সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১

পরিপ্রেক্ষিত : জোবায়ের মিলন


প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২০ ২২:০৬

আপডেট:
২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৫১

 

বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব নূরুন নাহার বেগম। মুখটা বিধ্বস্ত। শ্বাস উঠছে, নামছে। ক্ষণে ক্ষণে কেশে উঠছেন। গায়ে গায়ে জ্বর। গলাব্যথা। দরজাটা অর্ধেক ভেজানো, অর্ধেক খোলা। ছয় ছেলে-মেয়ে, কেউ কাছে ভিড়ছে না। তার ব্লাউজটা ঘামে থকথক। হাসপাতালে নিতে হবে। কে ধরবে নূরুন নাহার বেগমকে? তর্ক বেঁধে যায় ছেলে-মেয়ের মধ্যে। তাদের ধারণা করোনায় আক্রান্ত তাদের মা। যে যাবে, যে ছোঁবে সে’ই হতে পারে পরবর্তী আক্রান্ত।
শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। কাশি তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। আরও ভিজে উঠছে শরীরটা। নাতি-নাতনীরা যে যেখানে ছিলো সবাই চারতলা ভবনটির এই ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয়েছে। সব মিলিয়ে আঠানো ঊনিশ জনের মতো গিজগিজ করছে। খাটের এক কোনে একা ছটফট করছেন নূরুন নাহার বেগম। তার স্বামী, একসময়ের জাদরেল উকিল ফরিদ উদ্দিন কয়েকবার দরজার কাছে এসে দেখে গেছেন তাকে। দূর থেকে একটা পানির বোতল ঢিল দিয়ে দিয়েছেন খাটের উপর। হাতটা বাড়িয়ে পানির বোতলটা ধরার শক্তি না পেয়ে বালিশটাতেই আধবসা, আধশোয়া হয়ে পড়ে আছেন তিনি। একটু পর পর গোঙানির মতো বলছেন, ‘‘আমারে হাসপাতাল নিয়ে যাও। পারছি না। আর পারছি না। ঋতুর বাবা তুমি কই?’’ ফরিদ উদ্দিন পাশের ঘরে, যে ঘরটা থেকে নূরুন নাহার বেগমকে সোজা দেখা যায় সে ঘরটায় বসছেন, উঠছেন, তাকাচ্ছেন। হাতের রুমালটা দিয়ে মাঝে-মধ্যে চোখ মুছছেন। এর বেশি আর কিছুই করতে পারছেন না; ছেলে-মেয়েরা তাকেও ওই ঘরটায় যেতে দিচ্ছে না যে ঘরটায় নূরুন নাহার বেগম। ফরিদ উদ্দিনের চোখে-মুখে কিছু প্রশ্ন দানা বেঁধে আছে। কী প্রশ্ন, বুঝা যাচ্ছে না।

বড় ছেলে নূরুল বার বার কল করছে বিভিন্ন হাসপাতালে, ক্লিনিকে একটা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য। মেঝো মেয়ের জামাতা মিঠুন ফোনটা হাতেই নিয়ে আছেন। একটু পর পর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া নম্বরে ফোন করে যাচ্ছেন। ওপাশ থেকে ভেসে আসছে, ‘‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটু পর আবার চেষ্টা করুন?’’ সেজো ছেলে নিলয় পাশের ফার্মেসি থেকে মেডিক্যাল ডিপ্লোমা করা ওষুধ বিক্রেতা জয়নালকে ডেকে আনলে জয়নাল রোগীর কাছে দাঁড়ালোই না উপরন্তু সে তার ফার্মেসিতে যে আসে তার কাছেই প্রচার করছে, ‘‘ফরিদ উদ্দিন সাহেবের বউরে করোনায় ধরছে।’’ বাড়িটাতে মানুষের ঢল। প্রধান গেইট বন্ধ করেও রাখা যাচ্ছে না। হাজার জনের হাজার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে গেইট আর বন্ধ না করলে উৎসুক মানুষের ঢল নামে; যেন এ বাড়িতে কোনো বাঘ ধরা পরেছে বা হরিণ ধরা পড়েছে। চিরাখানায় মানুষ যেমন পশু দেখে যায়, এখানে মানুষ একজন মানুষকে দেখতে এসেছে! দরজা জানালা দিয়ে উঁকিঝুকির অদ্ভুত কান্ড। নূরুন বেগম একাত্ হচ্ছেন তো ওকাত্ হচ্ছেন। স্বস্তি আর হচ্ছে না। বাড়ছে কষ্ট।

