সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

চোখ ভেসে যায় চোখের জলে : মশিউর রহমান


প্রকাশিত:
৩০ জুলাই ২০২০ ২৩:০৫

আপডেট:
৩০ জুলাই ২০২০ ২৩:০৬

 

১.

স্কুলে টিফিন টাইম। ক্লাসের অনেকেই সঙ্গে করে টিফিন আনে। কেউবা আবার এ সময় স্কুলের বাইরের দোকানগুলোতে ভিড় জমায়। আবার কেউ হারুর দোকানে গরম গরম পিঁয়াজো, শিঙাড়া আর আলুরচপ খেতে লাইন ধরে। মেয়েরা কমনরুমে টিফিন খায়। তারপর সেখানে আড্ডা চলে। খেলাধুলাও চলে।

রিপনের কাছে টিফিনের সময়টা খুবই কষ্টের আবার বিরক্তিকরও।

রিপন কোনোদিন টিফিন আনে না। তার মা টিফিন খাওয়ার জন্য দু’পাঁচ টাকা পকেটেও দেয় না। সকালে কোনোদিন দুটো রুটি খেয়ে স্কুলে আসে। আবার কোনোদিন না খেয়েও তাকে স্কুলে আসতে হয়।

টিফিনের সময় সহপাঠীরা যখন ক্লাসরুমের ভেতরে একজনের টিফিন আরেকজনকে দেওয়া নেওয়া করে খায়, আর আনন্দ করে রিপন তখন ক্লাসরুমের কোণায় একটা বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে মন খারাপ করে নিরবে বসে থাকে। পেটের খিদে এবং বন্ধুদের আনন্দ করে টিফিন খাওয়া দেখে ওর প্রচণ্ড রাগ হয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। এভাবেই স্কুলের সময়টা পার হয়েই যাচ্ছিল তার। কিন্তু একদিন ঘটল এক বিপত্তি।

রিপন প্রতিদিনের মতো আজও টিফিন টাইমে ক্লাসরুমের কোণায় গিয়ে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ছিল কিংবা মন খারাপ করে বসে ছিল। হঠাৎ রাজুর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় সে। রাজু বলে, রিপন আয় আমাদের সাথে টিফিন খাবি।

রিপন বলে, না তোরা খা। আমার খিদে নেই।

রাজু নাছোড়বান্দা। সে জোর করে ওকে টেনে নিয়ে আসে। তারপর বলে, তোর টিফিনটা বের কর আমরা সবার টিফিন একসাথে করে খাব।

রিপন বলে, আমি টিফিন আনিনি। মানে আমি টিফিন আনি না।

রাজু বলে, সে কি সারাদিন না খেয়ে থাকিস, তোর খিদে পায় না?

রিপন বলে, না আমার খিদে পায় না।

রাজু বলে, আচ্ছা তুই আমাদের থেকে টিফিন খেতে পারিস।

রিপন বলে, না আমি খাব না। এ সময় কিছু খেতে আমার ভালো লাগে না। আমি হুজুর স্যারের পড়াটা মুখস্থ করব। হুজুর স্যার পড়া না পারলে পেটাবে। টিফিনের পরই তো হুজুর স্যারের ক্লাস।

রাজু আর জোরাজুরি করে না। কিন্তু রাজুর ভেতর একটা চিন্তা ঘুরপাক খায়। ছেলেটাকে সে কোনোদিন টিফিন খেতে দেখে না। টিফিনের সময় এলেই সে একেবারে ক্লাসরুমের কোণায় একটা বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকে। অথচ মুখটা তার শুকনো। মুখ দেখলেই মনে হয়, কতদিন খায়নি ও।

 

স্কুলে নতুন একটা ছেলে ভর্তি হয়েছে। নতুন একটা বাইসাইকেলে চড়ে সে স্কুলে আসে। দেখতে শুনতে সুন্দর। পোশাক-আশাক আরও সুন্দর। দেখেই বোঝা যায় বড়লোকের ছেলে। প্রথমদিনের ব্যবহারেই স্কুলের সকল ছেলেমেয়ের কাছে সে প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। এক সপ্তার মধ্যেই সবার সাথে ছেলেটির বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রিপনের সাথেও বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটির নাম আসিফ।

আসিফ যেমন বন্ধুবাৎসল, তেমনি গোঁয়ার টাইপের। সে এমনিতে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করে, বন্ধুদের উপকার করে। কিন্তু কেউ যদি তার ভালো চাওয়াটা না বোঝে, উপকার করতে চাইলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে ওর মাথায় রক্ত চড়ে যায়।

আজ গণিত স্যার হোমওয়ার্ক দিয়েছেন তিনটি ঐকিক নিয়মের অংক।

আসিফ রিপনের কাছে জানতে চায়, তুমি মানে তুই বাড়ির অংক করেছিস?

