হে প্রেম : সুদীপ ঘোষাল
প্রকাশিত:
৮ আগস্ট ২০২০ ২৩:৩৮
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১২:১৩
নদীর গোপন পান্ডুলিপি খুঁজতে নিত্য আমার আনাগোনা তার পাশে পাশে। গ্রীষ্মে দেখি শুকনো বালির বৈশাখী কালো রূপে আলো ঘেরা অভয় বাণী। বর্ষায় পরিপূর্ণ গর্ভবতী নারীরূপ । এই রূপে জলবতী নদীতে অতি বড় সাঁতারু ভুলে যায় কৌশল । আমি তখন নদীর বুকে দুধসাদা ফেনা হয়ে ভাসতে ভাসতে চলি বাক্যহারা হয়ে ।
এবার শরতে কাশ ফুলের কারসাজি । তার মাথা দোলানো দেখে আমি দুর্গা পুজোর ঢাকী হয়ে যাই । আমার অন্তর নাচতে থাকে তালে তালে । মা তুই আসবি কবে আর, নতুন জামায় নাচে মন সবার ।
নদী এরপরে হেমন্তের বুকে ছবি এঁকে এগিয়ে যায় শীত ঋতুর আহ্বানে । লোটা কম্বল বগলে আমি রাজস্থানী সাজি । কখনও ধূতি পাঞ্জাবি পরিহিত শাল জড়ানো খাঁটি বাঙালি । মাঝে মাঝে কোট প্যান্ট পরিহিত বিদেশী সাহেবের সুন্দর সাজ । আমি সারা পৃথিবীর সাজে সজ্জিত হতে চাই শীতের আদরে ।
শীতল আড়মোড়া ভাঙতেই বসন্তের বাসন্তী রঙের তালে তালে আমি রঙের ফেরিওয়ালা হয়ে যাই । সকলের অন্তরের গোপন রঙ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতি । এই সময়ে আমার রাধাভাব ছড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ অজয়ের মদনমোহনের রূপে ।
আমার সমস্ত শরীর মন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মনোদেবতার মহান চরণে ...
দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর । ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে । আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , "ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না"। অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ । ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা। ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো, "আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা । কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম " । গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো। বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন। অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি। তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা য় স্নানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ। তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী। ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?
রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে। ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ । নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম, ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া ।
অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ। পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা। বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা। সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা। শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে। আগে থেকে চোখ দেখতে নেই। আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না। পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার। সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি। কি যেন বলেছিলো সেই চোখ। আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায়। ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে।
দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ। হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে। হয়তো আমার জন্য ই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ইশারায়।
কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের। এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব। মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত। হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে। দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে ।
আমাদের শোভন কাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। সেই মধুর সুরেই শোভন কাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙ্গে দিতেন।
আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই। কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি ? সেই শোভন কাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন। অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার। মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো। প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি।
শোভন কাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো। তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা ।তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন ।তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ ।
আজ তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে । হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পরে ছিলো তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে ।
___পলাশ তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো ।
___এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার করবী ।
কে যে মরে আর হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে। সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে । আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম প্রথম সমুদ্র দেখার মতো।
তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে । কোনোদিন ভেঙ্গে পরে নি মন। হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো। না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা র মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর।
এখন জলপাইগুড়ির প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব। আমার এক স্প্যানিয়াল বন্ধুকে নিয়ে ঘর করি। কোনো কথা নেই, কোনো ঝগড়া নেই। ভালোবাসার চোখে দেখি একে অপরকে। আপন মনে থাকতে থাকতে মনে চলে আসে জ্যোৎস্নার কথা। বৃষ্টির এক দুপুরে তার চিঠির কথা আজও মনে পড়ে। সে লিখেছিলো, ধনী পিতার একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবার যেমন নজর বন্দী করে রাখে পাছে ছেলে ভালোবাসা র খপ্পরে পরে পর হয়ে না যায়। ঠিক তেমনিভাবেই রেনকোট, ছাতার আড়াল করে আমরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও বৃষ্টির ভালোবাসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি না। বৃষ্টি বলে সুন্দরী যেমন একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবারের নজর থেকে নিজের করে নেয়, ঠিক একইভাবে বৃষ্টি আমাদের. একমাত্র সুন্দর দেহ জামার কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে। তারপর হাঁটা পথে চলার রাস্তায় জল পরম মমতায় পায়ে জলের শেকল পরিয়ে রাখতে চায়। বৃষ্টির সময় চোখে মুখে জল আদরের প্রলেপ লাগায়। ঠোঁট চুম্বন করে শীতল স্পর্শকাতর জল। তার আদরে প্রেমজ্বরে পড়তে হয় মাঝে মাঝে। আমি ভালোবেসে তাকে বলছি, তুমি আমার জ্বরের মাঝে ঝরঝর ঝাঁপিয়ে পড়ো। আমিও বৃষ্টি হয়ে যাই।
তারপর জানতে চেয়েছিলো কেমন হয়েছে তার চিঠি। তখনও আমি কিছুই বলতে পারি নি।
আমি ও জ্যোৎস্না যে গ্রামে ভালোবাসা র বয়সটা কাটিয়েছি তার কথা আজ মনে সবুজ সর ফেলছে। শুধু মনে পড়ছে, আমার স্বপ্নের সুন্দর গ্রামের রাস্তা বাস থেকে নেমেই লাল মোড়াম দিয়ে শুরু। দুদিকে বড় বড় ইউক্যালিপ্টাস রাস্তায় পরম আদরে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। কত রকমের পাখি স্বাগত জানাচ্ছে পথিককে। রাস্তা পারাপারে ব্যস্ত বেজি, শেয়াল আরও অনেক রকমের জীবজন্তু। চেনা আত্মীয়র মতো অতিথির কাছাকাছি তাদের আনাগোনা। হাঁটতে হাঁটতে এসে যাবে কদতলার মাঠ। তারপর গোকুল পুকুরের জমি, চাঁপপুকুর, সর্দার পাড়া,বেনেপুকুর। ক্রমশ চলে আসবে নতুন পুকুর, ডেঙাপাড়া, পুজোবাড়ি, দরজা ঘাট, কালী তলা। এখানেই আমার চোদ্দপুরুষের ভিটে। তারপর ষষ্টিতলা ,মঙ্গল চন্ডীর উঠোন, দুর্গা তলার নাটমন্দির। এদিকে গোপালের মন্দির, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ, তামালের দোকান, সুব্রতর দোকান পেরিয়ে ষষ্ঠী গোরে, রাধা মাধবতলা। গোস্বামী বাড়ি পেরিয়ে মন্ডপতলা। এই মন্ডপতলায় ছোটোবেলায় গাজনের সময় রাক্ষস দেখে ভয় পেয়েছিলাম। সেইসব হারিয়ে যাওয়া রাক্ষস আর ফিরে আসবে না। কেঁয়াপুকুর,কেষ্টপুকুরের