গত কয়েক দিন থেকেই নূরুন নাহার বেগমের সর্দি, কাশি, গা’টা গরম গরম। প্রথমে গলা ব্যথা ছিলো না। জয়নালের দোকান থেকেই ‘‘এবি কফ’’ নামে সিরাপ খেয়েছেন। আগেও কাশি হলে এই সিরাপ দিয়েছে জয়নাল। কাজও হয়েছে। কিন্তু এবার কাজ হচ্ছে না। ভেবেছেন সেরে যাবে। সারছে না। এই বাড়িতে শিক্ষিত ও সচেতন লোকের অভাব নেই। তবে কারো চোখেই বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। রাত থেকে গলা ফুলে গেলে ও শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সবাই নড়েচড়ে বসে এবং নূরুন নাহার বেগম-এর কাছ থেকে সবাই দূরত্বে চলে যায়। হঠাৎ আচরণের এই পরিবর্তন ও আপন ছেলে-মেয়ের এমন নির্মমতায় ফরিদ উদ্দিন বিস্মিত হলেও আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে তার কিছুই করার নেই। তিনি একবার এই ঘরে, একবার ওই ঘরে পায়চারী করছেন, জোর করে বলতে পারছেন না কাউকে কোনো কথা। ছোট মেয়ে নাজনিনের পাঁচ বছরের মেয়ে হৃদিতা তার কোলের কাছে এসে, ‘‘দাদু, দাদু, দীদার কী হয়েছে? দীদা কি বাঁচবে না?’’ এমন প্রশ্নে ঝরঝর করে কেঁদে দেন। বড় ছেলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন, ‘‘আপনি কান্নার আর সময় পান না, না? এটা কি কান্নার সময়? দেখছেন না আমরা সবাই চেষ্টা করছি। কী করবো, কেউ তো এই রোগী ধরতে চায় না। না অ্যাম্বুলেন্স, না সিএনজি। আমরা কি কোলে করে হাসপাতাল নেব? সবারই তো জীবন আছে।’’ ফরিদ উদ্দিন চুপ হয়ে যান, ছোট্ট করে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, সবারই তো জীবন আছে।’’
ঝগড়ার স্বরটা এক দালান ছাড়িয়ে অন্য দালান পর্যন্ত পৌঁছায়। পাশের দালানের মানিক চৌধুরী ধীর পায়ে এই বাসার ভেতর প্রবেশ করেন, ‘‘কী হয়েছে? এত হই-চৈ কেনো?’’ দরজার ফাঁক দিয়ে নূরুন নাহার বেগমকে দেখে ও বিস্তারিত শুনে তিনি আর এক মুহূর্তের জন্য না দাঁড়িয়ে সরে পরেন। তৃতীয় ঘরটায় সবাই এক হয়ে আলাপ করতে বসেছে। মিমাংসা হচ্ছে না। এ বলছে ওকে, ও বলছে একে। একজন তার বাচ্চার দোহাই দিচ্ছে, আরেক জন দিচ্ছে তার সংসারের দোহাই। মেয়ে এগিয়ে আসছে তো জামাই মুখ কালো করে তাকাচ্ছে, জামাই এগিয়ে আসে তো সে তার বাড়ির কথা ভাবছে।. . . মিনিট গড়ায়। ঘন্টা গড়ায়। সময় থেমে থাকে না। বেলা হয়ে আসে। ভাই-বোনদের মধ্যে বাড়ে উত্তেজনা । কথা, তর্ক, পাল্টা তর্ক থেকে দুই ভাইয়ের হাতাহাতি ও ভাই থেকে ভাইয়ের স্ত্রীদের মধ্যে বাকবিতন্ডা দীর্ঘ হয়ে পড়লে কারো কারো মতের উপর ডেকে আনা হয় এলাকার মাতুব্বর কয়েকজনকে। সালিশ চলতে থাকে। করোনা মানে মৃত্যু, গায়ে ছড়িয়ে পরার সমূহ সম্ভাবনা, কে চায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুর কাছে যেতে! প্রত্যেকের সংসার আছে, সন্তান আছে, ভবিষ্যত আছে; রোগীর কাছে যাবার নেই কোনো পোশাক-পরিচ্ছদ; ছোঁয়াচে না হলে কী আপত্তি ছিলো...ইত্যাদি বর্ণনায় মিল হয় না, মতে পৌঁছায় না কেউ। নূরুন নাহার বেগম এবার বিলাপ করেন। ফ্যাসফ্যাস গলায় বলেন, ‘‘ কেউ কি নেই, আমি কি মরে যাবো! আমাকে কি কেউ হাসপাতালে নেবে না! আমার কোনো ছেলে-মেয়ে কি দেখছে না আমাকে, আমি আর পারছি না যে। তুমিও কি দূরে সরে গেলে নুরুলের বাবা?’’ কাশতে কাশতে চুপ হয়ে যান নূরুন নাহার।