রিপন বলে, না।

আসিফ জানতে চায়, কেন তুই পারিস না।

রিপন বলে, পারি, কিন্তু করিনি।

আসিফ বলে, পারিস, অথচ করিসনি? কেন?

রিপন বলে, খাতা নেই, মানে বাড়ির কাজের জন্য আলাদা কোনো খাতা নেই আমার।

আসিফ নিজের ব্যাগ থেকে একটা ঝকঝকে খাতা বের করে রিপনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, এই নে। আমি তোকে খাতা দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি অংক কষে ফেল। গণিত স্যার খাতা জমা না দিলে কিন্তু খুব মারবে।

রিপন ওর খাতা নিতে অস্বীকার করে। বলে, তোমার খাতা আমি নেব না। মা কারো জিনিস নিতে নিষেধ করেছেন। সে খাতাটা রিপনের কাছে ছুড়ে দেয়।

আসিফের মাথাটা গরম হয়ে যায়। সে আবার খাতাটা রিপনকে দিতে যায়। রিপন আবারও নিতে অস্বীকার করে। আসিফ কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় রিপনের গালে।

এমন সময় গণিত স্যার ক্লাসে ঢুকলেন। ক্ল্যাস ক্যাপ্টেন রাজু আগেই সকলের খাতা এক জায়গায় করে রেখেছে। স্যার চেয়ারে বসামাত্রই রাজু বলল, স্যার খাতাগুলো কী জমা দেব?

গণিত স্যার বললেন, হ্যাঁ জমা দিয়ে যাও।

স্যার একে একে খাতাগুলো দেখলেন। দুইজনের অংক ভুল হয়েছে। তাদেরকে শুদ্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, কে কে খাতা জমা দাওনি, তারা উঠে দাঁড়াও।

রিপনসহ আরও তিনজন উঠে দাঁড়াল। স্যার একে একে সবাইকে কাছে ডাকলেন। রিপনও এক সময় স্যারের কাছে গেল। স্যার রিপনকে ইচ্ছেমতো পেটালেন। তুমি গতকালও খাতা জমা দাওনি। ক্লাসে ফাঁকি মার। বাড়িতে গিয়েও পড়াশোনা না করে খেলে বেড়াও আর বাঁদরামি করে বেড়াও।

রিপন মুখ ফুটে কিছু বলে না।

আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, স্যার ওকে আর মারবেন না। ও কিন্তু তিনটা অংকই কষে দিতে পারবে। বিশ্বাস না হলে ওকে চক-ডাস্টার দিন ও ঠিকই বোর্ডে করে দেবে।

স্যার বললেন, ঠিক আছে প্রথম অংকটায় বোর্ডে করো।

রিপন এক হাতের কনুই দিয়ে চোখের পানি মোছে আর অন্য হাতে বোর্ডে অংক কষতে থাকে। দু মিনিটের মধ্যেই অংকটা করে দেয়।

গণিত স্যার কিছুটা আশ্চর্য ও লজ্জিত হয়। তারপর রিপনের কাছে জানতে চায়, তাহলে তুমি খাতা জমা দিলে না কেন? মহাপণ্ডিত হয়েছো। গণিত বিশেষজ্ঞ লিওনার্দো আয়লার হয়েছো? খাতা জমা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করোনি?

