জাতীয়তাবাদী মহান বিপ্লবী ভগৎ সিং বনাম জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী : বটু কৃষ্ণ হালদার


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:২০

আপডেট:
১৪ মার্চ ২০২৫ ২২:৫৩

ছবিঃ ভগৎ সিং ও মহাত্মা গান্ধী

 

১৩ ই এপ্রিল ১৯১৯ শাল ভারতের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসে এক কলঙ্কময় দিন।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা হল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এই হত্যাকাণ্ড কালো অধ্যায় হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখে অবিভক্ত ভারতে পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই কুখ্যাত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। পাঞ্জাব প্রদেশের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বদ্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। সাধারণ নিরীহ জনগণের উপরে এটি ছিল ব্রিটিশদের পরিকল্পনামাফিক গণহত্যা। এই গণহত্যায় ব্যবহৃত করা হয়েছিল "Lee Enfield"নামক বন্দুক। হামলা চালিয়েছিল নবম রাইফেল সের রাইফেল ম্যান, ৫৪ তম শিখ এবং ৫৯ তম সিন্ধ রাইফেলস এবং ব্রিটিশ ভারত সেনা। ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রচেষ্টা হবার পর থেকেই এই রাজনীতিক দলের প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনের দিন থেকেই ন্যায়বিচার ও স্বায়ত্তশাসন লাভ করা। কিন্তু ব্রিটিশরা এ দাবি মেনে নেননি।ইংরেজদের যুক্তি ছিল ভারতবর্ষ অনুন্নত ও স্বায়ত্তশাসন এর উপযুক্ত নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারতে উন্নত চিন্তার প্রসার ঘটতে থাকে। বহু জায়গায় রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, টেলিগ্রাফ ও বসানো হয়। কিছু কিছু কলকারখানা ও স্থাপন করা শুরু করে। প্রথমদিকে মূলত কাপড়ের কারখানায় বেশি প্রাধান্য লাভ করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রাধান্য লাভ করতে শুরু করে। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার মত বৃহৎ শক্তি ক্ষুদ্র শক্তি জাপানের কাছে পরাজিত হয়। রাশিয়ার স্বৈরাচারী জারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দানা বাঁধতে শুরু করে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ধনতান্ত্রিক দেশ গুলোতে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিতে থাকে। এর ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোর দখল করে নিজেদের মধ্যে বন্টন করার নেওয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তারই ফলশ্রুতি ছিল ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ।এই যুদ্ধে জার্মানি, ইংল্যান্ড তথা মিত্র বাহিনীর হাতে পরাস্ত হয়। মজার বিষয় হলো এই যুদ্ধে পরাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনী ও অংশ নিয়েছিল।কারণ ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই যুদ্ধে অংশ নিলে পরাধীন দেশ গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। এই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে মহাত্মা গান্ধীর সহ অনেকেই তাদের অনুগামী নিয়ে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতবাসীকে উৎসাহিত করতে থাকে।