প্রতিবেশিরা বড় বড় স্বর শুনে কেউ কেউ আসে, বেশিক্ষণ থাকে না। মুখে মাস্ক দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে যায়। সবাই পরামর্শ দেয়। উপদেশ দেয়। হরেক কথা কয়। কেউ কেউ মন্দচারিও করে। কেউ এগিয়ে আসে না। কোনো ব্যবস্থাও করতে পারে না। সরকারি লোক আসবে পিপিই পরিহিত, তারা নিয়ে যাবে নূরুন নাহার বেগমকে সে আশায় কেউ কেউ সরকারকে গালমন্দ করতে ছাড়ে না। ইউরোপ, আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, লন্ডন, কুয়েত, সৌদিআরব দেশের উন্নত ব্যবস্থা আর চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলে বলে বাড়িটাতে কেউ কেউ গলাও ছাড়ে। কোনো কোনো প্রতিবেশি আইইডিসিআরকে একহাত নিয়ে নেয় বটে কিন্তু একটা উপায় বের করতে পারে না নূরুন নাহার বেগমকে বাসা থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়ার। বজলুর রশিদ আসে খবরটা শুনে। যে মসজিদে এই শীতের ওয়াজ-মাহফিলে নূরুন নাহার একলক্ষ টাকা দান করেছিলেন তিনি সেই মসজিদের ইমাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অন্য একজনের সাথে কথা বলতে বলতে তিনি বিরবির করে কী যেন উচ্চারণ করেন। ‘‘হুজুর আম্মার জন্য দোয়া করবেন। কী করবো আমরা বুঝতে পারছি না।’’ নাজনিন বলে। ‘‘ তোমরা সবাই আল্লারে ডাকো, আল্লারে ডাকো।’’ বলে হুজুর আর অপেক্ষা করেন না। ভেতর ঘরে ফয়সালা হয় না বিষয়টার।

