদিচ্ছাই  অবাক হতে হয় ।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালন ফকিরের সরাসরি সাক্ষাতের কোন বিশ্বস্ত সূত্র নেই , জানা মতে তাঁদের দেখা হয়নি তাঁদের । লালনের গানে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান সংগ্রহের জন্য ছুটে বেরিয়েছেন দিক থেকে দিগন্তে । প্রসঙ্গক্রমে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী , দীনেশচন্দ্র সেন , কবি জসিমউদ্দিনকেও স্মরণ করতে হয় । 

মুনশী আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ  , সেই  বিরলতম সাহিত্য  গবেষকদের মধ্যে একজন যাঁরা  বাংলা সাহিত্যকে ভীষণ রকম  সমৃদ্ধই করেছেন ।  যুগ যুগ লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা সাহিত্য পুথি সমূহ আবিষ্কার করেছেন ।  পুঁথি  সংগ্রহ করবার নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিলেন তিনি । পেটের অন্ন সংস্থানের একমাত্র উপায় ১৮৯৮ সালে নবীনচন্দ্র সেনের সৌজন্যে পাওয়া চট্টগ্রাম শহরে কমিশনারের অফিসে পাওয়া কেরানির চাকরি হারিয়েছেন , পুঁথি সংগ্রহের নেশায় উন্মাদ আব্দুল করিম অফিসে নিয়মিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি । পুঁথি তাঁর ধ্যান জ্ঞান কর্ম সাধনা । তাই চাকরি বিপন্ন হয়েছেন , তবুও সন্তানের মত পরম মমতায় আঁকড়ে গেছেন বাংলার ঐতিহ্যময় সব সাহিত্য আকর । 

১৮৭১ -১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৮২ বছরের বর্ণময় জীবনের সিংহভাগটাই তিনি ব্যয় করেছিলেন পুথি সংগ্রহের নিমিত্ত । 

একপ্রকার পুথি পাগল মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই । ইংরেজি সাহিত্যের আদলে বাংলা সাহিত্যের একটা সময়ের উপর কল্পিত অন্ধকার অর্থাৎ মুসলিম শাসন আমলে উল্লেখযোগ্য  সাহিত্য আকর রচিত হয়নি বলে যে কথন প্রচলিত আছে , সেই সাইলেন্স অব কনফিরেসকে খণ্ডন করে শ্রদ্ধেয় আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারতের আবিস্কৃত মূল্যবান পুথি সমূহ । পুঁথি পাগল মানুষটির অকৃত্রিম প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য শুধুমাত্র সমৃদ্ধই হয়নি , প্রায় ৪০০ বছরের সাহিত্য আকর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পেয়েছে । আবিস্কৃত পুথি সমূহের মধ্যে রয়েছে  নাথ সাহিত্য , সুফি সাহিত্য , প্রণয়োপাখ্যান , জঙ্গনামা বা যুদ্ধ কাব্য , মুসলিম ধর্ম সাহিত্য , মুসলিম কবিগণের রচিত বৈষ্ণব তত্ত্বরিক্ত রাধাকৃষ্ণ পদ এবং অবৈষ্ণব চরিত সাহিত্য । বাংলা সাহিত্যের প্রায় দেড়শতাধিক কবিকে আবিষ্কারের কৃতিত্ব একা তাঁর । আবিস্কৃত কবিগণের মধ্যে প্রসিদ্ধতম নামগুলির মধ্যে রয়েছে - পনেরো শতকের কবি শাহ মোহাম্মদ সগির , ষোল শতকের দৌলত উজির বাহরাম খান , সৈয়দ সুলতান , শেখ ফয়জুল্লাহ , দ্বিজশ্রীধর কবিরাজ , কবিন্দ্র পরমেশ্বর , শ্রীকর নন্দী , গোবিন্দ দাস । সতেরো শতকে দৌলত কাজী , কুরাইশি মাগন ঠাকুর , সৈয়দ আলাওল , আঠারো শতকের কবি আজী রাজ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য । 

