সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

অনেক বলিদানের মধ্যে দিয়ে এসেছে ভারতবর্ষের এই স্বাধীনতা : শিবব্রত গুহ


প্রকাশিত:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:২৫

আপডেট:
১৭ আগস্ট ২০২০ ২২:৪৯

 

আজ ১৫ ই আগস্ট। আজকের এই দিনটি প্রত্যেক ভারতীয়ের জীবনে এক বিশেষ বার্তা বহন করে আনে। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট, আমাদের দেশ ভারতবর্ষ হয়েছিল স্বাধীন। প্রায় দুশো বছরের পরাধীনতার জীবন থেকে চিরকালের মতো পেয়েছিল মুক্তি। দুশো বছর সময়টা তো বড় কম নয়।

সেই ১৭৫৭ সালে, নদীয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে হয়েছিল যুদ্ধ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের মধ্যে। তবে, একে যুদ্ধ না বলে, যুদ্ধের নামে প্রহসন বলাই ভালো। সেনাপতি মীরজাফর সহ বিশ্বাসঘাতক দলের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য, নবাব সিরাজউদ্দৌলা পারলেন না পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের শায়েস্তা করতে। পলাশীর প্রান্তরে ডুবে গেল ভারতের স্বাধীনতার সূর্য। ব্রিটিশদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল আপামর ভারতবাসী।

পরাধীনতার জ্বালা যে কি ভয়ংকর! তা এই প্রায় দুশো বছরে ভারতবাসী হাড়ে হাড়ে পেয়েছে টের। পরাধীন জাতির মানুষদের থাকে না কোন মান - সন্মান, তারা স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার পায় না। ব্রিটিশরা ভারতবাসীদের ওপর যা অন্যায় অত্যাচার করেছে তা ভাষায় যায় না প্রকাশ করা।

ক্রমাগত অত্যাচারে জর্জরিত ভারতবাসী, মন প্রাণ থেকে চেয়েছিল, এই পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্নভিন্ন করে স্বাধীনতা পেতে। স্বাধীনতা পাওয়ার উদগ্রীব বাসনায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিল ভারতবাসী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। কিন্তু, ব্রিটিশরা যে খুব শক্তিশালী। ওদের কাছে ছিল প্রচুর গোলা - বারুদ, অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্য সামন্ত।

তাতেও পায়নি ভয় ভারতবাসীরা। কারণ, ভারতবর্ষ বীরেদের দেশ। এই দেশের বুকে সম্রাট অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, পৃথ্বীরাজ চৌহান, রাণা প্রতাপসিংহ, শিবাজির মতো বীরপুরুষেরা ও রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো বীরাঙ্গনারা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই, বীর ভারতবাসীরা ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে স্বাধীন করতে। কারণ, নিজের দেশকে স্বাধীন করা প্রত্যেক দেশবাসীর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য।

কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর লেখা কবিতা "স্বাধীনতা" - তে লিখেছেনঃ

"স্বাধীনতা - হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্বশৃঙখল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়!
কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গ - সুখ তায় হে,
স্বর্গ - সুখ তায়।"

সত্যিই তাই, পরাধীনতার জীবনের থেকে স্বাধীনতার জীবন অনেক অনেক ভালো। এবার, আমি ভারতের স্বাধীনতা যাঁদের আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে এসেছে, যাঁরা পেরেছেন অসম্ভবকে করতে সম্ভব, তাঁদের কয়েকজনের সম্বন্ধে কিছু কথা ও কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

ভারত ছাড়ো আন্দোলন হল ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক বিখ্যাত আন্দোলনের নাম। একে আগস্ট আন্দোলনও বলা হয়ে থাকে। এই আন্দোলনে ভারতীয় নারীদের এক বিরাট ভূমিকা ছিল। তাঁরা দলে দলে, এই আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। এই আন্দোলনের এক মহান নেত্রীর নাম হল মাতঙ্গিনী হাজরা।

তাঁর সাহস ছিল অসাধারণ। তিনি পরিচিত ছিলেন "গান্ধীবুড়ি" নামে। ১৯৪২ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর, মেদিনীপুর জেলার তমলুক থানার সামনে, পুলিশের গুলিতে তিনি হয়েছিলেন শহীদ। তাঁর এই অবদান কখনো ভোলবার নয়।

১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট, দেশের স্বাধীনতার জন্য ফাঁসিকাঠে নিজের জীবন বলিদান দিয়েছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বোস। জেলের ভিতরে গড়া হয়েছিল ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ। ক্ষুদিরামকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে এসেছিল ব্রিটিশ সরকারের চার জন পুলিশ। তাঁদের সামনে নির্ভয় - নির্ভীক ছিলেন তিনি। মৃত্যুভয় তাঁকে পারেনি স্পর্শ করতে।