দালানের নিচে মেইন গেইটের কাছে একদল লোক জটলা পাকিয়ে আছে। কিছু লোক কিছু লোককে কোরাআনের আলোকে করোনার চিকিৎসা ও মৃত্যু থেকে বাঁচার উপায় বলছে। কিছু লোক বিরোধিতা না করলেও বাস্তবতার নিরিখে জ্ঞান দিচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড়ছে না। কিছু লোক আল্লাহর গজব বলে সাবধান করছে, নিজে সাবধান না হয়ে। সবাই যেন মহাপন্ডিত, এমন দম্ভ নিয়ে উদ্ধার করছে ঘর-সংসার। কিছু লোক আবার পাছে সমালোচনায় মশগুল। ‘‘ছয়টা পোলাপাইন হওয়াইয়্যা কী লাভ হইলো! মা’রে ছুঁইতে যায় না! আরে, অসুখ বিসুখ দেয় আল্লায়; কইলেই হইলো- ছোঁয়াচে! মায়ের পায়ের নিচে বেহেস্ত। মার জন্য মইরা গেলে কী অসুবিধা! তাই বইল্যা মার কাছে যাইবো না?’’ বলে কিছু লোক নিজেরা নিজেরাই রাগ ঝাড়ছে। প্রথমে লোক বাড়লেও বেলা যতো গড়াচ্ছে ততই বাড়িটা শূন্য হয়ে পড়ছে। আশ-পাশ দিয়ে মানুষ চলাফেরা করছে, একটা গতি করা কথা ভাবছে না কেউ। ওয়ার্ড-কমিশনার ফরিদ উদ্দিনের বড় ছেলে নূরুলের কাছে ফোন করে খবরা-খবর নেয়, ‘‘এটা কিন্তু ভাইরাস! শ্বাসের লগে ছড়ায়। নাক মুখ না ঢাইকা কেউ কাছে যাইবেন না। দেখতাছি কী করন যায়। আপনেরা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন।’’ কিছুক্ষণ পরে কয়েকজন ছেলেপেলে এসে দালানটার গায়ে লাল দাগ দিয়ে দেয়। প্রতিবাদ করে সেজো ছেলে, ‘‘আমরা কি তা হইলে বাইর হবো না! কত্ত কাজ আছে। লাল দাগ দিতেছেন ক্যান?’’ কে শোনে কার কথা।এই বাসার স্থায়ী কাজের বুয়া রাশিদার মা কোথায় থেকে যেন কাপড়ের ভাঁজে কয়েক মুঠো থানকুনির পাতা নিয়ে আসে। ফরিদ উদ্দিনের হাতে দিয়ে বলে, ‘‘খালু এইগুলা বাইটা কালিজিরার সাথে মিশাইয়া খালাম্মারে খাওয়াই দেন। ইউটিউবে দেখছি এক বড় মাওলানা নাকি স্বপ্নে দেখছে, এটা খাইলে করুনাভাইরাসের বাপেরও সাইদ্দ নাই কাউরে এট্টাক করার।’’ বাতাসে ভাসতে থাকা হাজার হাজার গুজব আর স্বার্থসিদ্ধির নানান মূর্খ বয়ানের মতো এটিও একটি ছড়িয়ে পড়া গুজব বা স্বার্থকৌশল; ফরিদ উদ্দিন তা জানেন তবু পাতাগুলো হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকেন সোজা ঘরটার দিকে।