১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। স্বায়ত্তশাসন  তো দূরের কথা, যেসব সৈন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে নিজে নিজে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে তীব্র সন্দেহের মেঘ জমতে থাকে। ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের আসল স্বরূপ চিনতে শুরু করে। সেই সন্দেহ থেকেই ভারতবাসীর মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে শুরু করে এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। ঠিক সেই মুহুর্তে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য একদিকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন করে ভারতবাসীকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, অপরদিকে রাওলাট আইন প্রবর্তিত করে ইংরেজ সরকার বিরোধী সকল বিক্ষোভকারীকে কঠোর হাতে দমনের জন্য নির্যাতনমূলক আইন পাস করেন। এই আইন ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিনা কারণে গ্রেপ্তার অভ্যন্তরীণ ও সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার বন্দিত্বের সাথেই বেপরোয়া পদক্ষেপ গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধী তখন অহিংস ও সত্যাগ্রহ তথা রক্তপাতহীন আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু করেন।এই সালের এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধীজিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই প্রতিবাদে আমেদাবাদের শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। জনগণের আন্দোলনমুখী কার্য কলাপ দেখে ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তাতেও বিক্ষোভ কমেনি। শুরু হয় ধর্মঘট, চারিদিকে ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি দপ্তর বন্ধ করে দেওয়া হয় সাথে সাথে যানবাহন পুড়িয়ে দেওয়া হয়।১৯১৯ সালে ১৩ ই এপ্রিল ভারতীয় স্বাধীনতাকামীরা তৎকালীন ব্রিটিশদের কালা আইনের বিরুদ্ধে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক স্থানে বিক্ষোভের জন্য জড়ো হতে শুরু করে। সেইরাজনৈতিক সভায় বেশ কিছু শিখ তীর্থযাত্রী ও ছিলেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ার খবর পেলে শহরের জালিওয়ানবাগে বিক্ষোভের জন্য মানুষজন জড়ো হচ্ছে।তিনি সাথে সাথেই একদল সৈন্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে গেলেন।ওই দিনের ঘটনার সম্পর্কে যে রিপোর্ট তিনি বৃটিশ সরকারকে দিয়েছিলেন তার বর্ণনা ছিল:_"সরু একটি গলির ভেতর দিয়ে আমি উদ্যানে ঢুকলাম। রাস্তা সরু হওয়া আমাকে আমার সাঁজোয়া  গাড়ি রেখে আসতে হয়েছিল। পার্কে ঢুকে দেখলাম হাজার পাঁচেক মানুষ। একজন মানুষ একটি উঁচু বেদীতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে ভাষণ দিচ্ছে। আমি সাথে সাথে বুঝলাম মানুষের তুলনায় আমার সাথে সৈন্যদের সংখ্যা অনেক কম। আমি গুলির নির্দেশ দিলাম। ২০০ থেকে ৩০০ লোক মারা যায়। ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। সন্ধ্যে ৬ টায় আমি সেনা সদর দপ্তরে ফিরে যাই"। সার্জেন্ট উইলিয়াম অ্যান্ডারসন ব্রিগেডিয়ার ডায়ারের অধীনে কাজ করতেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে পরে তিনি লিখেছিলেন_"যখন গুলি শুরু হলো, মানুষ মাটিতে শুয়ে পড়তে লাগলো। কেউ কেউ উঁচু দেয়াল বেয়ে উঠে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তার যে আমাদের দিকে তেড়ে আসবে, সেই ভয় তখন আমার হয়নি"। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ ছিল_"ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জন্ম নিয়েছে তার ৬০ বছর আগের সিপাহী বিদ্রোহের মত কোন বিদ্রোহী তৎপরতার জন্ম দিতে পারে। গণহত্যার ওই ঘটনার আগে থেকেই অনেক ব্রিটিশ বালিশের নিচে পিস্তল রেখে ঘুমাতে শুরু করেছিল। তাদের ভিতর ঢুকে ছিল খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। তারা ভয় পাচ্ছিল ভারতীয়রা তাদের অজান্তেই বিদ্রোহ শুরু করবে । ব্রিটিশ পরিবারগুলো হুমকিতে পড়বে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধসে পড়তে পারে।সে সময়ে গান্ধী দেশে এসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন।ব্রিটিশরা এই ধরনের প্রতিবাদ এর ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিল না। পরিস্থিতি তাদের আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে। ব্রিটিশরা এটাকে আর রাজনীতি ভাবতে পারছিলেন না। কারণ তাদের মনে আরেকটি বিদ্রোহের ভয় ঢুকে গিয়েছিল"।

ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে পড়ে ব্রিটিশ সরকার একটি তদন্ত করে। রিপোর্টে নিহতের সংখ্যা বলা ছিল ৩৭৯। কিন্তু ভারতীয়দের তদন্তে এই সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার। তবে কত লোক সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগের ছিলেন তা নিয়ে নানান বক্তব্য রয়েছে। মৃতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন শিশু ও মহিলা। রতন দেবী নামে এক মহিলার স্বামী সেদিন ওই গণহত্যার শিকার হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে যেতে পারেননি। কারণ ব্রিটিশ  রা ঘটনার পরপরই শহরে কারফিউ জারি করেছিল। রতন দেবীর স্মৃতিচারণ ছিল এরকম_"পুরো মাঠ জুড়ে শুধু রক্ত আর রক্ত। আমি আমার মৃত স্বামীর পাশে বসে ছিলাম। কুকুরের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। সারা রাত একা এভাবে বসে ছিলাম। কানে আসছিল কুকুরের ঘেউ ঘেউ। মাঝেমধ্যে গাধার চিৎকার এবং অসংখ্য আহত মানুষের কাতরানি"। শুধু তাই না বুলেট বা গুলির চিহ্ন দেয়ালের এবং পাশের বাড়ি থেকে আজও দেখা যায়।সে সময় বেশিরভাগ মানুষ বুলেট থেকে নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তৎকালীন কংগ্রেস নেতা সিএফ এন্ড্রুজ এই ঘটনাকে কসাইখানার গনহত্যার সমতুল্য বলে নিন্দা করেছেন।

