সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০

সিয়েরা লিওন - গৃহযুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা : সুভাষ দে


প্রকাশিত:
১১ আগস্ট ২০২০ ২১:৩০

আপডেট:
১১ আগস্ট ২০২০ ২২:২২

ছবিঃ সিয়েরা লিওন

 

রিপাব্লিক অফ সিয়েরা লিওন, আফ্রিকার পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত এই দেশটিতে আফ্রিকার সব থেকে বেশি হিরের খনি আছে। দেশটির উত্তর ও উত্তর-পূর্বে গিনি, দক্ষিণ-পূর্বে লাইবেরিয়া এবং পশ্চিম ও দক্ষিণে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও হিরের খনির মতো প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও দেশটি একসময় গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হয়ে ছিল। ইংরেজদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পর একটি দেশ বিভিন্ন ভুল মানুষের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার পর দারিদ্র্যতা, বেকারত্ব, দুর্নীতি সহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্ম কিভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে একটা গোটা জাতীকে ঠেলে দিয়েছিল সেই গল্পই শোনাবো আজ-

১৯৬১ সালে ব্রিটেনের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সিয়েরা লিওন। প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার মিলটন মারগাই। ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনিই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর শাসনকালকে দুর্নীতির সময় বলে চিহ্নিত করা হয়। ভোটের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা, বেকারত্বের সমস্যা এসব সেই সময় থেকেই শুরু হয়, শিক্ষা ও সামাজিক পরিকাঠামো সম্পূর্ণ রূপে ভেঙে পড়ে। পরবর্তী চার বছর শাসনভারের দায়িত্বে ছিলেন পূর্বতন প্রধানমন্ত্রীর ভাই অ্যালবার্ট মারগাই। তিনি দেশ ও ক্ষমতাকে নিজের সম্পত্তি ভাবতেন। স্বজনপোষণের নীতি তাঁর সময় থেকেই শুরু হয়। নিজের দলের ও পরিবারের সদস্যদের সুবিধা দেওয়ার জন্য কিছু প্রোজেক্ট চালু করেছিলেন, বিশ্ব যাকে "পোষ্য প্রোজেক্ট" বলে চেনে। ১৯৬৮ সালে যখন সিয়াকা স্টিভেন প্রধানমন্ত্রী হন তখনও পর্যন্ত সিয়েরা লিওন ছিল গণতান্ত্রিক দেশ, সতেরো বছর পর যখন তিনি গদি ছাড়েন তখন সেদেশে শুধু মাত্র তাঁর নিজের রাজনৈতিক দলেরই অস্তিত্ব ছিল। কূটনীতিবিদরা এই সময়কাল কে "পঙ্গপালের সতেরো বছর" বলে অভিহিত করেন। রাজ্যের স্বাধীকার ভঙ্গ করা, পার্লামেন্টের অধিকার খর্ব করা, বিচারপতিদের নিজেদের হাতের মুঠোয় আনা ও রাজকোষ খালি করে দেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য কুখ্যাত তাঁর শাসনকাল। ১৯৮৫ সালে যখন তিনি গদি ছাড়লেন তখন তাঁর স্থানে এলেন মেজর জেনারেল জোসেফ মোমোহ। তাঁর সাত বছরের শাসনকালে দুর্নীতি উত্তোরোত্তর ভাবে বেড়ে গেল, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধসে গেল। শেষের দিকে সাধারণ জনগন দারিদ্র্যতা ও বেকারত্ব সহ্য করতে না পেরে সরকারি ভবনে লুটপাট করতে শুরু করলো। এমনকি রাজধানী ফ্রিটাউনে পর্যন্ত হামলা চললো। গ্যাসোলিনের কারখানা দখল করে নিল জনগণ। হিরে, সোনা, বক্সাইট, আকরিক লোহা, মাছ, কোকোয়া, কফি ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে ভর্তি দেশ সিয়েরা লিওন ১৯৯১ সাল আসতে আসতে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশে পরিণত হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণির বহু মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেল।