পাড়। তারপর বাজারে পাড়া, শিব তলা, পেরিয়ে নাপিত পাড়া। এখন নাপিত পাড়াগুলো সেলুনে চলে গেছে। সাতন জেঠু দুপায়ের ফাঁকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরতেন মাথা, তারপর চুল বাটি ছাঁটে ফাঁকা। কত আদর আর আব্দারে ভরা থাকতো চুল কাটার বেলা । এখন সব কিছুই যান্ত্রিক। মাঝে মাঝে কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়েকে রোবোট মনে হয়। মুখে হাসি নেই। বেশ জেঠু জেঠু ভাব। সর্বশেষে বড়পুকুর পেরিয়ে পাকা রাস্তা ধরে ভুলকুড়ি। আর মন্ডপতলার পর রাস্তা চলে গেছে খাঁ পাড়া, কাঁদরের ধার ধরে রায়পাড়া। সেখানেও আছে চন্ডীমন্ডপতলা, কলা বা গান, দুর্গা তলার নাটমন্দির সব কিছুই। পুজোবাড়িতে গোলা পায়রা দেখতে গেলে হাততালি দিই। শয়ে শয়ে দেশি পায়রার দল উড়ে এসে উৎসব লাগিয়ে দেয়। পুরোনো দিনের বাড়িগুলি এই গ্রামের প্রাণ।
এই গ্রামে ই আমার সবকিছু, আমার ভালোবাসা, আমার গান ।
আজ জ্যোৎস্না খোঁজ নিয়ে আমার জলপাইগুড়ির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এসেই নিজের ঘরের মতো এলোমেলো জীবন সাজাতে চাইছে। আর কথা বলে চলেছো অনবরত। ভালো করে তৈরি হয়ে এসে বিছানায় বসে শরীরটা এলিয়ে দিলো। তারপর শুরু করলো, মনে আছে তোমার সব ঘটনা। জানো আমি সুখী নই। কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আবার আমার দুর্বল জায়গা জাগিয়ে তোলার জন্য পুরোনো কথা শুরু করলো ।ও জানে না আমি স্মৃতি জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছি।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনাতে লাগলাম পুরোনো বাল্য ভারত, তুমি শোনো জ্যোৎস্না, ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো। পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে ।তারপর প্যান্ডেলের জোগাড়। বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা ও দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল। তার একপাশে বানানো হত আমাদের বসার ঘর। পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে। কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত। একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব। তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না। মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না। তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ। মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি। হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে, আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে। এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে। পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে। মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না। শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না। পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই। জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন। মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে। তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম। প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে। আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত, ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম। সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ, ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম। পরের দিন দধিকর্মা। খই আর দই। পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল। তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে।
এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন। কাছেই একটা পুকুর। রাত হলে সিদ্ধিলাভে (দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচতে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো। মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন। তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে...
কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমার প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি। জ্যোৎস্না বললো, জানো বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয়। এসো আমরা এক হই পরম সুখে। আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম ।