পুথি সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কররকম অসাম্প্রদায়িক সত্ত্বার অধিকারী । মনের টানে তিনি পুঁথি সংগ্রহ করেছেন । পথি সংগ্রহের জন্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম , এক স্থান থেকে স্থানে ছুটে বেরিয়েছেন । কারও কাছ থেকে পুথি ভিক্ষা করেছেন , কারও কাছ থেকে নিজ কষ্টে অর্জিত অর্থ দিয়ে ক্রয় করে নিয়েছেন । পুথি সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি ধর্ম বর্ণ জাতি দেখেননি । তাঁর আবিস্কৃত কবিদের মধ্যে ত্রিশজনেরও বেশি হিন্দু কবি রয়েছেন , যাঁদের পুথি ও পদের প্রথম আবিষ্কারক ছিলেন আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারত । তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানস বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে ড. আহমেদ শরীফ ( ভ্রাতুষ্পুত্র ) এক আলোচনায় লিখছেন , ' শত সংকটে - অপবাদ - অপমাননাতে ও পুথির নেশা কখনও ছাড়তে পারেনি । আর পুথি ও সংগ্রহ করেছেন অভেদে , তাঁর আগে এমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কেউ পুথি সংগ্রহ করেননি । ' কাকাকে মহিমান্বিত করবার জন্য ড. শরীফ এমন কথা লিখেছেন , এমন ভাবলে শুধু ভুল নয় , অন্যায় করা হবে । আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারতের অবদান প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ' রাধিকার মনোভঙ্গ ' বইয়ের  মুখবন্ধে লিখলেন , ' তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পদনাকার্যে যেরুপ পরিশ্রম , যেরুপ কৌশল , যেরুপ সহৃদয়তা ও যেরুপ সুক্ষদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন , তাহা সমস্ত বাংলায় কেন , সমস্ত ভারতেও বোধহয় সচরাচর মিলে না । এক একবার মনে হয় যেন কোনো জর্মান এডিটর এই গ্রন্থ সম্পদনা করিয়াছে । '

আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের মত পুথি সংগ্রহের এ বিরাট আগ্রহ অন্য কারও মধ্যে আর দেখতে পাওয়া যায় না । তাঁর আবিস্কৃত সকল পুথিগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি বলে অনেকেরই মত । ছোট বড় পত্রিকায় ছাপা তাঁর সাহিত্য বিষয়ক অভিভাষণগুলোও সংকলিত হয়নি । অনেক অভিভাষণ হাতে লেখা অবস্থায় তাঁর নিজের কাছে থাকলেও সেগুলোর বর্তমান অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না । অর্থাৎ , এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে , আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারতের জীবনের সকল তথ্য কিন্তু এখনও পর্যন্ত অসংরক্ষিত , অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে গেছে । ভ্রাতুষ্পুত্র ড . শরীফের সংরক্ষণের বাইরেও বিপুল বিস্তৃতি ছিল সাহিত্য বিশারতের । জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহিত্য বিশারত সংগৃহীত ৫৫৭ টি বাংলা , ফারসি ও উর্দু পুথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারকে দান করেন । সাহিত্য বিশারতের মৃত্যুর পর ড.আহমদ শরীফ তাঁর সংগ্রহ অংশ থেকে ৪৫০ টি (অন্য মতে ৩৮১) পুথি রাজশাহীর বরেন্দ্র রিসার্স মিউজিয়ামকে প্রদান করেন । ধারণা করা হয় , ড . শরীফের সংগ্রহে থাকা যেগুলো সাহিত্যবিশারত আবিস্কৃত পুথি , তার সংখ্যা হাজার খানেকের মত । তবে ড. আনিসুজ্জামানের অভিমত সাহিত্য বিশারত সংগৃহীত পুথির সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি । 

পুথি পাগল আব্দুল করিমের জন্ম ৩০ আগষ্ট ১৮৭১ এ । বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগাম জেলার পটিয়া উপজেলায় সূচক্রদন্ডি গ্রামে । সাল ১৮৯৩ তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন , ১৮৯৫ সালে এফ . এ পরীক্ষা দেওয়ার পূর্বে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে । প্রথাগত শিক্ষায় খুব বেশি এগোতে না পারলেও জ্ঞান আরোহণের বিষয়ে তাঁর মধ্যে কখনও বিতৃষ্ণা লক্ষ্য করা যায়নি । কর্মজীবন প্রথমপর্বে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে চাকরি নেন । এরপর তিনি সীতাকু মধ্য ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োজিত হন । পরে কবি নবীনচন্দ্র সেনের সৌজন্যে চট্টগ্রাম শহরে কমিশনার অফিসে কেরানির চাকরি নেন । এই কেরানির চাকরিটি সাহিত্যবিশারত হারিয়ে ছিলেন পুথি সংগ্রহের ব্যস্ততার কারণে । পরবর্তীতে দেখা যায় তিনি একাধিক চাকরিতে নিযুক্ত হচ্ছেন , কোথাও কর্মচ্যুত হয়েছেন , কোন কোন জায়গাতে তিনিই নিজেই ছেড়ে দিয়েছেন সেসব চাকরি । তবে ১৯৪৭ সাল সহ একাধিক বার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি .এ পরীক্ষার বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পরীক্ষক নিযুক্ত হন । ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের একটি প্রশ্নপত্রের প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক ছিলেন । ১৯৫৩ সালের ৩০ সেপ্টম্বর সকাল ১০:৪৭ মিনিটে চট্টগ্রাম '  প্রাচীন বিস্মৃত ইতিহাসের ' একটি অধ্যায় লিখতে লিখতেই পুথি  গবেষক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারত নিজ  বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।

 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top