ফরিদ উদ্দিন সাহেবের মনে পড়ে অনেক বছর আগের কথা। প্রথম সন্তান নূরুল যখন হলো তখন নূরুন নাহার বেগমের বয়স তেমন বেশি না। ষোল কি সতেরো বছর। ছোট বেলায় মা না থাকায় বাবার ¯েœহেই বড় হওয়া। সংসার বলতে কিছুই বুঝে না। বয়স্ক শ্বশুর, শ্বাশুরি, স্বামীর সংসার, সন্তান নিয়ে কী যে অবস্থা। রান্না হয় তো খাওয়া হয় না, খাওয়া হয়তো নিজের খেয়াল হয় না। একে একে ছয়টা সন্তান। ভেজা কাঁথা আর নিজের ভেঁজা কাপড় থেকে উঠেই দাঁড়াতে পারে না। সংসারেও স্বচ্ছলতা না থাকায় পেটে দিতে পারে না দুইটা ভালো কিছু। দুই চারটা ফল-ফাকরা যা’ই জোটে তা তো ছয় সন্তানে ভাগ করে দিতেই নাই। একটা কোলে তো একটা পিঠে, একটা পিঠে তো একটা কোলে। এর মধ্যে দুইটা জমজ হওয়ায় দুই পাশের কোলের হাড়ে কালো দাগ বসে গেলো। এই তো সেদিনও একটা কিডনী দান করে দিলো ছোট ছেলেকে। অবশিষ্ট যা আছে তা কেবল তো খোসা। আর সব সন্তান সন্তান, সংসার সংসার করেই ত্যাগ করে দিলো। নিজের জন্য যে শ্বাসটুকু বাকি সেটাই এখন যাওয়ার জোগার। ফরিদ উদ্দিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়ায়। বড় ছেলের ঘরে যেখানে সবাই বসে এখনো তর্ক করছে, বাকবিতন্ডা করছে সে ঘরের বড় আলমিরাটার সামনে হাজির হয়ে আয়নার পর্দাটা সরিয়ে নিজের চোখের দিকে তাকায় এক দৃষ্টিতে। ফরিদ উদ্দিন আয়নার ভেতর দেখতে পায় কতগুলো ছারপোকা। কতগুলো জোঁক। কতগুলো উত্তরাধুনিক যুগের কথিক আধুনিত জরবস্তু। প্রতিটি বন্তুর মুখ রেখাপাতে ভরা, ভাঙ্গা কাঁচের চুকরোর মতো ঝুরঝুর, আঁটার দলার মতো মথিত, মাঘের বিকালে ধুলায় পড়ে থাকা শেগুন পাতার মতো মরমরে, জীর্ণ, দুর্বল। ফরিদ উদ্দিন হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, ‘‘মানুষটা কি ঘরে পইড়াই মৃত্যুর কোলে ঢইলা পড়বো? মানুষটা কি হাসপাতাল পর্যন্ত যাইতে পারবো না? আমরা কি কেউ তাকে ছুঁইতে পারবো না? এটা নিশ্চিত হইতে পারবো না যে, তার করোনা নাকি অন্য অসুখ?’’ ঘর ভর্তি প্রত্যেকে সোজা হয়ে বসে। লাঠিতে ঠক্ঠক্ বয়স্ক ফরিদ উদ্দিন সাহেবের হঠাৎ এতো দৃঢ় আর বলিষ্ঠ কন্ঠে চমকে ওঠে সবাই। ফরিদ উদ্দিন আয়নার দিকে তাকিয়ে আরো বলতে থাকে, ‘‘ সর্দি কাশি মানেই কি করোনা? করোনা মানেই কি মৃত্যুরোগ? মৃত্যুরোগ হলেও কি মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াইবো না? সন্তান কি দাঁড়াইবো না মায়ের পাশে? ভাই কি দাঁড়ইবো না বোনের পাশে? বোন কি দাঁড়াইবো না ভাইয়ের পাশে? প্রতিবেশি কি শিমার হয়ে মুখ ফিরাইয়া থাকবো এমন দুর্যোগ কালে? মহামারি কি এই জগতে আগে আসে নাই, নাকি এই প্রথম? যতই মৃত্যুরোগ হোক, মহামারি হোক মানুষরেই তো থাকতে হইবো মানুষের পাশে।’’ বলে ফরিদ উদ্দিন এক দৌড়ে নূরুন নাহার বেগমের ঘরে চলে আসেন। তার পেছন পেছন ঘরের সবাই ছুটে এসে দরজাটার কাছে দাঁড়ায়। একটা গামছা কয়েক ভাঁজ করে মাস্কের মতো নাকে মুখে প্যাঁচিয়ে ফরিদ উদ্দিন একটানে নেতিয়ে পড়া নূরুন নাহারকে কাঁধে তুলে নেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকেন নিকটের হাসপাতালের দিকে। বাক্ হারিয়ে ছয় ছেলে-মেয়েসহ দালানের আশেপাশে ছাড়া-ছাড়া ঘুরাঘুরি করতে থাকা সবাই তাকিয়ে থাকে বোবা মানুষের মতো।

হাসপাতাল নূরুন নাহার বেগমকে ফরিদ উদ্দিন সাহেবের কাঁধ থেকে নামিয়ে নিতে পেরেছিল কিনা, নাকি সময়ে ঘুরতে থাকা, ‘‘হাসপাতালও এমন লক্ষণের রোগী ছুঁতে চায় না, নিতে চায় না, ভর্তি করতে চায় না, তাড়িয়ে দেয়, অবহেলা করে সন্দেহে, ভয়ে, নিজেদের প্রোটেকশনের অভাবে।’’ কথার বাস্তবতায় ফরিদ উদ্দিন হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে ক্লান্ত হয়ে মেনে নিয়েছিলো ভাগ্য; নাকি পৌঁছতে পেরেছিলেন কোনো একটি হাসপাতালের বেডে তা আর শেষ পর্যন্ত জানতে পারি না। তবে ওই দালানের একটু দূরে কিছু লোক বলাবলি করছিলো, ‘‘করোনায় ধরলে কেউ ধরে না, মরলে গোসল করায় না, মাটিও দিতে চায় না, পেটের পুতেরাও কেমন পর হইয়্যা যায়! কী একটা করুণকাল এলো!’’

কিছু লোক সিগারেট টানতে টানতে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে হেঁটে চলে গেল যেমন রোজ এই পথ দিয়ে শতো শতো মানুষ হেঁটে যায়। আমিও তাদের সাথে মিশে গেলাম একটা সময়।

 

জোবায়ের মিলন
সহকারী বার্তা প্রযোজক, বার্তা বিভাগ, এনটিভি

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top