জ্যোৎস্না কি ভুলে গেছে মনে ভাসা সবুজ সর নিয়ে ,দুঃখ কে জয় করার মানসিকতায় এক ভারতবর্ষীয় যাপনে আমি ডুব দিয়েছি জীবন সমুদ্রে....। তারপর কেটে গেছে অনেকটা সময়। আমি একা থাকতেই ভালোবাসি। মাছ ছিপ দিয়ে ধরতে ভালোবাসি। আবার ভূত দেখার বাল্যসখও আছে। অনেকে হয়তো আড়ালে হাসবেন। আমার জীবনে এই ঘটনাগুলো প্রাধান্য দিয়ে না পাওয়ার দুঃখ ভুলতে চাই। এবার একটু ছেলেমানুষ হতে ইচ্ছা হচ্ছে। জ্যোৎস্নাকেও শুনিয়েছি এই গল্প।
জানি না বিশ্বাস করবে কি না । আমি কিন্তু পেত্নী দেখেছি। সেই ঘটনাই বলছি। আমার এক ফুলবাবা ছিলো। রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে ট্রেনে পরিচয়। সেই ফুলবাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছিলো।
ওনাদের বড়ো বড়ো পুকুর । পূর্ব বর্ধমানের এই গ্রামের মত বড় পুকুর খুব কম গ্রামেই আছে। আমার মাছ ধরার নেশা। কাউকে কিছু না বলে একটা মাছ ধরার হুইল নিয়ে শ্যাওড়া গাছের ছায়ায় বসেছি। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হল। বাড়িতে সকলের শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এ নেশা সাংঘাতিক । যার আছে সেই জানে । ফাৎনা ডুবে গেছে । আমি খেঁচ মেরে মাছ ডাঙায় তুলে ফেলেছি। এক হাতে টর্চ। হঠাৎ এক পায়ের এক সাদা কাপড় পড়া বুড়ি এসে বললো, পেলি এতক্ষণে একটা মাছ। এই দ্যাখ, আমি আনছি। বলেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। দু হাতে দুটো মাছ ধরে হাসতে লাগলো।
হি হি হি হি । হৃদয় থমকে দেওয়া সেই হাসি।
তারপর এক পায়ে লাফিয়ে শ্যাওড়া গাছে উঠে বললো, আয় আয় গাছে আয়। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝড় আমাকে উড়িয়ে গাছে তুলে আবার নামিয়ে দিলো। তারপর আমার জ্ঞান ছিলো না। শুনেছি আমার শালাবাবু বন্ধু দের সাথে নিয়ে আমাকে উদ্ধার করে।
তারপর আর কোনোদিন মাছ ধরার শখ হলেই অই মেছো পেত্নীর কথা মনে পড়ত। এখন আমি জেনে গেছি ভূত বলে কিছু নেই। তবু ছোটোবেলার বিশ্বাস ধরে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে। পাঠক নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। আবার এক ঘটনা মনে পড়ছে। বলবেন, এই বয়সে । আমি বলি আমার কবি বন্ধু বলেন বয়সটা সংখ্যা মাত্র। অন্য কিছু নয়।
আমার ছোট পিসির বাড়ি বেলুন গ্রামে। দূর থেকে যখন দেখতাম বাবলা পলাশ, শিমূলের মায়া ঘেরা একটা ছবি ভেসে উঠতো চোখের সামনে। আমার বাড়ি পুরুলে গ্রামে। তখন রাস্তা ঘাট এত উন্নত ছিল না। হাঁটা পথে আল রাস্তা ধরে আমি পিসির বাড়ি যাওয়া আসা করতাম। পিসীর আদরের টানে বার বার বেড়াতে যেতে মন হতো। কিন্তু ভয় করতো। সেই ভয়ের কথাই বলছি।
একদিন আমি ও আমার ভাই বাবু পিসির বাড়ি যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে রাস্তায় সন্ধ্যা নেমে এলো। ছোটো কাঁদরের ধারে জঙ্গলে শিয়ালগুলো ডাকতে শুরু করেছে। তারা সুর করে বলছে, হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া, ছোটো ছেলে বাগিয়ে শোয়া। খুব ভয় করছে। তারপর আবার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। বটগাছতলার কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম বড় বড় দুটো পা রাস্তা আগলে রেখেছে।
বাবুর খুব সাহস । বললো, কে গো তুমি, পা টা একটু সরাও না। আমরা যাবো।
দাঁড়া আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যা ।
বলো কি বলছো ?
তোদের থলিতে কি আছে দেখা ।
কিছু নেই ।
তবে রে, আমি তো মাছের গন্ধ পাচ্ছি।
ঠিক বলেছো। পিসিকে দোবো ।
আমাকে দে বলছি
এই বলে মেছে ভূতটা থলিটা উড়িয়ে নিয়ে বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতে লাগলো। জ্যোৎস্না শুনে ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করতো, সত্যি, বাবারে আমি আর শুনবো না। বলেই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। আমি বলতাম, তারপর থেকে বাবার সঙ্গ ছাড়া আমরা পিসির বাড়ি যেতাম না।
পরে বাবা বুঝিয়ে বলতেন, অই গাছের ডালপালা অন্ধকারে দেখতে ভয় লাগে। ভূত বলে কিছু হয় না ।
তবু আমারএই বিশ্বাস ধরে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে ।আর একবার জ্যোৎস্নাকে গল্প শুনিয়ে ছিলাম। সে অবাক হয়ে শুনেছিলো।