 ১৯১৯ সালের কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ নিশংস হত্যাকাণ্ড ভগৎ সিং এর মনে গভীর রেখাপাত করে। যখন সে এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা শোনেন তখন ভগৎ সিং খুব ছোট ছিল। সেই ছোট্ট বেলায় বিদ্রোহের আগুন শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে তার ছোট্ট শরীরে। ছোট্ট শিশুর অবুঝ মনে মাটির টানে বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। বাসে উঠে প্রায় ৫০ মাইল দূরে অমৃতসরের জালিয়ান ওয়ালাবাগে ছুটে যান। সমকালীন উত্তপ্ত পরিবেশকে উপেক্ষা করে কুড়িয়ে আনেন সেখানকার  রক্তরঞ্জিত মাটি। সেই রক্তাক্ত পবিত্র মাটি তাকে আরো বিদ্রোহী করে তোলে। শিশুর অবুঝ মন মেনে নিতে পারেনি নির্মম হত্যার লীলাখেলাকে।এই মাটি ছিল তার কাছে বিদ্রোহের প্রতীক। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এর বদলা সে একদিন নেবেই। এইভাবে ছোটবেলা থেকেই ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা আর বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এসেছেন। আর দেশকেমুক্ত করার সংকল্প নিয়ে অবশেষে নিজের জীবনকে বাজি রেখে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ভগৎ সিং মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। প্রকাশ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতা করতে থাকেন এবং সরকারি স্কুল বইও বিলিতি স্কুল ইউনিফর্ম পুড়িয়ে ফেলেন। ১৯২২সালে ৫ই ফেব্রুয়ারি হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরাচৌরি গ্রামে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনে হটিয়ে দেবার জন্য পুলিশ নিরীহ জনতার উপর গুলি চালিয়ে বেশ কিছু নিরীহ জনসাধারণ ও কৃষকদের হত্যা করা হয়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাও করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় থানার ভিতরে ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যান। এই ঘটনায় মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।এতে হতাশ হয়ে পড়েন ভগৎ সিং। পরে তিনি প্রকাশ্য বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান এবং সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থায় ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের উৎখাত করার কথা প্রচার করতে থাকেন।ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের জন্য পুলিশকে সঠিক ক্ষমতা প্রদান করে দৃঢ় প্রতিরক্ষা আইন পাস করার সমস্ত প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেন। ১৯২৯সালে ২৮ শে এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাস করানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই আইন রুখে দেওয়ার জন্য ভগৎ সিং হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। দলের নেতা ভগৎ সিং এর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ২৮ শে এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে এর প্রতিবাদে বোমা নিক্ষেপ করা হবে। উদ্দেশ্য রক্তপাত ঘটানো নয়, তারা চেয়েছিলেন'বধিরদের কানের কাছে আওয়াজ তুলতে। যারা জেগে ঘুমাচ্ছেন তাদের ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করার প্রয়াস করতে থাকেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করে"ইনক্লাব জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, দুনিয়ার মজদুর এক হও," আওয়াজ তোলে। এ এভাবে আগে কখনো শোনা যায়নি এই প্রতিধ্বনি। তারা পালানোর চেষ্টাও করেনি নির্ভয়ে ইস্তাহার বিলি করতে থাকেন। সময় মতো পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেন। থেমে থাকেনি জেলের মধ্যে। জেলে থাকালীন ভগৎ সিং ব্রিটিশ ভারতীয় রাজবন্দীদের সমান অধিকারের দাবিতে ৬৪ দিন অনশন করে করে দাবি-দাওয়া আদায় করেন। কারণ সে সময় ভারতীয় বন্দীদের থেকেও ব্রিটিশ চোর গুন্ডাদের প্রতি অধিগত ভালো ব্যবহার করা হতো।