ক্ষুদিরামকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল তখন তাঁর কত বয়স ছিল জানেন? মাত্র ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন একজন স্বদেশপ্রেমী বিপ্লবী। তিনি সবার কাছে পরিচিত হয়ে আছেন "বাঘা যতীন" নামে। তাঁর সাহস ছিল অপরিসীম।

তিনি ওড়িশার বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে, অসীম বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। বালেশ্বর সরকারী হাসপাতালে, মৃত্যুর আগে, তিনি হেসে বলেছিলেন, "এত রক্ত ছিল শরীরে? ভাগ্যক্রমে, প্রতিটি বিন্দু অর্পণ করে গেলাম দেশমাতার চরণে।"

একথা শুনলে চোখে আসে জল। কোলকাতা মহানগরের এক নামকরা জায়গার নাম হল বি. বা. দী. বাগ অথবা বিনয় - বাদল - দীনেশ বাগ। এই বিনয়, বাদল, দীনেশ কারা ছিলেন জানেন আপনারা? এরা ছিলেন ভারতের অগ্নিযুগের তিনজন খ্যাতনামা স্বাধীনতা সংগ্রামী।

এদের পুরো নাম হল বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত। ১৯৩০ সালের ৮ ই ডিসেম্বর, এরা তিনজনে, ইউরোপীয় পোষাকে সুসজ্জিত হয়ে, প্রবেশ করেছিল, রাইটার্স বিল্ডিং - এ। সেখানে প্রবেশ করে, তাঁরা, গুলি করে হত্যা করেছিল কর্নেল সিম্পসনকে। তারপর, তাঁদের সাথে ব্রিটিশ পুলিশদের তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। বাদল গুপ্ত পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে, ঘটনাস্থলেই আত্মহত্যা করেছিলেন।

বিনয় বসু ও দীনেশ গুপ্ত নিজেদের ওপর গুলি চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে, হাসপাতালে, বিনয়, সবার নজর এড়িয়ে, ক্ষতস্থানে আঙুল দিয়ে সেপটিক করে করেছিলেন আত্মহত্যা। দীনেশ সুস্থ হয়ে ওঠেন ও ফাঁসিতে আত্মবলিদান দিয়ে হয়েছিলেন শহীদ।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান নারী যোদ্ধা ও প্রথম বিপ্লবী নারী শহীদ কে ছিলেন জানেন? তিনি হলেন আমাদের সবার গর্ব প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তিনি ছিলেন এক মহিয়সী সাহসী নারী। তিনি দেশকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ নেবার জন্য, আক্রমণ করেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের ইউরোপিয়ান ক্লাবে, ১৯৩২ সালে। তারপর, তিনি শহীদ হয়েছিলেন।

সূর্যকুমার সেন বা সূর্য সেন ছিলেন ভারতের এক বিখ্যাত বিপ্লবী। তিনি পরিচিত হয়ে আছেন "মাস্টারদা" নামে। তাঁর ডাকনাম ছিল কালু। ব্রিটিশ শাসকদের বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি করেছিলেন এক অসাধ্যসাধন। তাঁর নেতৃত্বে বিপ্লবীরা অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ব্রিটিশ শাসনকে করে দিয়েছিল নিশ্চিহ্ন, কয়েকদিনের জন্য। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, " কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে? "

"ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারবে।
কিন্তু আমার ভাবনাকে মারতে পারবে না।
ওরা আমার শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারবে।
কিন্তু, আমার আত্মাকে শেষ করতে পারবে না।"

- উপরোক্ত কথাগুলি কে বলেছিলেন জানেন?
তিনি হলেন আমাদের দেশের বীর বিপ্লবী ভগৎ সিং। তাঁর বীরত্ব ছিল এককথায় অসাধারণ। মাত্র ২৩ বছর বয়সে, দেশের জন্য ফাঁসিতে জীবন দিয়ে তিনি হয়েছিলেন শহীদ।

সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় নেতা। তাঁর নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা ছিল অপূর্ব। তিনি বলেছিলেন,
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও,
আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।"
তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় নেতাজী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত তিনি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।

ভারতের এই স্বাধীনতা কিন্তু আসেনি সহজে। অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে এসেছে স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য ঝরেছে অনেক রক্ত। কত মায়ের কোল খালি হয়েছে, কত স্বামীকে হারিয়েছে স্ত্রী, কত পরিবার হয়ে গেছে নিঃশেষ, নেই তার কোন হিসাব। এটা ঠিক, অনেক বলিদানের মধ্যে দিয়ে এসেছে ভারতবর্ষের এই স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা।

( তথ্য সংগৃহীত )


শিবব্রত গুহ
কলকাতা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top