রিপন কিছু বলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

আসিফ বলে, স্যার ওর বাড়ির কাজের জন্য আলাদা খাতা নেই বলে ও অংক করতে পারে নি।

 

পরের দিন রিপন কিছুতেই স্কুলে যেতে চায় না। বাবা হোমওয়ার্কের জন্য খাতা কিনে দিতে পারেনি। আর প্রচণ্ড খিদেও পেয়েছে। গতকাল রাতেও সে কিছু খায়নি। মানে ওদের খাবার জোটেনি। মা বার বার করে বলছেন, সোনামানিক আমার, তুমি স্কুলে যাও, আমি দুপুরে ভাত রান্না করব। স্কুল থেকে এসে তারপর খাবে।

রিপনের বড় বোন সুমিও আজ স্কুলে যেতে রাজি হয় না। তারও প্রচণ্ড খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। মা নানা গল্প বলে দুজনকেই স্কুলে পাঠায়। মা বলেন, স্কুলে না গেলে, পড়াশোনা না করলে সারাজীবনই না খেয়ে থাকতে হবে। পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হলেই না তোমাদের অভাব মিটবে। খিদের জ্বালা মিটবে। তোমরা বড় হবে। আর কষ্ট না করে দুনিয়াতে কেউ বড় হতে পারেনি।

রিপন ও সুমি স্কুলে যায়।

 

আজ স্কুলে টিফিন টাইমের পর আর ক্লাস হলো না। আজ স্কুলমাঠে ফুটবল খেলা হবে। ক্লাস এইটের সাথে ক্লাস সেভেনের ফুটবল খেলা। সব ছেলেমেয়ে খেলার মাঠের চারপাশে জড়ো হয়ে খেলা দেখছে। মেয়েরাও স্কুলের বুড়ো শাড়াগাছের গোড়ায় শিক্ষকদের পাশে বসে খেলা দেখছে।

রিপন ভালো ফুটবল খেলে। বন্ধুদের অনেক অনুনয় সত্ত্বও সে কিছুতেই ফুটবল খেলতে মাঠে নামল না।

রাজু ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখল, মুখটা আজও শুকনো। মনে হচ্ছে কয়েকদিন হলো সে কিছুই খায়নি। রাজু বুঝল ব্যাপারটা। সে কয়েকদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে জেনে এসেছে যে ওদের খুব অভাব। দিনের পর দিন ওরা না খেয়ে থাকে। আজও হয়তো না খেয়ে এসেছে তাই সে রিপনকে আর ফুটবল খেলতে জোরাজুরি করল না।

রিপন আজও যথারীতি ক্লাসরুমে বসে আছে। আজ সে ক্লাসের কোণার রুমে না গিয়ে নিজের জায়গাতেই মাথা হাইবেঞ্চের ওপর নিচু করে বসে আছে। আজ আর বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে নেই। আজ সে অপেক্ষা করছে কখন ছুটির ঘণ্টা পড়বে। সে দ্রুত বাড়ি যাবে। তারপর ভাত খাবে। পেটটা তার খিদেয় চো চো করছে। মা বলেছেন আজ দুপুরে ভাত রান্না করবেন।

এক ঘণ্টা ধরে খেলা চলছে। সবাই আনন্দে খেলা দেখছে। এরই মাঝে ক্লাস নাইনের ছেলেরা এক গোল করে ফেলেছে। ক্লাস নাইনের ছেলেমেয়েরা উল্লসিত হয়ে হাত তালি ও চিৎকার করতে লাগল।

রিপন আর ক্লাসরুমের মধ্যে থাকতে পারল না। সে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মাঠের কোণার অর্জুন গাছটা ধরে দাঁড়াল। এরই মাঝে রাজু গোলকিপারকে একা পেয়েও গোল দিতে পারল না। রিপনের তখন খুব কষ্ট হচ্ছিল। সে ভাবল, এই গোলটা কোনোভাবেই সে মিস করত না। রাজু যখন বল মারছিল রিপনও বল মারার ভঙ্গিতে জোরে পা চালাল। ওর পা অজান্তেই অর্জুন গাছের গোড়ায় গিয়ে লাগল। প্রচণ্ড ব্যথা পেল সে।

খেলা শেষ হলো। ক্লাস এইট এক গোলে হেরে গেল। রিপনের খেলা শেষ হলে খুব খারাপ লাগলেও এখন আর তার খারাপ লাগছে না। কারণ দপ্তরি শরাফত চাচা ততক্ষণে ছুটির ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে।