অবশেষে ২৩শে মার্চ, 1991 Revolutionary United Front (RUF) ও Charles Taylor এর National Patriotic Front of Liberia (NPFL) একযোগে জোসেফ মোমোহ -র সরকারকে অপসারণ করতে সামর্থ হলো আর সেদিন থেকে শুরু হলো পশ্চিম আফ্রিকার সবথেকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে একটি, সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ। লাইবেরিয়ার প্রথম গৃহযুদ্ধের ফলে সেদেশ থেকে প্রায় ৮০,০০০ মানুষ লাইবেরিয়া-সিয়েরা লিওন সীমান্তে পালিয়ে আসে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বাচ্চা। তাদের সেই সময় দরকার ছিল খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও চিকিৎসা সুবিধার। রুফ এই সুযোগ ছাড়েনি, তারা বুঝতে পেরেছিলো এই সমস্ত গৃহহীন উদ্বাস্তুদের তাদের দলে যোগ দেওয়াতে পারলে একটা বিশাল শক্তিশালী বাহিনী গঠন করা যাবে। কখনও ভয় দেখিয়ে তো কখনও জোড় করে রুফ সেইসব মানুষদের দলে যোগ দেওয়াতে বাধ্য করে, গঠিত হয় "চাইল্ড সোলজার"। বই-খাতা ধরার বয়সে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় অ্যাসল্ট রাইফেল। লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গদ্দাফি রুফ ও অন্যান্য সংগঠনের প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করেন ও তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দেন। রাশিয়ান ব্যবসায়ী ভিক্টর বৌট অস্ত্র যোগানের ব্যবস্থা করেন।

১৯৯১ এর শেষ হতে হতেই রুফ সিয়েরা লিওনের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকের এক বৃহৎ অংশে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপনে সফল হয়। এই অংশগুলোতেই মূলত হিরের খনি গুলো ছিল। ১৯৯৩ এর শেষের দিকে সিয়েরা লিওন আর্মি (SLA) রুফ সহ অন্যান্য বাহিনীকে অধিকৃত অংশ থেকে  লাইবেরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত সরিয়ে দেয়। কিন্তু এক নতুন বিপদের সৃষ্টি করে এই SLA। এই সময় রুফ দ্বারা অধিকৃত অংশগুলিকে মুক্ত করার পর SLA সাধারণ মানুষের ঘর-বাড়ি থেকে লুটপাট করতে শুরু করে। এছাড়াও যেকোন জায়গা মুক্ত করে সেখানকার জনগণকে সরিয়ে এনে রাখা হত কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে, সেখানে চলতো তাদের উপর অত্যাচার। রুফের পর নিজের দেশের আর্মির এই কাজে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে সাধারণ জনগণ। এছাড়াও আর্মির মধ্যে পর্যাপ্ত অনুশাসনের অভাবে তাদের এক বিশাল অংশ রুফে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবতে থাকে। তাদের মনে হয় যে সেনাবাহিনীতে থেকে এই কাজ করার থেকে রেবেলদের সাথে যুক্ত হয়ে এই কাজ করলে, বেশি স্বাচ্ছন্দে করতে পারবে। রুফ আর আর্মিতে কোন তফাৎ না থাকায় অতিষ্ঠ জনগণ আর্মিদের এক বিশেষ নামে ডাকতো, Sobels যার অর্থ soldiers by day, rebels by night। যে জওয়ান দিনের বেলায় তাদেরকে মুক্ত করতে আসছে তারাই রাতের অন্ধকারে অত্যাচার চালাচ্ছে।

 

লাইবেরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পিছু হটেও রুফ কখনই যুদ্ধ করা থামায়নি। পশ্চিম আফ্রিকার এই দেশটিতে শান্তি ফেরাতে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বেসরকারি সেনাবাহিনী "এক্সিকিউটিভ আউটকাম" পাঠিয়েছিল, কিন্তু তেমন কোন সুরাহা হয়নি। বহু রাজনৈতিক টালমাটালের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর অবশেষে আবিদান শান্তি চুক্তির মাধ্যমে জাতীসংঘ তাদের শান্তিবাহিনী পাঠাতে উদ্দোগী হয়। এই শান্তিবাহিনীতে ভারত ছাড়াও নেপাল, ঘানা, ব্রিটেন ও নাইজেরিয়া ছিল। ১৯৯৯ এর অক্টোবর মাসে সিয়েরা লিওনে পৌছায় জাতীসংঘের শান্তিবাহিনী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ভারতের জেনারেল বিজয় জেটলি। প্রথমে ৬০০ জনকে পাঠানো হলেও ফেব্রুয়ারি মাস আসতে আসতে সেই সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ১৭,৫০০ তে। ভারতীয় সেনার ৫/৮ গোর্খা রাইফেল ইনফেন্ট্রি ব্যাটেলিয়ন গ্রুপ এই শান্তিবাহিনীতে অংশগ্রহণ করেছিল। বিপত্তি ঘটে মে মাসে, প্রায় ৫০০ জন শান্তিবাহিনীর সদস্যকে বন্দী বানিয়ে নেয় রুফ, এর মধ্যে ২২৩ জন ভারতীয় সেনা ও জাতীসংঘের কিছু উচ্চপদস্থ আধিকারিকও ছিলেন। তাদের থেকে সমস্ত অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিনিয়ে নিয়ে দারুতে বন্দী করে রাখা হয়। এবং রুফের একটি অংশ রাজধানী ফ্রিটাউনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বন্দী থাকা জাতী সংঘের আধিকারিক ও গোর্খা রাইফেলের সৈন্যদের মুক্ত করতে ভারত সরকার ১২০ জনের এক বাহিনীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যাতে ছিল প্যারা ফোর্স যারা দারুতে পৌছে উদ্ধার কার্য চালাবে আর সাথে থাকবে বিমানবাহিনীর গরুড় কমান্ডো আকাশ থেকে সাহায্য করার জন্য। মিশনের নাম ছিল অপারেশন খুকড়ি। নির্দিষ্ট দিনে আবহাওয়া খারাপ থাকায় আকাশ থেকে সহযোগিতা করতে সময় লাগবে বলে জানালেও স্থলভাগের প্যারা কমান্ডোর নেতৃত্বে থাকা মেজর হারিন্দার সুদ মিশন শুরু করার নির্দেশ দেন। আসলে তিনি সময়ের সঠিক মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন। মিশন সফল হওয়ার মুখে তিনি আরও একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা বিশ্ব দরবারে ভারতীয় সেনার সম্মান বাড়িয়ে দেয়। তিনি তাঁর সেনাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন আগে জাতীসংঘের আধিকারিকদের মুক্ত করা হয়, তারপর গোর্খা রাইফেলের সেনাদের। মেজরের সময়জ্ঞান ও দূরদর্শী চিন্তাভাবনার জোড়ে অপারেশন খুকড়ি সফল হয়। ওই একই সময়ে ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর অপারেশন পালিসার ফ্রিটাউন থেকে রুফকে হটতে বাধ্য করে। বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত শান্তি  স্থাপিত হয়।