মহান দেশ প্রেমিক ও বিপ্লবী ভগৎ সিং ইতিহাসের এক উপেক্ষিত চরিত্র। ইতিহাস এই সমস্ত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকদের যথার্থ সম্মান না দিলেও কি হবে দৈনিক সংবাদ মাধ্যম গুলোতে এই বিপ্লবী দের জন্ম কি মৃত্যু দিবসে তাদের কর্মকান্ডের ইতিহাস জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। বিপ্লবী ভগৎ সিং ইতিহাসের এক উপেক্ষিত নায়ক। ২৩ শে মার্চ ১৯৩১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছিল। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের ফলাফল তিনি হাতেনাতে পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের চক্রান্তে তাদের নির্ধারিত দিনের আগেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ইতিহাস বোধ হয় কারো অজানা নয়।

ভারতের এক জাঠ শিখ পরিবারে তার জন্ম হয়। তার পরিবার পূর্ব থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কৈশোরেই ভগৎ সিং ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং নৈরাজ্যবাদ ও কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপরে তিনি একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে  থাকেন। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে মেধা, জ্ঞান ও নেতৃত্ব দানের ক্ষমতায় অচিরেই এই সংগঠনের নেতা এ পরিণত হয়।তিনি নিজে হাতে কর্ম ক্ষমতা চালাতে থাকেন এবং এটির পরিবর্তন এনে হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এ পরিণত করেন। এর ফলে তাঁর সংগঠনেকে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া হলে যুক্তিবিদ্যায় তা খণ্ডন করেন।

তৎকালীনসময়কার বৃটিশবিরোধী ত্রাস হিসাবে বিপ্লবী ভগৎ সিং এর নাম উঠে আসে। ইতিহাসের পাতায় স্থান লাভ করতে থাকে ধীরে ধীরে আর সেটাই গাত্রদাহ হতে আরম্ভ করে তৎকালীন সমাজের প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের। তবে সেই সময়কার কিছু বাজারি দালালি ঐতিহাসিক বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবি মহল ভগৎ সিংকে সামান্য একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন। অথচ তার ঘটনাবহুল জীবনপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করলে তাঁকে এক মহান বিপ্লবী হিসেবে আমরা পেয়ে থাকি। যখন তাকে ফাঁসির মঞ্চে ডাকা হয়েছিল মৃত্যুর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ও সমাজতান্ত্রিক নেতা লেনিনের "রাষ্ট্র এবং বিপ্লব" বইটি পড়েছিলেন। ভাবা যায়, মৃত্যু শিয়রে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছিল তবু ও এক মুহূর্তের জন্য বিচলিত হননি। নিখাদ দেশ সেবায় এতো টুকুও খামতি রেখে যাননি। জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত দেশের মানুষের কথা ভেবেছিলেন। সেই মহান বিপ্লবী ইতিহাসের পাতায় সন্ত্রাসবাদি হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছিল আমাদের দেশের চরমতম লজ্জা ছাড়া আর কি বা হতে পারে? দেশের স্বাধীনতা লাভের নীল নকশার সৃষ্টিকারী ভগৎ সিং স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বপ্নের দেশ একদিন মুক্ত হবে অথচ স্বাধীনতা অর্জন করলাম, এক ঘৃণ্য জাতীয় বিভক্তির অভিশাপ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল।তারা আরো মন্তব্য করেছিলেন সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য সমাজতন্ত্র কোন বিকল্প নেই কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সেই সময় প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় উল্লেখ্য ভাব দর্শন বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছিলেন মহাত্মা গান্ধী। পশ্চাত্পদ সমাজকাঠামোর টিকিয়ে রাখা শ্রেণীসংগ্রামকে ধর্মীয় কাঠামো দিয়ে ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়।আপামোর জনতার শ্রেণী সংগ্রামকে প্রতিক্রিয়াশীলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার  বিশেষ চেষ্টা করা হয়।গান্ধী উঠে পড়ে লেগেছিলেন জনতার আন্দোলনকে বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রতিহত করে তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে আনা জন্য।

 ভগৎ সিং সেই স্বাধীনতা চান নি যেখানে ইংরেজ শাসক অভিজাত শ্রেণীর অবসান ঘটে দেশীয় অভিজাত ও শোষক শ্রেণী উপবিষ্ট হবে। তিনি আরো বলেছিলেন, আমরা সেই স্বাধীনতা চাই না যেখানে প্রচলিত শোষণ, শাসন, নিপীড়ন ও দাসত্ব  থাকবে। আমাদের সকল প্রচেষ্টা হলো এরূপ  স্বাধীনতার জন্য যেখানে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে এক বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো গড়ে উঠবে।

