সিডনী রবিবার, ৫ই মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর “জুলিও কুরি শান্তি পদক” অর্জনঃ বাংলাদেশের সফল পররাষ্ট্রনীতির স্বীকৃতি : কৃষিবিদ শেখ মোঃ মুজাহিদ নোমানী


প্রকাশিত:
১৩ আগস্ট ২০২০ ২১:০২

আপডেট:
১৪ আগস্ট ২০২০ ০৫:০৬

 

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একসূত্রে গাঁথা দুটি নাম। তাই বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা,বাংলাদেশের অভ্যুথয়ের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই যে ০৪ টি বিষয় সবার আগে চলে আসে তা হলো ক) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা, খ) ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৭১ এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর আগুন ঝড়ানো ঐতিহাসিক ভাষণ, গ) নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন, ঘ) আর সবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ -এ স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তারপর ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল হতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। শাহাদাৎ বরণের পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সাড়ে ৩ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশের শক্ত অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপনের সোনালী সময়। রাজনীতির শুরু হতেই সাধারণ মানুষের ক্ষুধা নিবারণ ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার ইস্পাত-দৃঢ় স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু লালন করেছেন, ধারণ করেছেন সবসময়। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন এদেশের শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত জনগণের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।

তাই ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝেছিলেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ক্ষত-বিক্ষত স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। আর তাই বঙ্গবন্ধু হাতে নিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত সোনার বাংলা পুনর্গঠনে ১৯৭৩ -৭৮ মেয়াদি প্রথম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা। গ্রহণ করা হয় কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ। পাশাপাশি গ্রহণ করলেন উদার ও কার্যকর পররাষ্ট্র নীতি এবং তার বাস্তবায়ন। মুক্তির সুদীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে যে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সেই রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে মূলনীতি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। মূলত মানুষের কল্যাণই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। একইভাবে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিও ঠিক করেছিলেন সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থেকে একে অন্যকে সহযোগিতা করার মহান ব্রত অর্থাৎ ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান’।

বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহ নিচে উপস্থাপন করা হলেঃ বঙ্গবন্ধুর স্বচ্ছ পররাষ্ট্রনীতির আলোকে আরেকটি ঘটনা না বললেই নয়। তা হলো ০৯ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্তি পেয়ে লন্ডন ও ভারত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরৎ আসার পথে দিল্লিতে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু বলেন “আজ বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র”। বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ পাশাপাশি ভাই ভাই হিসেবে বাস করবে শান্তিপূর্ণভাবে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ' শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শের মিল কেন? বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, ' এটা আদর্শের মিল, নীতির মিল,এটা মনুষ্যত্বের মিল,এটা বিশ্বশান্তির জন্য মিল'। বঙ্গবন্ধুর এ কথা শুনে সেদিন সমবেত জনতা করতালিতে ফেটে পড়ে। তাছাড়া বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি বলেছিলেন, “বঙ্গবন্ধু সমগ্র বিশ্বের মানবমুক্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনার ও আত্মদানের মূর্ত প্রতীক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিশ্বের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রামের এক অনন্য দৃষ্টান্ত”

বঙ্গবন্ধুর ভারত সফর ঃ ১৯৭২ এর ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রথম সরকারী বিদেশ সফর। প্রথমেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী পরমমিত্র প্রতিবেশী দেশ ভারত সফর করেন। সেদিন কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। কলকাতার মানুষ সেদিন বাড়িঘর ছেড়ে জনসভায় ছুটে এসেছিল।
এখানেই শেষ নয় বঙ্গবন্ধুর অসীম দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে নীচের ঘটনাটি। ভারতের রাজভবনে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন “আপনি আমার জন্মদিন আগামী ১৭ মার্চ ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমি চাই সেদিন আপনার সফরের আগেই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ হতে ফিরিয়ে নিবেন” শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। শান্তিপূর্ণ আলোচনা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্যেই বঙ্গবন্ধুর এই দ্রুত সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছিল।


বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর ও কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগদান ঃ বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্রনীতির আরও একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে একই বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন দিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী প্রস্তাবের বিপক্ষে ' 'ভেটো ' ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তাছাড়া ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল লিওনিদ ব্রেজনেভ (যিনি পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন) এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।


স্বদেশ প্রত্যার্বতনের দিনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতিসংঘ ও বিশ্ববাসীর প্রতি আহবানঃ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় আবেগঘন অনেক বক্তব্যের মাঝে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃৃতায় দেশের জন্য উদ্বেগ-উৎকন্ঠা চাপা না রেখে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন,' আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয় হারা,তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্যদানের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি '। তিনি বলেন, ' পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে যে গণহত্যা করেছে তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহবান জানাই'। তিনি তাঁর বক্তৃতায় আরো বলেন ' বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে। বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নেই '।

বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পদক অর্জন ঃ একজন নবীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শুরুটাই হয়েছিল মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি-শান্তি আর কল্যাণের স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে যখন তিনি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই আসে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তিতে অবদান রাখায় ১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাঁকে “জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করে”। রাষ্ট্র পরিচালনার মাত্র ১ বছর ৪ মাস ১২ দিনের মাথায় ২৩ মে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুকে' জুলিও কুরি' শান্তি পুরস্কার প্রদানের জন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ যে ঘোষণা দেয় তার অন্যতম কারণ ছিল সফল পররাষ্ট্রনীতি ও বিশ্বে শান্তির স্বপক্ষে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন। যার কিছু ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ৪৭ বছর আগে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুর গলায় ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে”। রমেশ চন্দ্র সেদিন যে ভুল কিছু বলেননি, তার প্রমাণ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান রেখেছিলন। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে শান্তি মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে নেতৃত্ব, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) যোগদান ইত্যাদি ছিল তাঁর বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধুতে পরিণত হওয়ার প্রমাণ।

দুই পরাশক্তির স্নায়ু যুদ্ধের সময় পুরো পৃথিবী যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিভক্ত ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে বিশ্বশান্তি ও ন্যায়ের পথে হেঁটে ছিলেন এমনকি নির্ভয় ও দৃঢ় চিত্তে তিনি বলেছিলেন “পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যায় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরীব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে”। আর এসব কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। এ সম্মান পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছিলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের। জুলিও কুরি শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির।’

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিশ্ব শান্তির সংগ্রামে যে অবদান রেখেছেন, তা চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির স্বপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য বরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পদকে’ ভূষিত করে আসছে। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, ইয়াসির আরাফাত, সালভেদর আলেন্দে, নেলসন ম্যান্ডেলা, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, কবি ও রাজনীতিবিদ পাবলো নেরুদা, জওহরলাল নেহেরু, মার্টিন লুথার কিং, লিওনিদ ব্রেজনেভ প্রমুখ বিশ্ব নেতাদের এই পদকে ভূষিত করা হয়। বিশ্বশান্তি পরিষদের শান্তি পদক প্রাপ্তি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের ও সফল পররাষ্ট্র নীতির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্র নীতির আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাঃ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি লাভ করে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হন। সে সময় বাংলাদেশ যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে 'কমনওয়েলথ অব নেশনস্', জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ', 'ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা ' ও ‘জাতিসংঘ '। এ চারটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

আরও উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩-এর ৩ আগষ্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সেদিন সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বৃহৎ শক্তি বর্গের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ' হোয়েন এলিফ্যান্ট প্লেসেস, গ্রাস সাফারস।' তাঁর এই বক্তৃতা উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিল।

জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সফল অংশ গ্রহন ঃ আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৭৩-এর সেপ্টেম্বরে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ছয়জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দুই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো। আর প্রয়াত চারজন নেতা ছিলেন মিসরের জামাল আবদুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড.সুকর্ণ, ঘানার কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। আলজেরিয়ায় মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ' বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে। 'বঙ্গবন্ধুর হিমালয়সম আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব আর অসাধারণ বাগ্মীতাও পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বিশাল সফল অবদান রেখেছে যা নীচের ঘটনা সমূহে প্রতিয়মান হয় :-


বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানে ইসলামিক সম্মেলনে যোগদানঃ ১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ইসলামিক সম্মেলনে যোগদানের জন্য পাকিস্তান গমন করেন। সে সময় বঙ্গবন্ধু যখন লাহোর বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তখন রাস্তার দু-পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের জনগণ শ্লোগান তুলেছে 'জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব ', অর্থাৎ “মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ”। শুধু তাইনয় লাহোরে এই সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছিল। শালিমার গার্ডেনে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানেও সবার আকষর্ণের কেন্দ্র বিন্দু ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু এমন আত্মমর্যাদাবান নেতা ছিলেন যে, সেদিন সৌদি বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, 'ইউর ম্যাজেস্টি,আপনি আমার দেশকে স্বীকৃতি না দিয়েও আমার দেশের মানুষকে হজ্জব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছেন বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

যুগোস্লাভিয়া, জাপান ও মিশর সফর ঃ যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো ও প্রধানমন্ত্রী জামাল বিয়েদিস বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্ব-শরীরে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তদ্রুপ জাপান সফরে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা এবং মিসর সফরকালে মিসরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাতও বিমানবন্দরে স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। জাপান সফরকালে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন 'যমুনা সেতু' নির্মানে জাপানের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আদায় করে এনেছিলেন। যা আজকে ' বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু ' নামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বাংলায় ভাষণ প্রদানঃ আরেকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মান ও গর্বের বিষয়, তা হলো ১৯৭৪-এর ২৪ সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর প্রথমবারের মত বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান। সেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ' আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।' তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠেছিল। অধিবেশনে সমাগত বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বিনম্র সম্বোধন জ্ঞাপন করে জাতিসংঘকে 'মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট' উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাঙ্খা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্য আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে '। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেদিন ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের শ্রদ্ধাঃ উপরে বর্ণিত ঘটনা সমূহ হতে এটাই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বনেতৃবৃন্দের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। সেদিন অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলেছিলেন “বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন, তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।” আর তাই জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বিশ্বে বিরল।” বঙ্গবন্ধু যেখানেই গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন।

তার অন্যতম প্রমাণ হচ্ছে একজন নবীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে স্বল্প সময়ের মধ্যে “জুলিও কুরি শান্তি পদক” অর্জন যা বঙ্গবন্ধুর ও বাংলাদেশের জন্য ছিল এক বিরাট সম্মানের ও গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর 'জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার' অর্জন ছিল দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি যা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানেনা। আর তাই প্রজন্ম হতে প্রজান্মান্তরে জানানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সফল পররাষ্ট্র নীতি ও বিশ্ব সভায় বিরাট অবদান রাখা নিয়ে রচিত ' বঙ্গবন্ধু ! এক মহানায়কের অমর কীর্তি গাঁথা ' শীর্ষক স্বরচিত কবিতার শেষের ৪টি লাইন দিয়ে আজকের নিবন্ধ শেষ করছিঃ-
'ভারত, জাপান, রাশিয়াসহ বহু দেশ-মহাদেশ ঘুরে,
'বঙ্গবন্ধু সেতু'সহ বহু সফল উন্নয়ন চুক্তি করে।
আমৃত্যু দেশে বিদেশে শান্তি আর ন্যায়ের সুবাতাস ছড়িয়ে,
১৯৭৩ সালে ' জুলিও কুরী শান্তি পদক 'নিয়ে এলে দেশে,
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলায় প্রথম ভাষণ দিয়ে ফিরে এলে শেষে।


*'বঙ্গবন্ধু জাতীয় ক…ষি পদক 'প্রাপ্ত কৃষি সাংবাদিক, উদ্ভাবক, অব: প্রাপ্ত উপ পরিচালক ও জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার, জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিস, এসসিএ (কৃষি মন্ত্রণালয়) এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত পরিষদ, ঢাকা।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top