 

ভারত ও ব্রিটেনের অপারেশন ছাড়াও গিনি সীমান্তে রুফের বেস ক্যাম্পের উপর লাগাতার বোমা হামলাকে এই শান্তি স্থাপিত হওয়ার পিছনে এক বড়ো কারণ হিসেবে দেখা হয়। এছাড়াও জাতীসংঘ লাইবেরিয়াকে চরম বার্তা পাঠায়, তারপরেই তারা রুফকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ সহ সমস্ত ধরণের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। চারিদিক থেকে কোনঠাসা হয়ে পরা রুফ অনতিবিলম্বেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ১৮ই জানুয়ারি ২০০২, রাষ্ট্রপতি কাব্বা যুদ্ধ জয়ের কথা ঘোষণা করেন, আর সাথে সাথে শেষ হয় টানা এগারো বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৫০,০০০ জন মানুষ মারা যায়। অসংখ্য শিশুকে যুদ্ধে নামানো হয়। এছাড়াও বহু মহিলাকে বলপূর্বক বিবাহকরা বা সেনাতে ভর্তি করানো হয়। যৌন নিপিড়ন চালানো হয় মহিলাদের উপর। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই সকল মানুষের সুবিচারের হেতু স্থাপন করা স্পেশাল কোর্ট। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আওতায় আনা হয়। ২০০২ এর নভেম্বর মাসে জাতীসংঘের শান্তিবাহিনী সিয়েরা লিওন থেকে ফিরে আসে। জন্ম হয় এক স্বাধীন, গণতান্ত্রিক  সিয়েরা লিওনের। সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন আহমেদ তেজান কাব্বাহ। দেশে মানবাধিকার বজায় রাখার জন্য স্থাপিত হয় Truth and Reconciliation Commission। যেসকল বাচ্চারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য পাঠানো হয় rehabilitation center এ। সরকারি ভবন পুননির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সরকারি কাজ ও দেশ পুনর্গঠনের কাজে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪৭৫ মিলিয়ন ইউরো প্রদান করে। হিরের উপর কর দশগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, ২০০০ সালের ১০ ডলার থেকে ২০০৪ সালে ১৩০ ডলারে নিয়ে যাওয়া হয়। অসংখ্য জীবনের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া স্বাধীনতার পর সিয়েরা লিওনে শান্তি রক্ষার্থে বাংলাদেশের শান্তিবাহিনীর সম্মানে রাষ্ট্রপতি কাব্বাহ ২০০২ এর ডিসেম্বর মাসে সেদেশের সাম্মানিক সরকারি ভাষা রূপে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেন। সিয়েরা লিওনের গৃহযুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময় নিয়ে যে কয়েকটি সিনেমা বেড়িয়েছিল তার মধ্যে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর Blood Diamond সব থেকে বেশি জনপ্রিয়।

একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত সিয়েরা লিওন আজ পর্যটন শিল্পে বেশ উন্নতি করেছে। খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশটি ধীরে ধীরে মূলস্রোতে ফিরে এসেছে। আর এখানেই জয় হয় গনতন্ত্রের, শান্তির। ভালো থাকুক সাভানা তৃণভূমির দেশ, স্বাধীন থাকুক সেখানকার মানুষজন।

 

সুভাষ দে
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা


বিষয়: সুভাষ দে


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top