মহান বিপ্লবী ভগৎ সিং প্রথম জীবনে প্রচন্ড গান্ধীবাদী ছিলেন। কিন্তু যখন ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ সৈনিকরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শ্রমিক ও যুবকদের হত্যা করেছিলেন, সেই সময় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নীরবতা তাঁর সেই ভুল ভাঙিয়ে দেয়। তিনি তৎক্ষণাৎ গান্ধীর শিষ্যত্ব ত্যাগ করে বলশেভিক আদর্শে দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠে। কাল মার্কস এর সাহিত্য গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত বিপ্লবের দ্বারা নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন। শেষমেশ তিনি তার অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন গান্ধী মূলত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন চান না বরং উপনিবেশবাদ কে আরও পাকাপোক্ত করতেই ব্রিটিশদের হাত শক্ত করতে চাইছেন। ১৯২০ সালের কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের কার্যক্রমগুলো ভালোভাবে পড়াশোনা করতে থাকেন। সেই সময় ভারতীয় পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের মন্তব্য ছিল, ভারতে গান্ধীর আন্দোলন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ও পশ্চাদ পদ সামাজিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল।

মহান বিপ্লবী ভগৎ সিং জেলে থাকাকালীন ডায়েরি লিখতেন।প্রচুর বই পড়তেন। সুন্দর উপদেশ গুলি ডায়েরিতে টুকে রাখতেন। ১৯৩১ সালে জেলের মধ্যে যখন ফাঁসির অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলেন, সে সময় তিনি "why I am an atheist" প্রবন্ধটি লিখে ফেলেন। তার ফাঁসির কয়েক মাস পরে"the people" ( Lahore 27 September 1931) সংবাদে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

ভগৎ সিং এর ফাঁসির পর আঞ্চলিক স্থানীয় মানুষজন নিদারুণ শোক প্রকাশ করেন চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করে। তার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি অসহায় দেশবাসী। তার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে যখন গান্ধীর সীমাহীন চাতুরী সত্ত্বেও বামপন্থার লোকনেতা সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস দলীয় কার্যালয় দখল করেন, সম্মেলনস্থলে গান্ধীর বিরুদ্ধে মানুষ বিদ্রোহ প্রকাশ করেন। ঠিক সেই সময় নিউ ইয়র্কের টাইমস পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় যে ভগৎ সিং ও তার ২ কমরেড কে ফাঁসি দেওয়ার প্রতিবাদে করাচিতে গান্ধীর উপর হামলা চালান "সন্ত্রাসী" সদস্যরা। অচিরেই এই সমস্ত মহান বিপ্লবীরা দেশের বুকে সন্ত্রাসী হয়ে গেলেন। উল্লেখযোগ্য যে সাম্রাজ্যবাদী গণমাধ্যম সকল সময়ই বিপ্লবীদের সন্ত্রাসী আতঙ্কবাদী আততায়ী বলে প্রচার করতে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এসমস্ত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীরা সত্যই কি সন্ত্রাসবাদী ছিলেন? তৎকালীন গোয়েন্দা অফিসার স্যার উইলিয়ামসন ভগৎ সিং এর মৃত্যুর বছরখানেক পর লিখেছিলেন, "তার ছবি ভারতের শহর, নগর এমনকি গ্রাম-গ্রামান্তরে ব্যাপকভাবে বিক্রি হতে শুরু করে"। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভগৎ সিং এর এমন উত্থান মহাত্মা গান্ধীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার ফল স্বরূপ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ভগৎ সিংয়ের আদর্শ উদ্দেশ্য ও লড়াই-সংগ্রাম কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়েছে কিন্তু তার আদর্শ চেতনা এখনো মানুষকে প্রেরণা দেয়, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে আতঙ্কিত করে। তবে শোনা যায় ভগৎ সিং এর ফাঁসির জন্য অনেকটাই দায়ী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। অলিখিত তথ্যের উপর ভিত্তি করেই সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করা ঠিক নয়। যদি এমনটাই হয়ে থাকে সে সত্য একদিন সবার সামনে আসবেই, আর আমরা সেই দিনটার অপেক্ষায় আশায় রইলাম।

 

বটু কৃষ্ণ হালদার
কবর ডাঙ্গা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top