রিপন দ্রুত তার বইখাতা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। এখন তার মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। সে বাড়িতে গিয়েই ভাত খেতে পারবে এটাই হচ্ছে তার একমাত্র খুশি।

স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরতে অন্যদিন আধাঘণ্টা লাগলেও আজ রিপন কুড়ি মিনিটেই বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ওর বড় বোন সুমি তখনও বাড়িতে পৌঁছায় নি। রিপন বইখাতা টেবিলের উপর রেখে মা মা করে ডাকতে লাগল। মায়ের কোনো সাড়া পেল না। তারপর সে পাশের বাড়িতে গেল মায়ের খোঁজে। সেখানেও পেল না। তবে পাশের বাড়ির পাড়াসম্পর্কিত চাচি জানালেন তার মা পুকুরে গেছে, কাপড়চোপড় ধুতে। তিনি আরও জানালেন, হেঁশেলে তাদের দু ভাইবোনের জন্য খাবার ঢেকে রেখে গেছে ওর মা।

ততক্ষণে বড় বোন সুমিও স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরেছে।

বড় বোন এসে হেঁশেলের শিকল খুলল। তারপর দুজনের চোখ এ্যাকেবারে ছানাবড়া।

মা হেঁশেলের শিকল লাগিয়ে গেলেও জানালার খোলা পাল্লাটা লাগিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন।

এই সুযোগে হেঁশেলের জানালা দিয়ে ওদেরই পোষা কুকুরটা এসে মনের সুখে ওদের জন্য রেখে যাওয়া খাবার খেতে শুরু করেছে। অনেকটা ভাত খেয়েও ফেলেছে।

রিপন চুলোর পাশের লাকড়ি হাতে তাড়া করতেই কুকুরটা দ্রুত বেরিয়ে যায় খোলা দরজা দিয়ে। তারপর রিপন কাঁসার থালায় পড়ে থাকা বাকি ভাতগুলো গুছিয়ে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে। সুমিকে বলে, তোর ভাত সব কুকুরে খেয়ে ফেলেছে। আজও তোকে না খেয়ে থাকতে হবে।

সুমির পেটেও প্রচণ্ড ক্ষুধা। খিদের জ্বালায় সে নড়তে পর্যন্ত পারছে না। তবুও সে রিপনকে বলল, কুকুরে খাওয়া ভাত খেতে হয় না ভাই। তুই এই ভাত খাবি না। কুকুরে খাওয়া ভাত খেলে পেটে অসুখ হবে।

ওদের জন্য রেখে যাওয়া ভাত যে কুকুরে খেয়ে ফেলেছে, প্রতিবেশীর মাধ্যমে মা পুকুরঘাট থেকে সে কথা শুনেছে। তাই দ্রুত তিনি বাড়িতে ফিরে এলেন।

সুমি কয়েকবার রিপনকে কুকুরে খাওয়া ভাত না খাওয়ার জন্য বললেও এখন আর কিছুই বলছে না।

কে শোনে কার কথা। রিপনের এখন আর কোনোদিকে খেয়াল নেই। পেটের ভেতরে অন্ন নামক বস্তু- সে যত নিকৃষ্টই হোক তা চালান করায় ব্যস্ত।

মা ততক্ষণে ভিজে কাপড়ে এসে দাঁড়ালেন হেঁশেলের দরজার পাশে। মাও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। রিপন সবটুকু ভাত চেটেপুটে মনের আনন্দে খেয়ে চলেছে।

রিপনের আনন্দ করে খাওয়া দেখে সুমিও একেবারে নির্বাক।

দরজার এপাশে দাঁড়ানো মা ও সুমির চোখ ভেসে যাচ্ছিল চোখের জলে।

 

পরিশিষ্ট

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল কিংবা তারও পরবর্তী সময়ে সারা বাংলার অসংখ্য গ্রামে ও শহরে এরকম নানা হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিনে খাবার অন্বেষণে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। এরকম অনেক ঘটনার কথা এখনও শোনা যায়। এই গল্পটি সেসময়েরই একটি খণ্ডচিত্র।

 

মশিউর রহমান
শিশুসাহিত্যে ইউনিসেফ মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড এবং অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত।
প্রকাশক, সৃজনী

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top