অন্ধ কুসংস্কার কত জনের প্রাণ কেড়ে নেয় আমার মামার বাড়িতে দেখেছিলাম ।
বীরভূম জেলার আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রামে আমার মামার বাড়ি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বক্রেশ্বর নদী ।গাছে গাছে সাজানো গ্রাম । তখন আমার বয়স চোদ্দ কি পনেরো।
আমি মামার বাড়িতে এলে একমাস থাকতাম। আসার দুই দিনের মধ্যেই জানতে পারলাম বুড়ো বটগাছতলায় একটি লোক একমুখ দাড়ি নিয়ে নানা রকমের বিস্ময়কর কাজ করে দেখাচ্ছে। হাত থেকে আগুন বের করে দেখাচ্ছে। প্রচুর লোক তাকে দেখতে আসছে ।
আমি একটা লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আশায় ওখানে যাচ্ছেন।
আরে দাদা, উনি মহাপুরুষ, উনি যা বলেন তাই হয় ।
কি রকম, একটু ভেঙ্গে বলুন ।
একটো ঘটি আছে। ঘটিটো থেকে জল ছিটিং দিছে আর তারপর যা বঁলছে তাঁই হচে।
বীরভূম জেলার ভাষা এইরকমই। শুনতে বেশ ভালো লাগে।
আমি পিছনে পিছনে কথা বলতে বলতে মহাপুরুষের কাছে গেলাম। দেখলাম অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমার ভবিষ্যৎ একটু বঁলে দেন কেনে। মহাপুরুষ তার সঙ্গীকে বললেন, এর সঙ্গে কথা বলে ওর অসুবিধা আমাকে লিখে পাঠা।
মহাপুরুষের প্রায় দশজন সঙ্গী। গ্রামের আদিবাসী পাড়ার কয়েকজনকে বশ মানিয়ে নিয়েছে। বেশ ভালো রকম আয় হচ্ছে তার। একটি তরুন এগিয়ে এসে বললো, এই ফোর জির যুগে চিটিং বাজি। বেটা দেবো তোমার ব্যবসা গুটিয়ে।
মহাপুরুষ রেগে বলে উঠলেন, তোর ফোর জি তে ঝুল জমবে। আমার অভিশাপ বারো ঘন্টার মধ্যে তোর বিপদ হবে। তরুণ টি বলে উঠলো, শোনো নি ফাইভ জি চালু হয়েছে অনেক দেশে। তোমার চিটিং বাজি চলবে না।
পাঁচ ঘন্টার মধ্যে শোনা গেলো তরুণ টি মোটর সাইকেলের ধাক্কায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
মন টা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। সরল মানুষ গুলিকে এরা ঠকিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
অনেক ঘটনা জীবনে জলছবি হয়ে আছে। ঠিকমতো সাজাতে গেলে সুন্দর মুখও অসুন্দর হয়ে যায়। এই পাগলের প্রলাপ শুনতে জ্যোৎস্না বড়ো ভালোবাসতো। সেই ঘটনাগুলো একটু শেয়ার করলাম। বলুন এর মধ্যে ভালোবাসার গল্প কোথায়। তবু সে আমাকে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম কোনো এক ক্ষণে, মাহেন্দ্র ক্ষণে। সে ভালোবাসা টিকে আছে আজও। শরীর পেরিয়ে এক অনুভবের জগৎ এই ভালোবাসা। সব নিয়ম অমান্য করে জীবনের এই গল্প, এই কবিতা আমার জীবনে চলার পাথেয়।
আজ নববর্ষ। একটা চিঠি লিখলাম জ্যোৎস্না কে।
হে নীরবতার অতীত,
নববর্ষের পূণ্য লগ্নে সবার আনন্দে অংশীদারী হয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নেবো। সকলের সুখ দুঃখেই আমার অংশগ্রহণে মনের ময়লা সাফ হয়ে গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী। নববর্ষে শপথ নেবো কেউ কারো নিন্দা করবো না। ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে পারস্পরিক বোঝা পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবো। সকলের সুখেই সমাজের মঙ্গল। ভারতবর্ষের এই সনাতন ঐতিহ্য অটুট রেখে, জাত পাতের বালাই দূরে রেখে এগিয়ে যাবো সবাই এক সুন্দরের আহ্বানে। আপন আপন কর্মে সবাই স্থির থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবো। একজন আদর্শ মানুষ হবার চেষ্টায় রত থাকলে হিংসা, ঘৃণা, পরশ্রীকাতরতা দূরে সরে যাবে। মনে রাখতে হবে কবির বাণী, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। আর মনে রাখতে হবে কিছুই আমি সাথে আনি নি, কিছু আমরা নিয়েও যাবো না। একমাত্র ত্যাগের এই সনাতন বাণী আমাদের প্রকৃত মানুষের মর্যাদা দিতে পারে।
এই চিঠি লেখার অনেক পরে জ্যোৎস্নার চিঠি পেয়েছিলাম। জানতে পেরেছিলাম তার অনেক খবর। সে স্বাধীন, মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার। আমার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করবার আভাষ জানিয়েছিলো। আমি চাই নি। পুরোনো জ্যোৎস্নার আলোতে তাকে পোড়াতে আমার মন বাধা দেয় বারবার। অবশ্য তার চিঠিতে তার অর্ধদগ্ধ মনশরীরের পোড়া চেহারা ভেসে উঠেছিলো আকাশ জুড়ে...
সুদীপ ঘোষাল
লেখক, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম বঙ্গ
বিষয়: সুদীপ ঘোষাল
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: